বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বা একাডেমিশিয়ানদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা গবেষণা করেন, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন, সেগুলো প্রকাশ করেন এবং শিক্ষার্থীদের শেখান। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মাধ্যমে শুধু উচ্চতর ডিগ্রিই দেওয়া হয় না, বরং রাষ্ট্রে সেবা প্রদানসহ সমাজের নানা সমস্যার সমাধান করা হয়। গবেষণায় সৃষ্ট ফলাফল প্রকাশ এবং পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের বিজ্ঞানীদের মধ্যে যোগাযোগের কার্যকরী মাধ্যম হলো গবেষণা প্রবন্ধ বা জার্নাল আর্টিক্যাল। ইন্টারনেটের আবির্ভাবের আগে একাডেমিশিয়ানরা জার্নাল আর্টিক্যাল লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করতেন। গত কয়েক দশকে বাণিজ্যিক প্রকাশকরা (যেমন এলসভিয়ার, উইলি, স্প্রিনজার ইত্যাদি) জার্নালের চড়া মূল্য নির্ধারণ করায় একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ও লাইব্রেরিগুলো জার্নাল ক্রয় কমিয়ে দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী একাডেমিশিয়ান ও গবেষকদের নতুন জ্ঞানসমৃদ্ধ জার্নাল আর্টিক্যালে প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে গত দশকে বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রবেশাধিকার বাড়ানোর জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক ওপেন অ্যাকসেস (মুক্ত প্রবেশাধিকারবিশিষ্ট) জার্নালের নতুন ধারা সূচিত হয়েছে। ওপেন অ্যাকসেস জার্নালে পৃথিবীর সব স্থান থেকে যে-কেউ প্রবেশ করতে পারে। এসব জার্নালের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো পাবলিক ইন্টারনেট সার্চে সহজলভ্য ও প্রিন্টযোগ্য। এক্ষেত্রে কোনো আর্থিক, আইনগত বা কারিগরি বাধা থাকে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওপেন অ্যাকসেস জার্নাল ক্লোজড (সীমিত প্রবেশাধিকারবিশিষ্ট) জার্নালের তুলনায় অনেক বেশি পঠিত হয় এবং ২৫ থেকে ২৫০ শতাংশ বেশি সাইট বা উদ্ধৃত হয়।
জার্নাল ওপেন বা ক্লোজ যা-ই হোক না কেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গুণগত মানের জার্নালগুলোর প্রকারভেদ রয়েছে। প্রথম প্রকারের জার্নালগুলো (আইএসআই) থম্পসন রয়টারের অধীনে তালিকাভুক্ত থাকে, যেগুলো সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। দ্বিতীয় প্রকারের জার্নাল স্কপাসের অধীনে তালিকাভুক্ত হয়, যেগুলো কঠোর পিয়ার রিভিউর (যৌথ মূল্যায়ন) মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ফলে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থাকে। তৃতীয় প্রকারের জর্নালগুলো ভালোভাবে পিয়ার রিভিউ হয়; কিন্তু স্কপাসের অধীনে তালিকাবদ্ধ নয়। জার্নালগুলো মোটামুটি মানসম্পন্ন এবং সম্পাদক পরিষদ এগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে স্কপাসে যুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
ওপেন অ্যাকসেস গুণগত মানের জার্নাল প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রিডেটরি জার্নাল’ বা শিকারি জার্নাল নামের এক ধরনের ওপেন অ্যাকসেস জার্নালের আবির্ভাব ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী এগুলোর বৃদ্ধি ও ব্যাপকতা গবেষণার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গুণগত মানকে মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান জিফারি বিল অনৈতিক জার্নালকে প্রিডেটরি জার্নাল হিসেবে অভিহিত করেন এবং বিশ্বব্যাপী প্রিডেটরি জার্নালের একটি তালিকা করেন।
এই তালিকা https://beallslist.weebly.com সাইটে দেওয়া আছে।
বিলের গবেষণা অনুযায়ী প্রিডেটরি জার্নাল প্রকাশকের সংখ্যাই প্রায় ২ হাজার ৫০০। প্রিডটরি জার্নালের সঠিক তালিকা তৈরি করা একটি কঠিন কাজ হলেও কোনো কোনো সূত্রের সংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি বলে দাবি করেছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে প্রিডেটরি জার্নাল বিশ্বব্যাপী ৭৪ মিলিয়ন ডলারের অনৈতিক ব্যবসা করেছে। বিলের গবেষণা অনুযায়ী, প্রিডেটরি জার্নালের বৈশিষ্ট্য হলোঃ
১. প্রিডেটরি জার্নালের এডিটরিয়াল বোর্ড বা সম্পাদনা পরিষদ থাকে না বা থাকলেও সেটি ভুয়া
২. অনেক স্বীকৃত পরিচিত জার্নালের নাম বা ওয়েবসাইট নকল বা অনুকরণ করে জার্নালের নামকরণ করে, যাতে একাডেমিশিয়ানরা সহজেই আকৃষ্ট হন;
৩. একাডেমিশিয়ানদের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ ছাড়াই সম্পাদক জার্নালের সম্পাদনা পরিষদে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করে; ৪. জার্নালের ভুয়া ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর থাকে;
৫. আর্টিক্যাল দ্রুত রিভিউ হয় এবং জমা দেওয়ার ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রকাশিত হয়;
৬. আর্টিক্যালগুলোয় লেখকদের কোনোরকম ভৌগোলিক বৈচিত্র্য নেই, শুধু নির্দিষ্ট অঞ্চলের লেখকরাই আর্টিক্যালের রচয়িতা হন;
৭. আর্টিক্যাল কপি-প্রুফ ফর্মে প্রকাশিত হয়, ফলে প্লাজিয়ারিজম বা নকলকৃত কি না, তা শনাক্তকরণ যন্ত্র বা সফটওয়্যারে ধরা পড়ে না;
৮. জার্নালের ডিজিটাল সংস্করণের কোনো পদ্ধতি অর্থাৎ ডিওআই (ডিজিটাল অবজেক্ট আইডেন্টিফায়ার) নম্বর থাকে না এবং
৯. প্রকাশনার খরচ হিসেবে প্রিডেটরি জার্নালগুলো লেখকের কাছ থেকে শত শত ডলার হাতিয়ে নেয়।
প্রিডেটরি জার্নালের বেশিরভাগ লেখকই হচ্ছেন উন্নয়নশীল দেশের। এগুলোর প্রকাশকও সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে। আফ্রিকা বা এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমনÑ নাইজেরিয়া, ভারত ও পাকিস্তানে অনেক প্রিডেটরি জার্নাল রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রিডেটরি জার্নালের প্রধান শিকার হচ্ছেন জীব, পরিবেশ, চিকিৎসা ও কৃষিবিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও গবেষকরা। বাংলাদেশসহ উন্নয়শীল দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিডেটরি জার্নালের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় গবেষকসমাজ বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রিডেটরি জার্নাল স্বীকৃত সম্পাদনা পরিষদ ছাড়া কোনোরকম রিভিউ না করে প্রকাশিত হওয়ার কারণে বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ চর্চা, নৈতিকতা বা ন্যায়পরায়ণতা বিনষ্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জার্নালের প্রকারভেদ, প্রিডেটরি জার্নালের বৈশিষ্ট্য, এগুলো শনাক্তকরণ, গ্রহণ ও বর্জন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোনো নীতিমালা নেই। নবীন শিক্ষকদের পেশাগত পদোন্নতির জন্য তাদের গবেষণা প্রবন্ধ স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ করতে হয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বীকৃত জার্নালের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা তালিকা না থাকায় শিক্ষকদের পদোন্নতির বাছাই বা মূল্যায়ন কমিটির বিশেষজ্ঞরা প্রিডেটরি জার্নাল আর্টিক্যাল শনাক্ত ও বাতিল করতে পারেন না। ফলে পদোন্নতি প্রার্থী শিক্ষকরা প্রিডেটরি জার্নালের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার মতো কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেন না, বরং পরবর্তী পদোন্নতির জন্য ক্রমাগত প্রিডেটরি জার্নালেই আর্টিক্যাল প্রকাশ করতে থাকেন। এতে শিক্ষকরা তাদের অজান্তেই সুদীর্ঘ গবেষণাজীবনের ক্ষতি করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির সঙ্গে শিক্ষক ও গবেষকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষক ও গবেষকরা হাজার রকমের প্রিডেটরি জার্নালের শিকার হচ্ছেন এবং তাদের বায়োডাটায় প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত আর্টিক্যাল তালিকাভুক্ত করছেন। এতে বিদেশে উচ্চশিক্ষার (যেমন মাস্টার্স, পিএইচডি) স্কলারশিপের জন্য আবেদনকালে প্রার্থীর স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রিসার্চ সুপারভাইজার বা প্রফেসর প্রার্থীর গবেষণার যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন এবং আবেদনটি বাতিল করে দেন। প্রার্থীর বাংলাদেশের শিক্ষক বা মাস্টার্স সুপারভাইজার তথা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বিদেশি প্রফেসরের মনে একধরনের নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদনের সময় বায়োডাটায় প্রিডেটরি জার্নাল আর্টিক্যাল উল্লেখ থাকলে আবেদনপত্রটি প্রথমেই বাতিল হয়ে যায়। সেজন্য বাংলাদেশে প্রিডেটরি জার্নালের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রিডেটরি জার্নালের শিকার থেকে মুক্ত থাকার প্রধান উপায় হচ্ছে একাডেমিশিয়ান সমাজ কর্তৃক এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সামষ্টিক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত নিয়মিত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত গবেষকদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করতে হবে। বিশেষজ্ঞ টিম জিফারি বিলের তালিকার ওপর ভিত্তি করে প্রিডেটরি জার্নালের একটি তালিকা তৈরি করবে এবং শিক্ষক ও গবেষকরা কোন কোন জার্নালে তাদের আর্টিক্যাল প্রকাশ করতে পারবেন, তারও একটি তালিকা তৈরি করবে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে জার্নালগুলো রয়েছে, সেগুলোর সম্পাদনা পরিষদের সদস্যদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং তাদের কার্যকরী ভূমিকা মূল্যায়ন করে একটি তালিকা তৈরি করবেন।
এগুলোর গুণগত মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের না হলেও অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদনা পরিষদ অভিজ্ঞ ও দক্ষ হওয়ার কারণে আপাতত স্থানীয় একটি তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে।
নবীন শিক্ষক ও গবেষক, যারা অতি উচ্চমানের আন্তর্জাতিক জার্নালে আর্টিক্যাল প্রকাশ করতে সক্ষম নন, তাদের জন্য স্থানীয়ভাবে নির্ধারিত গুণগত মানের জার্নালের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানের আর্টিক্যাল লেখার ক্ষেত্রে দক্ষ কনসালট্যান্টদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ইংরেজির দুর্বলতা দূরীকরণে ইংলিশ এডিটিং সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে হবে। মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সায়েন্টিফিক লেখনীর জন্য শিক্ষক ও পিএইচডি ছাত্রদের প্রশিক্ষণ এবং ইংলিশ এডিটিং সার্ভিসের ব্যবস্থা রয়েছে। যদি কোনো পিএইচডি ছাত্র তার গবেষণা থেকে কমপক্ষে দুটি আর্টিক্যাল পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশ করতে না পারে, তাহলে তার ডিগ্রি সম্পন্ন হয় না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও গবেষক পিয়ার রিভিউড জার্নালে আর্টিক্যাল প্রকাশ করতে না পারলে তাদের পদোন্নতি হয় না, বরং পিয়ার রিভিউড জার্নাল আর্টিক্যাল প্রকাশ করার জন্য তাদের পদোন্নতির পাশাপাশি ইনক্রিমেন্ট বা বিশেষ আর্থিক পুরস্কার দেওয়া হয়। এ রকম পদ্ধতি উন্নয়নশীল দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত আছে। চীন ও কাতারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়ার রিভিউড জার্নালের একটি আর্টিক্যাল প্রকাশের জন্য ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর অনুযায়ী শিক্ষক ও গবেষককে কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হয়। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য প্রিডেটরি জার্নাল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গবেষকদের সায়েন্টিফিক লেখনীর ওপর আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ, পুরস্কার ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচক টেকসইকরণে গুণগত মানের গবেষণা ও শিক্ষার বিকল্প নেই।
লিখেছেন : ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক রিপন, প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধান, অ্যাকোয়াকালচার বিভাগ-বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ