“অধ্যাপক ডা. এ.কিউ.এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী”
(সাধারণ মানুষের বেশে একজন অনন্য সাধারণ মহামানুষ)
আজও যে প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে-সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না আমি মোটেই। প্ল্যাটফর্ম পত্রিকা’টা আমি আমার স্বপ্নের মানুষ’কে নিজ হাতে দিবো-এটা যে কারো চরম ইচ্ছা হতে পারে। আমারও তেমনটাই ছিল। তাই আগে থেকেই আমি ফাইরুজ’কে বলে রেখেছিলাম। ফাইরুজ জানিয়েছিল- “ভাইয়া, স্যার তো সোমবার ছাড়া কলেজে আসেন না।” আর সেজন্যই, গত ৩টা সোমবার ধরে একটানা অপেক্ষা…
ফাইরুজ ১১টা ৫ মিনিটে এসএমএস করেছে- “ভাইয়া, স্যার আজকে এসেছেন।” আমি হাতে যখন মোবাইলটা নিয়েছি, ঘড়িতে তখন ১১টা ৫১মিনিট। আঙ্গুল কাঁপতে কাঁপতে এসএমএস করলাম- “আমি আসছি!” মুখভর্তি দাঁড়ি, শেষ যে কবে সেভ করেছি-সঠিক মনে নেই। এই দেবদাস লুক নিয়ে যাওয়া যাবে না। যাস্ট ২টা টান দিবো, এমন নিয়তে রেজর হাতে নিয়ে প্রথম টানেই ঘচাং! আমার ম্যান্ডিবলের ডান র্যামাস বরাবর রক্ত। ততক্ষণে বামপাশ সেভ করা শেষ। কোনমতে যে শার্ট’টা হ্যাঙ্গারে ঝুলানো ছিল, সেটা গায়ে দিয়ে ডান চোয়ালে টিস্যু চেপে দৌড়! বাসা থেকে নিচে নেমে রিক্সা বলে ডাক দিতেই একজন প্যাডেল চালক রিক্সাওয়ালা এলেন, কিন্তু আমার দরকার ব্যাটারিচালিত রিক্সা। ফাইরুজ এসএমএস করেছে- স্যারের ক্লাস ১২টা ১০’এ শেষ। তারপর উনি চলে যেতেও পারেন / লাইব্রেরি’তে বসতে পারেন। আপনাকে অবশ্যই ১২টা ১৫’এর মধ্যে পৌঁছাতে হবে। আশেপাশে কোন ব্যাটারিচালিত রিক্স নেই, আমি ঐ রিক্সাওয়ালা মামা’কে বললাম- “মামা, ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে উত্তরা মহিলা মেডিকেল (সেক্টর ১) পৌঁছাতে হবে, পারবেন?” উত্তরঃ “আমরা কি ব্যাটারির চেয়ে কম নাকি? আপনি উঠেন?” একটা কনফিডেন্স নিয়ে চড়ে বসলাম, দোয়া পড়তে পড়তে ফাইরুজকে কল দিলাম, ফাইরুজ বলছেঃ “ভাইয়া, এইমাত্র ক্লাস শেষ হলো। আপনি কতদূর? আমি স্যারের পেছন পেছেন যাচ্ছি, উনাকে ফলো করছি। দেখি উনি কোথায় যান? আপনি আসতে থাকেন…” আমার আশা অনুযায়ী মামা টানতে পারছেন না। কি বা আর বলবো? মানুষ তো… ঘেমে গেছেন উনি, তাই কিছু বলতেও পারছি না। আবার নেমে গেলে যদি উনি কষ্ট পান, তাই রিক্সা পাল্টাতেও পারছি না। পড়েছি উভয় সংকটে… ঃ(
অবশেষে ১২টা৪০মিনিটে আমি কলেজের নিচ তলায় পৌঁছালাম। নিচে এসে দেখি- “লিফট ইজ আউট অফ সার্ভিস!” মুনডা তখন চায়… ফাইরুজের কলঃ “ভাইয়া, আপনি সিঁড়ি দিয়ে উঠেন।” আমি সিঁড়িতে গিয়ে দেখি- ফাইরুজ ওপর থেকে চিল্লাছেঃ “ভাইয়া… আসেন! আসেন!!” মনে হচ্ছে- আশেপাশে তখন আর কেউ নাই, এটা বোধহয় কোন প্রতিষ্ঠান না। আমরাই ২ভাই-বোন হোমলি পরিবেশে চিল্লা-পাল্লা করে লুকোচুরি খেলতেছি। আমি তখন পড়ি কি মরি করে দৌড়… আশেপাশের সব মেয়েরা হা করে তাকায় আছে! কে জুনিয়র আর কে যে টিচার, কিছুই তখন মাথায় নাই, ধাক্কা লাগলেও সরি বলার টাইম নাই। আমি কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে পৌঁছা মাত্রই ফাইরুজ দেখি আমার দৃষ্টির সীমানার ফাঁক কেটে একটা দরজা দিয়ে ঢুকে গেলো। আমিও তার পিছে পিছে দৌড়… দরজায় একজন আয়া ছিলেন, ল্যাপটপ সহ ব্যাগটা ধুম করে ফেলে মাটিতে দিয়ে মাথা তুলে দেখি- ফাইরুজ কথা বলছে আমার সেই স্বপ্নিল ব্যক্তিত্বের সাথে। আমি ধীর পায়ে কাছে এগোতে থাকলাম সেই বরাবর। ফাইরুজ আমাকে হাত ইশারা করে পরিচয় করিয়ে দেবার সাথে সাথে আমিও হাত তুলে সালাম জানালাম, কিন্তু আমার মুখে তখন কোন ভাষা নেই। কি করেই বা থাকবে? আমার রেস্পাইরেটরি রেট তখন নিওন্যাটের মতো ৬০ব্রেথ/মিনিট না হলেও এর কাছাকাছি।
“স্যার, আমি বলি?” প্রথম কথা। স্যার বললেন- “অফকোর্স! কিন্তু, যা বলবে-একটু জোরে বলবে।” আমার তখন টাং আছে, স্যালাইভা নাই অবস্থা। আমি স্যারকে অন্য সব জায়গার মতো কথা গুছিয়ে বলতে পারলাম না! “স্যার, আমরা সকল মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থী ও চিকিৎসক’রা মিলে বাংলাদেশে প্রথম একটি পত্রিকা বের করেছি। তাই, আপনাকে একটি কপি দিতে এসেছি।” স্যার হাত বাড়ালেন পত্রিকাটা নেবার জন্য, কিন্তু দেখি- এখনো আমি সেটার রাবার ব্যান্ড খুলিনি। সাথে সাথে রোল করা পত্রিকাটা দিলাম। উনি হাতে নিয়েই বললেন- “ওয়াও! এক্সিলেন্ট জব ইউ গাইস হ্যাভ ডান। তা, তুমি কি করো?” আমি বললাম- “স্যার, এবার ফাইনাল প্রফ সাপ্লি দিলাম।” স্যার- “এতো অল্প বয়সে তোমরা একটা বিরাট কাজ করেছো।” স্যারের সাথে একজন কাস্মিরি শিক্ষার্থী/ ইন্টার্ণ বসা ছিল, সে তখন বিদায় নিয়ে চলে গেল। তৎক্ষণাত দেখি- আরেকজনজন হিজাব পরিহিতা ম্যাডাম এসে হাজির। উনি স্যারকে তাঁর মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছেন। পরে শুনলাম- উনি এখানকার গাইনি বিভাগের এসিস্টেন্ড প্রফেসর। বিয়ের “কন্যা” এবার ফাইনাল প্রফ দিয়েছে শুনেই ফাইরুজ আমার কানের কাছে এসে বলছে- “দেখছেন ভাইয়া, দেখছেন! আপনার চেয়ে কত ছোট হয়ে বিয়ে করে ফেললো। আর আপনি?” উত্তরঃ “আপু, আমি একটু পানি খাবো।” ফাইরুজ হতবাক হয়ে লাইব্রেরির মধ্যে ছোটাছুটি করতে লাগলো। আমিঃ “থামো! থামো!! পরে…”
বিয়ের দাওয়াত ছিল- ফ্যালকন হল’এ। স্যার বললেনঃ “এটা আর্মি’দের না?” আমি উনাদের মাঝে নাক বাড়িয়ে বললামঃ “স্যার, বিমান বাহিনী’র।” উনি হয়তো মনে কষ্ট নিয়েই বললেনঃ “ওরা (আর্মি) আমাকে ওদের ওখানে যেতে দেয় না! আবার স্বসশ্রবাহিনী দিবসে এসে ওরাই আমাকে দাওয়াত করে যায়। আমার নাম নাকি লিস্টে আছে, ভেরি ফানি! না?” শুনতে খুবই খারাপ লাগছিল। যেখানে আমেরিকার সকল সাবেক রাষ্ট্রপতি’কে সারাজীবন “প্রেসিডেন্ট” বলেই ডাকা হয়, আর আমাদের দেশের একমাত্র ডাক্তার রাষ্ট্রপতি’কে অভিশংসন করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। আফসোস! আমরা যে কবে গুনীদের সম্মান করা শিখবো… যাইহোক, স্যার “জামাই” কি করেন- সেই খবর নিলেন। ম্যাডাম প্রস্থান করার পর ফাইরুজ আমাকে গুতাচ্ছেঃ “ভাইয়া, আপনি গিয়ে স্যারের পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। আমি আপনার ছবি তুলে দিচ্ছি।” স্যার আমাদের নড়ানড়ি লক্ষ্য করে আমাকে বললেন- “তুমি দাঁড়িয়ে কেন? এসো… এখানে এসে আমার পাশে বসো।” বলেই উনি নিজ হাতে চেয়ার ঠিক করে দিচ্ছিলেন। আমি উনাকে অবলোকন করছিলামঃ “ভদ্রতা, বিনয়-এসব গুণগুলো মানুষের গায়ে লিখা থাকে না। সাদা-শুভ্র, বেশ স্টাইলিস, পরিপাটি একটা পোশাকে উনাকে অনেক তরুণ আর পবিত্র লাগছে। উনি যেন আমাদের চারপাশ আলোকিত করে রেখেছেন।” সবসময় মোহিব বলে- “কিরণ ভাই আলো ছড়ায়!” ভাবছি- “আজ, ও থাকলে বুঝতো- একজন মানুষ কিভাবে আলো দেয়…” “কিভাবে মানুষ এতো বড় হয়, মহামনব হয়ে ওঠে স্বীয় কর্মগুণে”- সেটাই অণুধাবন করার চেষ্টা করছিলাম।
আমি এখন পর্যন্ত অন্ততঃপক্ষে ৬০জন অধ্যাপক / সহযোগী অধ্যাপক / সহকারী অধ্যাপক-কে পত্রিকা দিয়েছি, কিন্তু উনিই হলেন একমাত্র ব্যক্তি- যিনি আমার সামনে প্রতিটা পাতা উল্টিয়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সবগুলো লিখার টাইটেল পড়লেন। কিছু কিছু লিখা পেন্সিল দিয়ে টিক মার্ক দিয়ে রাখলেন- পরে পড়বেন বলে। ফাইরুজ আর আমার লিখা’টাও ছিল তারমধ্যে। আমি কথা বলতে বলতে স্যারের বেশ কাছে গিয়ে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম- “স্যার, একটা কথা বলি স্যার? স্যার, যদি কিছু কিছু মনে না করেন স্যার… একটা রিকোয়েস্ট ছিল স্যার। আপনার সাথে যদি একটা ছবি তোলার অনুমতি পেতাম?” হা হা হা করে হাসি দিয়ে বললেন- “সিওর! সিওর!! ২দিন পরে ডাক্তার হচ্ছো আর তোমার রিকোয়েস্ট রাখবো না, তা কি করে হয়?” বলেই স্যার নিজে হাতে আমার চেয়ার টানা শুরু করলেন। ঠিক ঐ মুহুর্তে আমার কি করণীয়, জানা ছিল না। একপাশে ছবি ডার্ক আসছে বলে উনি নিজে উঠে আমার সাইডে এসে চেয়ার পেতে বসলেন। ফটোগ্রাফার ফাইরুজ বলছিল- “ভাইয়া, আপনিও হাসেন স্যারের মতো।” স্যার সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়েঃ “কি ব্যাপার? তুমি হাসছো না কেন?” আমার গায়ের সাথে একেবারে গা লাগিয়ে উনি ক্যামেরার দিয়ে তাকিয়ে নিজেই বলছেন- “চিচিচিচিজ!” আমি তো ‘থ’বনে গেলাম স্যারের অন্তরঙ্গতা দেখে। স্যার আবার নিজে আমার মোবাইলে দেখলেন- ছবিটা কেমন হয়েছে। উনি তখন পকেট থেকে নতুন কচকচা ১০০টাকার নোটের ২টা নোট আমাকে দিয়ে বললেনঃ “এখন থেকেই শুরু হোক তোমার আয়…” আমি আগে থেকেই গল্প শুনেছিলাম- স্যার প্রতিদিন তাঁর ক্লাসে যে এম.সি.কিউ. পরীক্ষা নেন, তাতে উনি মেধানুসারে নতুন টাকার নোট উপহার দেন। কিন্তু আমিও যে কোনদিন তা পাবো, স্বপ্নেও ভাবিনি। স্যার বলেন- “এটা কিন্তু সন্মানি না, এটা হলো ইন্সপাইরেসন!” ভাবছিলাম যে- “এমনি এমনিতেই তো উনি আর সমগ্র(তদানিন্তন পূর্ব ও পশ্চিম মিলে) পাকিস্তানে ২য় স্থান অধিকার করেন নাই। মানুষ হিসেবেই শুধু বিশাল মাপের নন তিনি, অনেক বড় মানের শিক্ষকও উনি। শুনেছি- উনি নাকি ওয়ার্ড থেকে ক্লিনিক্যাল / একাডেমিক কোন কেস পছন্দ হলে লেকচার গ্যালারি’তে নিয়ে আসেন।” আমার খুব ইচ্ছা ফাইরুজ / ঐ কলেজের অন্য যে কেউ প্ল্যাটফর্মের “এ+ টিচার” কলামে উনার সম্পর্কে লিখবে, তাহলে আরো জানতে পারবো।
লাইব্রেরি’তে অনেকেই উকি দিয়ে আমাদের দেখার চেষ্টা করছিল। যাইহোক; আমি যাবার আগে থেকেই স্যার কোন এক জরুরী কাজ করছিলেন, সেটাই করতে থাকলেন। আমরা ২জন সালাম দিয়ে প্রস্থান করলাম। রুম থেকে বের হবার সাথে সাথে এক লাফ দিয়ে আমি বললামঃ “ফাইরুজ! আমার একখান কি-বোর্ড লাগবে, আমি এখনই প্ল্যাটফর্মে লিখবো।” ফাইরুজ বলছেঃ “ভাইয়া, চলেন! আমি আজকে আপনাকে ক্যাফে-ডি-মেডিকোসে খাওয়াবো।” একটু পরপর সে বলছে- “ভাইয়া, আজকে তো আপনারই দিন। পত্রিকা দিলেন+ছবি তুলেলেন+টাকাও পেলেন।” বেচারি অবশ্য আমার জন্য অনেক করেছে, ধণ্যবাদ দিয়ে ছোট করা যাবে না। সে সার্জারি ক্লাস বাং দিয়েছে আমার জন্য। ও আমাকে কি ভেবেছে- জানিনা। আজকে উচিৎ ছিল- স্যারের দেয়া টাকাটা ওকে দেয়া, কিন্তু আমি ইচ্ছা করে দেইনি। কারণ ঐ নোট ২টা আমি সংগ্রহে রাখবো। তাই, ওকে দেই নাই। আল্লাহ তৌফিক দিলে ওকে একদিন খাইয়ে দিবো-কথা দিলাম। ফাইরুজ ক্যাফেটেরিয়ায় আসা মাত্রই পাফিন পাফিন করছে। “ভাইয়া, ওকে একটা কল দেই?” আমি বললামঃ “দিতে পারো, দেখো আবার কারো অসুবিধা কইরো না।” কিন্তু, পরীক্ষা বলে পাফিন আসলো না। আমরা ২জন মিলে কিছুক্ষণ কচ্ছপ, হিমু আর রীহানের গল্প করলাম। ফাইরুজ আমাকে কোক পান করালো। আমি বললামঃ “জানো, আমার তো এক্ষুণি ইচ্ছা করছেঃ এই ছবিটা প্রোফাইল পিকচার দিয়ে ক্যাপশন দেই- আমার জীবনের অন্যতম সেরা ছবি / এই বসের জন্য কয়টা লাইক?” (যদিও আমি নিজের ছবির জন্য কোনদিন কারো কাছে লাইক ভিক্ষা করি না)
প্রতিবেদক- ডাঃ আহমেদুল হক কিরণ
লেখাটা পড়ার সময়ে , সেই দিনের ঘটনাগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে 😀 সেইদিনের এই দিনটা আমার জন্যও অনেক স্পেশাল ছিল 🙂
সবশেষে বিশেষ ধন্যবাদ কিরণভাইকে , এতো সুন্দর করে সেই দিনের প্রতিটি ঘটনাকে কালো অক্ষরের মাঝে বন্দী করেছেন বলে 🙂