আইসিইউ ডায়েরি -২

প্ল্যাটফর্ম নিউজ
শুক্রবার, ৮ই মে, ২০২০

লেখা: ডা. মেহেদী হাসান

রাত বাড়ছে, বাড়ছে শ্বাসকষ্ট- কমছে অক্সিজেনের মাত্রা। এই করোনাকালে এটা আইসিইউ এর একটা কমন সিনারিও। এ কয়টাদিনে আমার ডিউটিতে দুজন কোভিড পেশেন্টকে মারা যেতে দেখেছি চোখের সামনেই। একজনের বয়স আমার কাছাকাছিই। একটা শ্বাসের জন্য তীব্র এই ব্যাকুলতা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

ভাবনার গভীরে হারিয়ে যাই মাঝে মাঝে। নানা প্রশ্ন ভীড় করে মনের মাঝে। কেন ছুটছি এভাবে পাগলের মত? বস্তুর প্রতি কেন এই সীমাহীন লোভ? দুনিয়ার প্রতি কিসের এত মোহ? এত অর্থ-সম্পদ, বাহারি ডিগ্রি, নামযশ খ্যাতি ও প্রতিপত্তি কোন কাজে আসে না চারদেয়ালে ঘেরা জীবন মৃত্যুর এই যুদ্ধক্ষেত্রে।

সব আইসিইউতেই জেনারেটর এর ব্যাকআপ থাকে। তবে কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর এক্টিভ হতে অল্পকিছু টাইম লাগে। এই সময়টাতে আলো-আঁধারির এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়। মনিটরগুলোর নানা রমক আলো, এলার্ম আর সংকেত আইসিইউ এর ঘুটঘুটে আঁধারের সাথে মিশে গিয়ে যেন অন্তিম মুহুর্তের প্রতিচ্ছবি আঁকে। আমি কবি মানুষ- এই সময়টাতে আমার বুকের মধ্যে কেমন জানি হাহাকার করে উঠে। মনে হয়, এই তাহলে জীবন? তারপর?

তারপর আজিব এক জীবন যার শুরু আছে অথচ শেষ নেই। সেই জীবনের জন্য এখনই প্রস্তুত হওয়া দরকার।
বড় লেখা আমি লিখতে পারি না, সাধারণত টুকটাক কবিতা লিখি। লেখাটা বড় করছি সময় এবং সুস্থ থাকার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। আল্লাহ পাক আমাকেও বোঝার এবং কাজে লাগানোর তৌফিক দিন।

এই যে আমরা সুস্থ আছি, চাইলেই সিজদা দিতে পারছি, উচ্চকণ্ঠে তিলওয়াত করতে পারছি কালামুল্লাহ- এ যে কতবড় নেয়ামত এই শ্বাসকষ্টের রোগী গুলোকে দেখলে বুঝে আসে। আমাদের হাসপাতালে এখন প্রায় ৫০০ করোনা রোগী আর ১৫ বেডের আইসিইউ সবসময়ই ফুল থাকছে। কোভিড পেশেন্ট আইসিইউতে আসে মূলত শ্বাসকষ্ট নিয়েই। প্রথমে ন্যাজাল ক্যানুলা বা ফেসমাস্ক দিয়ে অক্সিজেন দেই। কিছু ভাগ্যবান রোগী এতেই রেসপন্স করে। তবে অনেকেরই অক্সিজেন ডিমান্ড অনেক হাই থাকে। তাদের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ মেশিনের (হাইফ্লো মেশিন) সাহায্য নিই যার মাধ্যমে আমরা মিনিটে ৫০-৬০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দিতে পারি।

আমাদের আইসিইউতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি পেশেন্টকে ভেন্টিলেটরে না দিতে কারণ যেগুলো পেশেন্টের ভেন্টিলেটর লেগে যাচ্ছে তারা সাধারণত ব্যাক করছে না। তবে হাইফ্লো অক্সিজেন দিয়েও কিছু কিছু রোগীর এতটা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে যা চোখে দেখার মত না অথচ তাকিয়ে দেখা ছাড়া তেমন কিছু করারও নেই।

নসিহতের নিয়তে লিখছি। নসিহত মুমিনের কাজে আসে। তবে নসিহত প্রথমত নিজের জন্য। আমরা চাইলেই সিজদাহ্ দিতে পারি অথচ সিজদাহ্ দিতে আমাদের কত অনীহা! এইসব শ্বাসকষ্টের রোগীগুলো নির্দিষ্ট পজিশনে কিছুটা ভাল থাকে- বেশি নড়াচড়া করলেই শ্বাসকষ্ট বাড়ে। চাইলেও তাদের সিজদাহ্ দেবার ক্ষমতা নেই। আজ আমি আপনি সুস্থ আছি, কিন্তু যে হারে করোনা ছড়াচ্ছে তাতে দুদিন পরেই আমাদেরকেও শ্বাসকষ্ট নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে( সিট পাবেন কিনা সে আলোচনায় যাচ্ছি না)। তাই সময় থাকতে বেশি বেশি সিজদাহ্ করা দরকার। হঠাৎ করেই একদিন দেখা যাবে আর সময় নেই।

আমার ব্যাগে সমসময় দুইটা কুরআন রাখি। একটা খিদমাহ শপ.কম থেকে কেনা কালার কোডেড কুরআন। যখন স্ট্রেসে থাকি বা অর্থবুঝে পড়ার মত মেন্টাল পিস থাকে না তখন স্ট্রেস রিলিভার হিসাবে তিলওয়াত করি। আর একটু অবসর পেলে সিয়ান পাবলিকেশন্স থেকে কেনা ‘মহিমান্বিত কুরআন’টা পড়ি। তবে অনেক সময় ব্যাগে দুটো কুরআন এবং হাতে অফুরন্ত সময় থাকা সত্ত্বেও কুরআন না পড়ে এটা ওটা করে সময়ের অপচয় করি। কুরআনের কথা তুললাম একটা বিষয় বোঝানোর জন্য। শ্বাসকষ্টের এই রোগী গুলো একটা সেনটেন্স উচ্চারণ করতে গিয়েই হাঁপিয়ে উঠে। চাইলেও তারা কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে না। এখান থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার। কে কতটা কুরআন পড়েছে সেটাই জান্নাতে তার স্ট্যাটাস নির্ধারণ করবে। তাই সময় থাকতেই কুরআনের সাথে বেশি বেশি সময় কাটানো দরকার। নাহলে হঠাৎ করেই একদিন সময় শেষ হয়ে যাবে।

ভাবছি এই সিরিজটাতে আমার আইসিইউ জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও অভিজ্ঞতা নসিহত মূলক ভাবে আপনাদের শেয়ার করব। আমি যদিও কাউকে নসিহত করার যোগ্য নই, তাও করি এই আশায় যে মানুষকে বলতে বলতে যেন লজ্জায় পড়ে হলেও নিজে আমলের উপর উঠতে পারি।

আল্লাহ পাক ইখলাসের সাথে লেখার তৌফিক দিন। আমার লেখাটা এবং আপনাদের পড়াটা যেন শুধুশুধু সময়ের অপচয় না হয়।

চলুক নাকি? মতামত জানাতে পারেন।
#ডিউটিতে_আছি

হৃদিতা রোশনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনার ক্রান্তিকাল, নতুন দিনের প্রত্যাশা

Fri May 8 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ০৮ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার: দুঃসময় এবং অবিমৃষ্যকারীতা: ১০০ বছরের মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক মহামারীর কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে বিশ্ববাসী। চারদিকে ভয়, গুজব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ছড়াছড়ি। এর মাঝে সচেতনভাবে নিজেকে রক্ষা করা এবং একটি কার্যকরী ভ্যাক্সিনের অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই করণীয় নেই। এবং প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সফলও […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo