বুধবার, ২ জুন, ২০২০
ডা. মো. সাজেদুর রহমান শাওন
PhD (Oxford), MBBS (DMC), MPH, MSc (Sweden)
এপিডেমিওলোজিস্ট,
ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।
“পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড” আজ করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুহার নিয়ে তাদের গবেষণা রিপোর্ট পাবলিশ করেছে। সেখানে দেখা গিয়েছে ইংল্যান্ডে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির মানুষের তুলনায় বাংলাদেশীদের মধ্যে করোনার মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
সাদা ব্রিটিশদের সাথে তুলনা করার পর দেখা গিয়েছে বাংলাদেশীদের মধ্যে মৃত্যুর হার দ্বিগুণ। যেখানে সাদা ব্রিটিশদের সাথে তুলনা করে ইন্ডিয়ানদের মৃত্যুর হার ১.২২ গুণ আর পাকিস্তানিদের ১.৪৪ গুণ। সংখ্যাগুলিকে পুনরায় হিসেব করে যদি বলি, তাহলে ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মধ্যে করোনার মৃত্যুহার ইন্ডিয়ানদের তুলনায় ৬৬% বেশি আর পাকিস্তানিদের তুলনায় ৪০% বেশি।
তার সাথে আরও ভয়াবহ যে ব্যাপারটি সেটি হলো বাংলাদেশীদের এই অধিক মৃত্যুহার যাদের বয়স ২০-৬৪ বছর এবং যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি- সবার জন্যই প্রযোজ্য।
আমাদের দেশের মোট করোনায় মৃত্যুকে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মৃত্যুহার বের করে এবং অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে, এর আগে বিভিন্ন সময়ে মানুষজন দাবি করার চেষ্টা করেছে যে বাংলাদেশীদের করোনায় মৃত্যুহার বেশি।
কিন্তু সেই হিসেবটিতে এপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণার অনেকগুলি বিষয় অন্তর্ভুক্ত না করার ফলে সেই ধরণের তুলনামূলক হিসেব ভুলে ভরা। যেমনঃ বাংলাদেশে যেহেতু টেস্ট কম হচ্ছে, তাই যাদের রোগের উপসর্গ অনেক বেশি, তাদেরকে বেশি টেস্ট করা হচ্ছে। আর এই গুরুতর আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর সম্ভবনা অনেক বেশি। আবার জনসংখ্যার গঠনে তারতম্য থাকায় আমরা সরাসরি দুটি দেশের মধ্যে মৃত্যুহার তুলনা করতে পারবোনা। এই ধরণের আরও বেশ কিছু বিষয়ের জন্য বাংলাদেশীদের মধ্যে করোনার মৃত্যুহার তুলনামূলক কেমন তা সঠিকভাবে বলা একেবারেই সম্ভব ছিলনা।
কিন্তু ইংল্যান্ডের এই গবেষণা রিপোর্টটি আজ আমাদেরকে জানিয়ে দিলো যে, অন্যান্য জাতির তুলনায় বাংলাদেশীদের মধ্যে করোনার মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। আসুন দেখি, কি কি কারণে এই গবেষণা রিপোর্টটি সঠিক এবং নির্ভরযোগ্যঃ
১) প্রথম যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো এই গবেষণায় ব্যবহৃত ডাটার কোয়ালিটি। এই গবেষণায় করোনা কেস এবং করোনায় মৃত্যুর ডাটা এসেছে ইংল্যান্ডের ‘Office for National Statistics” থেকে যারা হাই-কোয়ালিটি Surveillance System এর মাধ্যমে এই ডাটাগুলি সংগ্রহ করেছে। ফলে আনরেকর্ডেড কেস এবং ডেথ এর সংখ্যা খুব কম হবার কথা। আর যদিও কিছু হয়ে থাকে সেটি শুধুমাত্র বাংলাদেশীদের জন্য আলাদা করে হবার কথা না, হলে সবার জন্য একইভাবে হবার কথা।
২) দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এই গবেষণার অ্যানালাইসিস। করোনায় মৃত্যুর হার হিসেব করার জন্য তারা সবচেয়ে ভালো স্ট্যাটিস্টিক্যাল মডেল ব্যবহার করেছেন এবং সেই মডেলে বয়স, লিঙ্গ, বসবাসের এলাকা এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার মত বিষয়গুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে এই গবেষণার ফলাফল অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।
৩) ইংল্যান্ডে যেহেতু সবাই NHS এর আওতায় ফ্রিতে চিকিৎসা পান, তাই সেখানকার বাংলাদেশীদের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবার সম্ভবনাও একেবারে নেই বললে চলে।
বাংলাদেশে বসবাসরত মানুষজনের মধ্যে করোনায় মৃত্যুর হার ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশীদের মৃত্যুহার থেকে কম হবার কোন যৌক্তিক কারণ আমি দেখছিনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন বাংলাদেশীদের মধ্যে করোনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি?
সেটির ব্যাপারে এই রিপোর্টে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু আমরা যদি পূর্বের গবেষণালব্ধ উপাত্তগুলি থেকে ভেবে দেখার চেষ্টা করি তাহলে যে বিষয়গুলি উঠে আসবে সেগুলি হলঃ
১) বাংলাদেশীদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার সহ অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি।
২) অন্যান্যদের থেকে বিভিন্ন কারণে (যেমনঃ ধূমপান, অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা, ব্যায়াম না করা) বাংলাদেশীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হতে পারে।
৩) বাংলাদেশীদের মধ্যে ফুসফুসের অসুখ (যেমনঃ এজমা, COPD) বেশি হতে পারে, যার কারণে করোনা ভাইরাস ফুসফুসকে বেশি আক্রান্ত করতে পারছে।
৪) এই সবগুলি বিষয়ের পেছনে জেনেটিক কারণও থাকার সম্ভবনা রয়েছে।
কারণ যাই হোক না কেন, করোনায় মৃত্যু ঠেকাতে আমাদের উচিত হবে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। গতকাল সারাদেশে প্রায় ৩০০০ জন করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে। আর তাই এই সময়ে আমাদের দেশে (কঠিন) লকডাউন দেয়াটা খুব খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। আশা করছি সরকার সঠিক সিদ্ধান্তটি নিবেন।