লেখক: ডা: মো: মারুফুর রহমান অপু
এই পোস্টটি কাউকে ছোট করার উদ্দেশ্যে নয় বরং যে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়েছিলো বৈষম্য দূর করতে সেই স্বাধীনতার অন্তরায়ে কাজ করা ক্যাডার সার্ভিস বৈষম্যের প্রকৃত রূপ প্রকাশই এই লেখার উদ্দেশ্য।
আমলাতন্ত্রের ইতিহাস যারা জানেন তারা অনেকেই সম্মত হবেন যে রাস্ট্রব্যবস্থার সেই প্রাচীনকাল থেকেই প্রজাদের উপর ছড়ি ঘোরানোর উদ্দেশ্যে একটি সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা দাম্ভিক এলিটিস্ট শ্রেনী গঠন করা হয়। প্রাচীন রোমান আমলেও এরা ছিলো এবং একটা সময় পর্যন্ত সেনা প্রশিক্ষন ছাড়া কেউ আমলা হতে পারত না। বহুকাল পর্যন্ত সাধারনের জন্য এই শ্রেনী উন্মুক্ত ছিলো না। ব্রিটীশ সময়ে রবার্ট ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিং ও পরবর্তীতে লর্ড কর্নওয়ালিসেরা ভারতবর্ষ পরিচালনার সুবিধার্থে এক বিশেষ আমলাতন্ত্র তৈরি করেন যাতে ইউরোপীয়রাই অংশগ্রহন করতে পারতো। লর্ড কর্নওয়ালিস বিশ্বাস করতেন স্থানীয়রা অনেক বেশি দূর্নীতিগ্রস্থ বিধায় তাদের আমলা হবার কোন অধিকার নেই, এটা শুধুই শ্বেতাংগদের সংরক্ষিত। ১৮৫০ এর দশকে টি. বি ম্যাকলের সুপারিশে প্রথমবারের মত লন্ডনে প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নেটিভ ইন্ডিয়ানদের এই ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র তথা সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। নেটিভদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেও আইসিএসে (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারটা এত সোজা ছিল না। বহু অর্থ খরচ করে বিলেতে গিয়ে ইংরেজী ও ইউরোপীয় ভাষা সাহিত্য ইতিহাস নিয়ে বৃটিশদের সাথে প্রতিযোগিতার করে সুযোগ পাওয়া কঠিন একটা কাজ ছিল। যার ফলে পরবর্তী চৌদ্দ বছরে শুধু মাত্র একজন নেটিভ আইসিএস হতে পেরেছিল। এবং তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম নেটিভ আইসিএস।
প্রতিযোগীতায় টিকে যাবার পরেও অক্সফোর্ডে ২ বছর পড়াশুনা ও প্রশিক্ষন শেষে তারা শিক্ষনবীশ অফিসার থেকে আইসিএস অফিসার হতে পারতেন যদিও প্রশাসনের উচ্চপদ ব্রিটিশদের জন্যেই সংরক্ষিত ছিলো। এই আইসিএস অফিসারদের ততকালীন সময়ে বলা হত “স্বর্গীয় সন্তান”, এবং তাদের ক্ষমতার সুপিরিওরিটি সেভাবেই দেয়া হত। দুঃখজনকভাবে আমাদের আজকের প্রশাসন ক্যাডারের প্রশিক্ষনের সময়েও তাদের এভাবেই জ্ঞান দেয়া হয় যে তারা শাসক এবং বাকিরা প্রজা।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া নিপীড়নমূলক জনপ্রশাসনই বহাল থাকে। দেশভাগের পর সিভিল সার্ভিসের ভারত অংশে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থাকলেও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে করা হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস আমলাতন্ত্রের এলিটদেরই প্রতিনিধিত্ব করত এবং পশ্চিম পাকিস্তানিরাই তা দখলে রেখেছিলো । মহকুমা, জেলা ও সচিবালয়ের সর্বোচ্চ পদগুলোতে তারাই নিয়োজিত থাকতেন। রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং সামরিক নেতৃত্ব কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ফলে রাজনীতিকদের ওপর আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রবলতর হয়। আমলাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী আমলাদের জনগণের “মনিব” হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। অথচ ১৯৪৮ সালে জওহরলাল নেহেরু ভারতের আইসিএসদের জনগণের “সেবক” হিসেবে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের পরবর্তীতে পূর্ববাংলার সচিবালয়ের সমস্ত উচ্চপদগুলি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী (এবং ভারত থেকে উদ্বাস্তু অবাঙ্গালীরা) আমলাদের দখলে এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে তাদের ব্যবহার ছিল প্রভূর মত। আমলাদের অধিকারে ছিল পৃষ্টপোষকতার সম্পদ। প্রশাসনের সব কিছুকে সাধারন জনসাধারনের জন্য নিষিদ্ধ এবং সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে গড়ে তুলতে লেগেছিলো তারা। সরকারে আমলাদের প্রভাব এতটাই ছিলো যে অডিট সার্ভিসের ডাকসাইটে আমলা গুলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানের প্রথম অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। একই সার্ভিসের অপর সদস্য চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) সবচেয়ে প্রভাবশালী সচিব হন। পরবর্তী সময়ে এই আমলার জন্য সরকারকে সেক্রেটারি জেনারেলের পদ সৃষ্টি করতে হয়েছিল এবং তার অবসরের পর এই পদটি বিলুপ্তও হয়েছিল। লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার দু বছর পর ১৯৫৩ সালে গুলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলী হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
বাঙ্গালির জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই এই আমলাতন্ত্রের সেচ্ছাচারীতার বিরোধী ছিলেন এবং সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পরিপন্থী মনে করতেন। তার অসমাপ্ত আত্নজীবনীর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়ঃ “আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তাঁর মন্ত্রিত্বে একজন সরকারি আমলাকে গ্রহণ করলেন, এরপর আমলাতন্ত্রের প্রকাশ্য খেলা শুরু হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে। একজন সরকারি কর্মচারী হলেন গভর্নর জেনারেল, আরেকজন হলেন অর্থমন্ত্রী। খাজা সাহেব ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। তিনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন, তবে কর্মক্ষমতা এবং উদ্যোগের অভাব ছিল। ফলে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল। … আমলাতন্ত্রের জোটের কাছে রাজনীতিবিদরা পরাজিত হতে শুরু করল।“
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব বাংলার হাতে গোনা কয়েকজন আমলা বাদে বাকিদের নানাবিধ কীর্তিকলাপ প্রকাশ পায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিলে। স্বাধীন যুদ্ধ বিদ্ধস্থ দেশে সেই পুরোন নিয়ম কানুন আর সেই পুরোন আমলাতন্ত্র দিয়েই প্রশাসন যন্ত্র শুরু হলো। পাকিস্তানের সিএসপি কর্মকর্তাগনই সচিব যুগ্ম সচিব প্রধান প্রকৌশলী ইত্যাদি হয়ে বসলেন। এই লোকগুলি পাকিস্তানের লাহোরে দুই বছর মেয়াদী বুনিয়াদী প্রশিক্ষন সহ এদেশের মানুষকে শোষনের জন্য উচ্চ পর্যায়ে প্রশিক্ষীত ও পাকিস্তানী দেশ প্রেমের দিক্ষায় দিক্ষিত এবং পরীক্ষিত এক এক জন। ১৯৭১ এর জুলাই-আগস্ট মাসে প্রবাসী সরকার পুরোনো ঔপনিবেশিক ধাচেই বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ও সচিবালয় গঠন করে এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের পূর্ববাংলার করাপ্টেড আমলারা যারা কলকাতায় পালিয়ে ছিলেন তাদের নিয়েই তৈরি হয় আমলাতান্ত্রিক সংগঠন। সে সময়ে ৫৮ নং বালিগঞ্জ কলকাতা, মুজিব সরকারের পিঠস্থানে কেতাদুরস্থ হাল ফ্যাশনের জামা পরিহিত ব্রিফফেস কিংবা এ্যাটাচি হাতে পূর্ববাংলার জাদরেল আমলাদের দেখা যেত। পরে জানা যায় সমস্ত ডিস্ট্রিক্ট ও সাব-ডিভিশন থেকে মুক্তিফৌজের সাথে বর্ডার ক্রস করে আসার সময় ব্যাংক ট্রেজারীগুলো সব উজাড় করে নিয়ে এসেছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা। যার ভাগ্যে যতটুকু পরেছে সেগুলো রাখা ছিলো এ সমস্ত ব্রিফকেসে, এট্যাচীতে এবং ঝোলায়। এরই মধ্যে একজন এর ব্রিফকেস খুলে পাওয়া যায় থরে থরে সাজানো পাকিস্তানি ৫০০ টাকার নোটে প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। ওদিকে ব্রিফকেসের মালিক কর্ণেল ওসমানীকে ব্রিফকেস হারানোর অভিযোগ করেন এবং টাকার কথা বেমালুম চেপে গিয়ে শুধু জামা কাপড় আর নথি পত্রের কথা বলেন। টাকা সরিয়ে তার অভিযোগকৃত মালামাল ফেরত দিলে তিনি ফ্যাকাশে মুখে প্রস্থান করেন এবং পুরো ৯মাসের যুদ্ধে তাকে আর একবারো দেখা যায় নি। শুধুমাত্র বগুড়ার ষ্টেট ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছিল ৫৬ কোটি টাকার উপর। এ সমস্ত লুটপাটের সাথে জড়িত ছিলেন আমলাদের একটা অংশ। চিহ্নিত কিছু আমলা তখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিলেন। বাড়ি, গাড়ী, সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন ঐ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিরা। তখন এ বিষয়ে সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর ক্ষোভ সৃষ্টি হলে নেতৃবর্র্গের কথা ছিল অবশ্যই এ সমস্ত অসৎ ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে হবে, কিন্তু সেটা দেয়া হবে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে গণআদালতে। সে কথা মেনে নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে গণআদালত তো দূরের কথা কোন কোর্ট-আদালতেও ঐ সমস্ত অপরাধিদের বিচার হয়নি।
দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও নেতারা তখন লুটপাটের অর্থ খরচ করতেন কলকাতায়। তখন কোলকাতার অভিজাত পাড়াগুলোতে এবং বিশেষ করে পার্ক ষ্ট্রিটের হোটেল, বার এবং রেস্তোরাগুলোতে তাদের বেহিসাবী খরচার জন্য ‘জয় বাংলার শেঠ’ বলে পরিচিত হন। যেখানেই তারা যান মুক্তহস্তে বেশুমার খরচ করতেন। থাকতেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিংবা হোটেলে। সন্ধ্যার পর হোটেল গ্র্যান্ড, প্রিন্সেস, ম্যাগস, ট্রিংকাস, ব্লু ফক্স, মলিন র্যু, হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি বার রেষ্টুরেন্টগুলো জয়বাংলার শেঠদের ভীড়ে জমে উঠত। এরকমই একজন তার পুত্রের প্রথমবারের মত জুতো পরার দিনটি উৎযাপন করার জন্য ব্লু ফক্স রেষ্টুরেন্টে প্রায় ১০০ জনের একটি শানদার পার্টি দেন। এছাড়া অনেক শেঠরা দিল্লী এবং বোম্বেতে গিয়ে বাড়িঘর কিনতে থাকেন। অনেকে আবার ফিল্ম ইন্ডাষ্ট্রিতেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। তাদের এ সমস্ত কির্তিকলাপের ওপর শহীদ জহির রায়হান একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এ অভিপ্রায়ে অনেকেই ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন তার উপর। অনেকে তার এ ঔদ্ধত্ত্বে ক্ষেপেও গিয়েছিলেন। তার রহস্যজনক মৃত্যুর পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে। বগুড়ার ষ্টেট ব্যাংক ছাড়াও মোটা অংকের টাকা নিয়ে আসা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাবনার ট্রেজারি থেকে। সে টাকারও কোন সুষ্ঠ হিসাব পাওয়া যায়নি। যুদ্ধবিদ্ধস্থ বাংলাদেশেও আমলান্ত্র কিভাবে স্বাধীনতার সমস্ত অর্জন নীরবে খেয়ে যাচ্ছিল তার প্রমান পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর দেয়া নানা জনসভায়। ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের শেষ জনসভায় বক্তব্যের একটি অংশ ছিল এরকমঃ
“আমাদের লেখাপড়া শিখায় কে ? আইজ অফিসার বানায় কে ? কার টাকায় ?
-বাংলার দূঃখি জনগনের টাকায়।
আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা। শিক্ষীত ভাইরা এই জনগন আপনার লেখাপড়ার খরচ দিয়েছে শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়। শুধু আপনার ছেলে মেয়ে দেখার জন্য নয়।
দিয়েছে, তাদের আপনি কাজ করবেন সেবা করবেন।
তাদের আপনি কি দিয়েছেন? কি ফেরত দিচ্ছেন ? কতটুকু দিচ্ছেন ?
কার টাকায় অফিসার সাব ? কার টাকায় সচিব সাব ? কার টাকায় মেম্বার সাব ? কার টাকায় সব সাব ?
সমাজ যেন ঘুনে ধরে গেছে এই সমাজকে আমি চরম আঘাত করতে চাই।”
বঙ্গবন্ধু সেই ব্রিটিশ ঔরসের পাকিস্তানী সৈরাচারী মনোভাবের আমলাতন্ত্রকে সমূলে বিনাশ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন যা সফল করার আগেই চক্রান্তকারীদের হাতে তাকে মৃত্যুবরন করতে হয়। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য প্রশাসন ও চাকরি পুনর্গঠন নামে একটি কমিটি গঠন করে। ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো এবং বেসামরিক চাকরির পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের নীতি কী হবে সে ব্যাপারে পরামর্শদানের জন্য এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গঠিত রশিদ কমিশন অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপের সুপারিশ করে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, রশিদ কমিশন অত্যন্ত আলোচিত এবং সবসময়ের জন্য যুৎসই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রস্তাব করে। তা হলো সিনিয়র সার্ভিস পুল (এসএসপি) নামে একটি পৃথক ক্যাডার সৃষ্টি যেখানে উপসচিব পর্যায়ে সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক পরিচালিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হবে এবং তা সব ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সিনিয়র সার্ভিস পুলকে (এসএসপি) একটা পৃথক ক্যাডার হিসেবে গঠনের ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করে এবং ১৯৭৯ সালে সেই বিধি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে। তবে এসএসপিতে রিক্রুটমেন্টের জন্য লিখিত পরীক্ষার পাঠ্যসূচি নিয়ে সরকারি কর্মকমিশনের সঙ্গে একমত হতে সরকারের দীর্ঘ ১০ বছর সময় লেগে যায়। অনেকে মনে করেন, এই কালক্ষেপণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। ১৯৮৯ সালের ১২ জুলাই এসএসপি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এরশাদ শাসনামলে উপজেলা আদালতের বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ’৮৩ সালে ৬৫০ জনের বিশাল একটি ব্যাচ নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের লিখিত পরীক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র এমসিকিউর মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়। নিয়োগের শর্ত ছিল এরা উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেই অবসরে যাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক তদবিরে এ শর্ত প্রত্যাহার করে এদের সিভিল প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় যুক্ত করা হয়। ’৮৩ সালের পর ’৮৪ ব্যাচে ৪৫০ এবং ও ’৮৫ ব্যাচে ৫৫০ জনকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। কাছাকাছি সময়ে উপর্যুপরি তিনটি ব্যাচে অধিক লোক নিয়োগের ফলে সিভিল সার্ভিসে অপেক্ষাকৃত দুর্বলরাও প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যান। ওই সময় নির্বাচন অফিসার ও সেনানিবাসের নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও সিভিল প্রশাসনে আত্মস্থ করার ফলে প্রশাসন নড়বড়ে হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আত্মস্থ হওয়া প্রশিক্ষণবিহীন অফিসারদের পেশাদার মনোবৃত্তির ঘাটতির কারণে প্রশাসন ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে পড়ে। চরম নৈতিক অবক্ষয় যুক্ত আমলাতন্ত্র আর আমলাতন্ত্রের আভ্যন্তরী সংঘাত- ব্যক্তি বা গোষ্টী স্বার্থ টানাপোড়েন ৯০ উত্তর কোন গনতান্ত্রিক সরকার কে একদিকে কখনই জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব কারী সরকার হয়ে উঠতে দেয় নি ; অপর দিকে জাতি কে বারংবার রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিত মধ্যে ঠেলে দিয়ে জাতীয় অগ্রগতি কে বাঁধা গ্রস্ত করেছে। জনগণ রাজনৈতিক দলের উপর বিক্ষুদ্ধ হয়েছে । কিন্তু , অধঃপতনের হোতা আমলাতন্ত্র স্বীয় চরিত্রে স্ব অবস্থানে বহাল তবিয়তে থেকে গেছে।
ক্যাডার সৃষ্টি হওয়ার শুরু থেকে সাবেক সচিবালয় ক্যাডার ও প্রশাসন ক্যাডার সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্যাডার হওয়ায় সচিবালয়ে সরকারের সহকারী সচিব থেকে সচিব এবং সমমর্যাদার প্রায় সবকয়টি পদ একচেটিয়া তাদেরই দখলে। প্রকৃচির (প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসক) আন্দোলনের মুখে সচিবালয়ের এই পদগুলোতে ক্যাডারের রেশিও অনুযায়ী সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন করে উপসচিব থেকে কিছু কিছু করে কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সরকার সিনিয়র সার্ভিস পুল ভেঙে দিয়ে ২০০২ সালে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করে। সেখানে অন্যান্য ক্যাডারের জন্য উপসচিব পদে ২৫% এবং যুগ্মসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে ৩০% পদোন্নতির কোটা রাখা হয়। কোটা পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হলে হাইকোর্ট কোটা পদ্ধতি অবৈধ ঘোষণা করেন। সরকার এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিলের রায়ে উপসচিব পদে ২৫% কোটা বহাল রেখে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি রহিত করা হয়। কর্মকর্তারা বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার অনেক পর তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় আপিল করে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা আপিলের রায় তাদের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য কৌশল অবলম্বন করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
একটি ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে আখ্যায়িত করার অর্থ হলো অন্য কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত নন বা বাকি ২৮টি ক্যাডারে কোনো প্রশাসন এবং প্রশাসনিক কাজ নেই। প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্য ২৮টি ক্যাডার স্ব স্ব কর্মস্থলে অবশ্যই প্রশাসনিক কাজ করে থাকে। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান তার লেখা ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামো : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ (উত্তরণ, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৯) গ্রন্থে বলেন, একটি বিশেষ ক্যাডার সার্ভিস তাকেই বলা হয় যার ল্যাডার থাকে সচিব পর্যন্ত অর্থাৎ একটা বিশেষ ক্যাডারভুক্ত (এনক্যাডারড) সদস্যরাই অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ এবং পদোন্নতির সাহায্যে স্ব স্ব ক্যাডারের ল্যাডার বেয়ে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ধাপ সচিব পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ লাভ করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, যিনি স্বাস্থ্য সার্ভিসের ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন তিনিই অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতি লাভ করে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যন্ত সমুদয় পদে যাওয়ার অধিকারী হবেন। এ কথা সত্য যে, মাঠ পর্যায়ে যিনি যে বিষয়ে কাজ করেন, তার অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে বেশি হবে। মাঠ পর্যায়ে অর্জিত জ্ঞান সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে কাজে লাগানো গেলে প্রশাসনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাজে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থাকার প্রয়োজন বেশি। ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ সম্পর্কে টেকনিক্যাল ধারনাবিহীন একজন যদি ইঞ্জিনিয়ারকে শেখান কি করে তার কাজ করতে হবে কিংবা ডাক্তার কে যদি একজন নন ডাক্তার শেখান কি করে তার কাজ করতে হয় সেটা যেমন অবান্তর তেমনি অপমানজনক। তাই স্ব স্ব পেশার দক্ষ লোকেরাই স্ব স্ব সার্ভিসের প্রশাসনিক কাজে সবচেয়ে উপযুক্ত একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টি করে লাগামহীন ভাবে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। সেই লাগামহীন পদোন্নতির ধরণটি কেমন? অতিরিক্ত সচিবে মোট পদ ১০৮ অথচ পদোন্নতি পেয়েছেন ৪৩৭ জন, যুগ্ম সচিবে মোট পদ ৪৩০ পদোন্নতি ৯৩২, সহকারী সচিবে মোট পদ ৮৩০ পদোন্নতি ১২৮৮। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমডিজি এওয়ার্ড পান, সাউথ সাউথ এওয়ার্ড পান, চ্যাম্পিয়ন্স অফ দা আর্থ এওয়ার্ড পান যা মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও কৃষি সার্ভিসে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের দক্ষতার ফসল অথচ স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা প্রশাসন ক্যাডারের অদক্ষতায় উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়ে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ঘোষিত হয়, বাংলাদেশে আমলাদের সাথে কাজ করা সর্বোচ্চ সময় সাপেক্ষ বলে ঘোষিত হয়।
টেকনিক্যাল ক্যাডারে মেধাবীরা ঢুকে যাওয়ায় এবং সেখান থেকে প্রশাসনে কম সংখ্যক লোক আশায় প্রশাসন ক্যাডার প্রায় মেধাশূন্য। অথচ পাকিস্তানী দূর্নীতির ধারায় চলে আসা সুপিরিয়র কমপ্লেক্সিটি, গ্রান্ডিওজ ডিলিউশনে ভোগা প্রশাসন নিজেদের সর্বোচ্চ মেধাবী দাবী করে সকল ক্যাডারকে বঞ্চিত করতে চায়। বাংলাদেশ সার্ভিস রুল ও সংবিধানের নিয়ম বহির্ভূতভাবে সচিব কমিটি পে স্কেল রিভিউ করে সিনিয়র গ্রেড, টাইম স্কেল বাতিল, গ্রেড -১ ও সুপার গ্রেড বিশেষ ক্যাডারের জন্য সংরক্ষন করে, উপজেলায় অন্য সকল ক্যাডারকে অপমানিত করে বেতন বিলে সাক্ষরের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করতে চায়। সেচ্ছাচারী ও দাম্ভিকতায় ভোগা সুপিরিয়র কমপ্লেক্সিটির এই প্রহসনে বাকি ক্যাডার তো বটেই, প্রশাসন ক্যাডারে থাকা দক্ষ নিষ্ঠাবান অফিসারেরাও জর্জরিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত যা বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন করতে হলে বর্তমান প্রশাসন কাঠামো রেখে তা সম্ভব নয়। ই-গভর্নেন্স এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ ও স্ব স্ব ক্যাডার প্রশাসন সেই ক্যাডারের যোগ্যতমদের হাতে ন্যাস্ত করলে এই আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব।
তথ্যসূত্রঃ
বাংলাপিডিয়া, যায়যায়দিন, কালের কন্ঠ, সমকাল, ঢাকা টাইমস, বংগবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী, প্ল্যাটফর্ম