আনন্দ_ও_বেদনা_গাঁথাঃ
১….
বেদনা দিয়ে শুরু করি, আনন্দের কথা পরে বলি…..
বছর তিনেক আগের পহেলা ফাগুনের সন্ধ্যা।জ্যামের কারণে TSC এর আগেই আমাকে রিকশা ছেড়ে দিতে হলো, গন্তব্যস্থল-BSMMU(প্রাক্তন পিজি হাসপাতাল)….
আমি উর্ধ্বশ্বাসে হেঁটে চলছি, চোখে পানি আটকে রাখতে চেষ্টা করছি, লাভ হচ্ছে না। চারপাশে আনন্দিত মানুষের উচ্ছ্বাস, সে উচ্ছ্বাস অবশ্য আমাকে স্পর্শ করার কোনো কারণ নেই।আম্মু তখন BSMMU তে ভর্তি, কিডনী সংক্রান্ত নানা জটিলতায় অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল, বাঁচার আশা তখন অনেকটাই আমাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে….
হাসপাতালে পৌছে দেখি আম্মুর কোনো হুশ নেই।দুপুরের দিকে CT scan( Abdominal CT) করা হয়েছে।গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে CT scan এ আবার কিডনীতে টিউমার ধরা পড়েছে, ইউরোলজীর ডাক্তারদের কল্ করা হয়েছে যাতে তারা পেশেন্টকে দেখে তাদের মতামত দেন….
পরদিন সকালে যে ইউনিটে মা ভর্তি সে ইউনিটের ডক্টরদের রেফারেল লেটার নিয়ে আমি ইউরোলজী ডিপার্টমেন্টে গেলাম।যে প্রোফেসরের কাছে রেফারেল নোট দেয়া হয়েছে তাকে খুঁজে পাচ্ছিনা।তিনি কোথায় আছেন -সেটাও কেউ বলতে পারছে না। চার-পাঁচ রুম ঘোরার পর অন্য আরেক প্রোফেসরের রুমে উনাকে খুঁজে পেলাম…..
স্যার পেপার পড়ছিলেন।আমি রেফারেল নোট উনার কাছে নিয়ে যাওয়াতে উনার পেপার পড়া বাধাগ্রস্ত হলো।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন…
–এখানে কি?
–স্যার, আপনার কাছে একটা রেফারেল ছিলো…
উনি যারপরনাই বিরক্ত হলেন।তাড়াহুড়ো করে রেফারেল নোটটি একঝলক দেখে উনি বলে উঠলেন….
–কিডনী তো কাটতে হবে..
–স্যার, Lesion টা অ্যাকচুয়ালী কি? Bening হবার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা?
–(অধৈর্য কণ্ঠে)আরে, এটা তো Carcinoma( ক্যান্সার), কিডনী ফেলে দিতে হবে…
–স্যার, আম্মুকে কি একটু গিয়ে দেখে আসা যায়? উনার যে ফিজিক্যাল কন্ডিশন তাতে অপারেশন করাটা বোধ হয় রিস্কি…
–(বেশ বিরক্ত হয়ে)যান যান, ডায়ালাইসিস দিয়ে নিয়া আসেন, এরপর কিডনী ফালায়া দিব….
উনি রেফারেল নোটে সিগনেচার করলেন, তারপর আবার পেপার পড়ায় মনোযোগ দিলেন, আমি সামনে দাঁড়িয়ে আছি-সেটা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করলেন।এক প্রোফেসর আরেক প্রোফেসরের কাছে রেফারেল নোট লেখার পরও উনি আম্মুকে দেখতে গেলেন না…
আমি এক চিকিৎসক হয়েও সেদিন উনার কাছে যে ব্যবহার ও আচরণ পেয়েছিলাম সেটা আমার আজীবন মনে থাকবে।মেডিকেল এথিকস্ এর কোনো ধার উনি ধারেননি…..
স্যারের রুম থেকে অপমানিত হয়ে বিষাদগ্রস্ত অবস্থায় বের হলাম। রিস্ক-বেনিফিট রেশিও চিন্তা করে আমি ঐ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম-Operation should be postponed….
আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো, আম্মু এখনো আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছেন, আম্মুর কিডনীর প্রবলেমটি ক্যান্সার ছিলো না….
২….
এইবার আনন্দের কথা বলি…
স্থান-আবারো সেই BSMMU….
মা’র শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, একবার এক ধাক্কায় চট্ করে নিউমোনিয়া থেকে সারা শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়লো (Septicaemia)।এক্সরে করে দেখা গেলো ফুসফুসে পানি( Pleural effusion)। পরে দেখা গেলো হার্টেও পানি( Pericardial effusion), পেটেও পানি(Ascites)।যে পানির অপর নাম জীবন, সে পানিতে পানিময় হয়ে আমার মাতার তখন ত্রাহি মধুসূদন দশা….
যথারীতি বক্ষব্যাধী ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের কল্ করে রিকোয়েস্ট লেটার আমার হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো…
আম্মু ভর্তি ছিলেন কেবিন ব্লকে।বক্ষব্যাধী ডিপার্টমেন্ট D ব্লকের ১৬ তলায়( নাকি ১৭?, মনে নেই)।কেবিন ব্লক থেকে নেমে D ব্লকের ১৬ তলায় বক্ষব্যাধী ডিপার্টমেন্ট এ এসে জিহ্বা বের করে একটু হাঁপিয়ে নিলাম, অতঃপর কাগজপত্র নিয়ে স্যারের রুমে প্রবেশ করলাম….
প্রিয় পাঠক, প্রথম ঘটনায় আমি কোনো নাম উল্লেখ করি নাই।আনন্দের যে ঘটনার কথা আমি বলতে যাচ্ছি সে গল্পের নায়কের নাম এবার আমি বলবো।খলনায়কের নাম প্রকাশ নাই বা করলাম, নায়কের নাম প্রকাশ করতে কোনো বাঁধা দেখি না…
হাঁপিয়ে বক্ষব্যাধীর প্রোফেসরের রুমে ঢুকা মাত্রই আমি নায়ককে দেখতে পেলাম–শ্রদ্ধেয় Professor Dr. AKM Mosharraf Hossain…..
স্যার ধৈর্য নিয়ে রেফারেল নোট পড়লেন, আমার কাছে প্রতিটা তথ্য রিচেক্ করলেন, নিজে এক্সরে বক্সের লাইট জ্বালিয়ে আম্মুর এক্সরেটাও দেখলেন। ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান নিয়েও আলোচনা শুরু করলেন।আমার বুক থেকে পাথর নেমে গেলো।পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ক্লাস নিতে হবে,ব্যস্ত স্যারকে চলে যেতে হলো।যাবার আগে আম্মুর কেবিন নাম্বারটা জেনে নিলেন….
স্যার যেভাবে আমার সাথে আম্মুর পরবর্তী চিকিৎসা প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, তাতে উনার আর আম্মুকে দেখতে আসার প্রয়োজন ছিলোনা।এক ব্লক থেকে আরেক ব্লকে যেতে আমারই কষ্ট লাগে, কাজেই স্যার আবার কেবিন নাম্বার মনে রেখে আম্মুকে দেখতে আসবেন-সেটা এক্সপেক্ট করি নাই।বেদনার কাব্যে যে স্যারের কথা বলেছিলাম উনি একই বিল্ডিং এর একই তলায় থাকলেও আম্মুকে দেখতে যাবার কষ্ট স্বীকার করতে চান নি, বক্ষব্যাধীর Professor এক বিল্ডিং এর ১৬ তলা থেকে নেমে আবার কেবিনে উঠে আম্মাকে দেখতে আসবেন–এটা আশা করা বাতুলতা….
আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার দুপুর ২:৩০ টায় আম্মুকে ক্লিনিক্যালি দেখতে এলেন।ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট এলে স্যারকে সাথে সাথে ইনফর্ম করতে বললেন। পরদিন সরকারী ছুটি ছিলো, তাই স্যার তার নিজের মোবাইল নম্বরটিও দিলেন যাতে আমি উনাকে রিপোর্ট জানাতে পারি, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান এ যাতে কোনো delay না হয়…..
৩….
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আম্মুকে নিয়ে আমাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে ও হচ্ছে।আমি জানি এই যুদ্ধের কত রঙ রয়েছে, আমি জানি এই যুদ্ধ কত ভয়াবহ,আমি জানি এই যুদ্ধের ভেতর কত উপযুদ্ধ রয়েছে।সিমিলার সিচুয়েশনে কেউ না পরলে এ যাতনা তার জন্য উপলদ্ধি করা অসম্ভব…..
যতটুকু পেরেছি নিজে চিকিৎসা দিয়েছি।আয়ত্বের বাইরে চলে গেলে রোগী ও রোগীর লোক হিসেবে বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছি। রোগীর লোক হিসেবে আমি দেখেছি ঐ মুহূর্তে চিকিৎসকের একটু কঠিন আচরণ, একটু অবহেলা কতটা কঠিন ও ভয়াবহ আকারে আমার অন্তরকে বিদ্ধ করেছিলো….
এটি ছিলো আমার জীবনের জন্য একটি বিশাল শিক্ষা।আমার এ শিক্ষার প্রয়োজন ছিলো…..
৪….
ইতি টানি…..
আমার প্রতিটা লেখার পেছনে কোনো না কোনো একটা উদ্দেশ্য থাকে।এ লেখাটিও সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়।আমি জানি আমার ফ্রেন্ডস্ এন্ড ফলোয়ারস এর একটি বিশাল অংশ চিকিৎসক বা হবু চিকিৎসক। আমি জানি আপনারা কতটা ক্ষমতা ধারণ করেন।আমি জানি, সমাজকে পজিটিভ ওয়েতে পরিবর্তন করার যাদুর কাঠি আপনাদের হাতে রয়েছে।শুধু একটা কথা বিনীতভাবে আপনাদের একটু রিমাইন্ড করিয়ে দেবঃ “With Great Power Comes Great Responsibility”…..
দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি।একটি অভিজ্ঞতা অন্ধকারাচ্ছন্ন, আরেকটি আলোকময়। জীবন চলার পথে চিকিৎসক হিসেবে কোন্ ঘটনাকে আপনার জীবন চলার পাথেয় হিসেবে বেছে নেবেন- সে সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার….
…..
লেখাটি ডা. জামান অ্যালেক্স এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত