কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারের জন্য, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মেডিসিনে একজন বাঙ্গালী চিকিৎসক’কে নোবেল পুরষ্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়েছিল।।
তার নাম, স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। তিনি ১৯২০ সালে কালাজ্বরের ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করেন এবং ১৯২৯ সালে নোবেল পুরষ্কারের জন্য বিবেচিত হন।
একটা সময় ছিল, যখন যথাযথ প্রতিষেধক না থাকার কারণে কালাজ্বরের প্রকোপে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। শুধু তা-ই নয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পর্যবেক্ষণ মতে, বর্তমানেও প্রতি বছর ২-৪ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেবদূত হিসেবে এগিয়ে আসলেন একজন, একজন বাঙ্গালি চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী।
১৯২২ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চে ৮ জন কালাজ্বর রোগীকে সুস্থ করার বিবরণ সহ উপেন্দ্রনাথের আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হয়। । তিনি তাঁর গবেষণা পত্রে ওষুধটির বিষাক্ততা সম্পর্কে আলোচনা করেন । পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেটে ইউরিয়া স্টিবামাইন সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশিত হয় এবং তার একবছর পরে, উপেন্দ্রনাথ আরো কিছু তথ্য প্রকাশ করেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেটে। কালাজ্বর ছাড়াও উপেন্দ্রনাথ ফাইলেরিয়া, ডায়াবেটিস, কুষ্ঠ, মেনিনজাইটিস প্রভৃতি নিয়েও গবেষণা করেছিলেন । চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্বন্ধে রচনাবলীর মধ্যে ট্রিটিজ অন কালাজ্বর বিখ্যাত।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এল.এম.এফ. শেষ করে, ১৯০০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত মেডিসিন ও সার্জারি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে Goodeve and Macleod awards অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯০২ সালে তিনি ডক্টর অব মেডিসিন ও ১৯০৪ সালে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “Studies in Haemolysis”।
জামালপুরের ছেলে স্যার উপেন্দ্রনাথ, চাকরি জীবনের শুরুতে ঢাকা মেডিকেল স্কুল, বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতাল এর কথাও, কোন কোন তথ্যে, উল্লেখ রয়েছে) এবং পরবর্তীতে ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল (বর্তমান নীল রতন সরকার মেডিকেল কলেজ) এ চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন।
যেহেতু তিনি পিএইচডি করার সময় থেকেই লোহিত কণিকার হেমোলাইসিস বা ভাঙন নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। তাই চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি গবেষণাকার্যেও তিনি লোহিত কণিকার ভাঙন সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটিয়ে কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কারে মনোনিবেশ করলেন।
১৯১৫ সাল থেকে উপেন্দ্রনাথ ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলের একটি ছোট্ট কক্ষে নিজের গবেষণা শুরু করলেন। ১৯২১ সাল পর্যন্ত আর্সেনিক, পারদ, কুইনাইন আর সোডিয়াম এন্টিমনি টারটারেটের একটি মিশ্রণকে কালাজ্বরের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু তা কালাজ্বর রোধে সম্পূর্ণ কার্যকরী ছিল না। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে গবেষণার একটি পর্যায়ে সোডিয়াম এন্টিমনি থেকে সোডিয়াম পৃথক করে ইউরিয়া আর এন্টিমনির সংযোগে ইউরিয়া স্টিবামিন এর যৌগ তৈরি করতে সক্ষম হলেন।
গবেষণার ফলাফল দেখতে তিনি প্রথমে যৌগটি খরগোশের শরীরে প্রয়োগ করে দেখতে চাইলেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তার গবেষণালব্ধ ইউরিয়া স্টিবামাইন যৌগটি কালাজ্বরের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ রূপে কার্যকর। ১৯২১ সালের জুলাই মাসের কোনো এক দিন প্রায়ান্ধকার ঘরে তিনি যে অসাধারণ আবিষ্কার করেছিলেন তা অণুজীববিজ্ঞানের ইতিহাসে যে এক অনন্য আলোকিত দিগন্তের সূচনা করেছিল – এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৭২ বছর বয়সে ১৯৪৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি উপেন্দ্রনাথ পরলোক গমন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে সেই সময়ের সকল সংকীর্ণতা এবং বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পুরোধা এই বৈজ্ঞানিকের মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছিল পুরো বিশ্ব। প্রখ্যাত গবেষণা পত্রিকা নেচারে (২৭ এপ্রিল, ১৯৪৬) তার মৃত্যুতে শোক বার্তা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল-
“৬ ফেব্রুয়ারি স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর সাথে সাথে ভারতবর্ষ হারিয়েছে তার বুকে জন্ম নেওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানীকে। স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বিশ্বের কাছে মূলত একজন আবিষ্কারক এবং লিশমেনিয়া গোত্রের পরজীবী ঘটিত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ থেরাপিউটিক এজেন্ট ইউরিয়া স্টিবামাইনের জনক হিসেবে পরিচিত হলেও, যারা ভারতীয় উপমহাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধীয় গবেষণা সম্পর্কে একটু হলেও আগ্রহী, তারা জানেন তিনি ছিলেন সহজাত মৌলিক গবেষক এবং বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য ও অপরিসীম কৌতূহল সম্পন্ন একজন অক্লান্ত পর্যবেক্ষক।”
তথ্যসূত্রঃ
ডা. নিলয় শুভ
এফ-২১, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার
সুমাইয়া নার্গিস
শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ