লেখকঃ ডাঃ অনির্বাণ সরকার
সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে যেসব চিকিৎসক যোগদান করেছেন, তাদের জন্য কয়েকটি কথা লিখছি। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আপনাদের প্রথম পোস্টিং হবে বিভিন্ন জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিংবা ইউনিয়ন সাবসেন্টারে। আপনার অভিজ্ঞতা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করবে, এটা ঠিক, তবে কিনা মায়ের পেট থেকেই তো আর সবাই সব কিছু শিখে আসেনা! বিশেষ করে assault-এর রোগীদের ক্ষেত্রে আপনার করণীয় কি, সেটি জানা জরুরী। আমি কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি নই, আমার তিন বছরের সরকারী চাকরীর অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা বলছি মাত্র।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন আউটডোরে রোগী দেখা ছাড়াও আপনাকে রোস্টার ডিউটি করতে হবে। সাধারণত টানা ২৪ ঘন্টা আপনি থাকবেন ইমার্জেন্সি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার।
*সরকারী সেলফোনের ব্যাপারে পরামর্শঃ
সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সেলফোন দিয়েছেন, যেটি ডাক্তারদের কাছেই থাকে। কখনো আপনাকে জরুরী বিভাগে যেতে হবে, কখনো ইনডোরে খারাপ রোগী দেখতে যেতে হবে। এখন এই সেলফোনের ব্যাপারে কয়েকটি টিপস দিচ্ছি-
১) সরকারী সেলফোনকে জনগণের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করুন।
২) এই সেলফোন দিয়ে পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের সাথে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। কারণ, প্রতি মাসের জন্য সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিলের টাকা এই ফোনের পোস্টপেইড সিমের জন্য বরাদ্দ রাখেন (সম্ভবত ১০০০/- টাকা) এবং ক্রেডিট লিমিট অতিক্রম করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। তাই এই ফোন দিয়ে খেজুরে আলাপ নয়। কোনো কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে এবং তদন্ত হলে আপনি ফেঁসে যেতে পারেন।
৩) এই ফোনে কল করে আপনাকে ইনডোর থেকে সিস্টার যেমন ডাকবেন, তেমনি ইমার্জেন্সি থেকে ডাকবেন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট কিংবা ওয়ার্ড বয়। যেহেতু তারা তাদের ব্যক্তিগত ফোন থেকেই কল করবেন, আপনার দায়িত্ব হবে কলটি কেটে দিয়ে কলব্যাক করা এবং প্রয়োজন অনুসারে পরামর্শ দেয়া কিংবা ইনডোর/ ইমার্জেন্সিতে উপস্থিত হওয়া।
৪) সরকারী সেলফোনে সাপ খেলে, সুডোকো খেলে এর চার্জ শেষ না করাই ভালো। কারণ, উপজেলায় ইলেকট্রিসিটির আসা-যাওয়ার মা-বাপ নেই, চার্জ শেষ হয়ে গেলে আপনারই সমস্যা হবে। সেলফোনের পর্যাপ্ত চার্জ নিশ্চিত করুন। প্রয়োজনে এই সেটটির জন্যই একটি ভালো চার্জার কিনে নিন, যেটি আপনার কাছেই থাকবে।
৫) যদিও এই নম্বরে উপজেলার বাসিন্দারা ফোন করে পরামর্শ নিতে পারেন, এবং এ সংক্রান্ত নোটিশও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেয়া আছে, প্রচারণার অভাবে অনেকেই এটি জানেন না। আপনার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতি মাসেই নানাধরনের ট্রেনিং নিতে মাঠকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, সিএইচসিপিরা আসেন। আপনি তাদের এই তথ্যটি দিন। তাদের মাধ্যমে এই নম্বরের ব্যাপারে উপজেলার লোকজন জানতে পারবেন।
৬) ঢাকার ডিজি হেলথ অফিস, সিভিল সার্জন অফিস কিংবা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অফিস থেকে কোনো তথ্যের জন্য সাধারণত এই ফোনেই কল করা হয়ে থাকে। ডিউটিরত অবস্থায় এমন কোনো কল এই ফোনে এলে বিনীতভাবে কথা বলুন এবং গুরুত্ব দিয়ে তথ্য সরবরাহ করুন কিংবা নির্দেশ পালন করুন।
৭) সরকারী সেল ফোনে দিয়ে কথা বলে আপনার অফিসের কোনো কর্মকর্তা, স্টাফের সম্পর্কে নিন্দাবাদ করবেন না। এসব কথা রেকর্ড হয়ে থাকলে তা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আপনার ব্যক্তিগত ফোন দিয়েও এমন ধরণের কথা না বলাই ভালো।
*মারামারির রোগী!!!!
এবার assault-এর রোগীদের সম্পর্কে দু-চার কথা বলি। আপনার ফরেনসিক মেডিসিনের বই/ নোট যা আছে, কাছে রাখুন। Wound চ্যাপ্টারটি কয়েকবার পড়ে নিন। আপনি ২৪ ঘন্টা ডিউটি করছেন ঠিক, ২৪ ঘন্টাই তো আর ইমার্জেন্সিতে থাকবেন না! আপনার খাওয়াদাওয়া-গোসল-প্রাকৃতিক কর্মাদি আছে। বাসায় গেলে এমন ফোন যদি পান- “স্যার/ম্যাডাম! মারামারির রুগি আইসে!’’- তাহলে বুঝবেন এটিই assault-এর রোগী। এরপর আপনার করণীয়-
১) বিলম্ব না করে ইমার্জেন্সিতে যান।
২) একাধিক রোগী আসলে তুলনামূলক খারাপ রোগী আগে দেখুন।
৩) রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু করুন। প্রয়োজনে অন্য ডাক্তার ডাকুন।
৪) Assault-এর খাতা, যা সাধারণভাবে ‘মারামারির খাতা’ হিসেবে পরিচিত, তাতে লিখুন। এখন কথা হচ্ছে- এতে কি লিখবেন? এই তথ্যগুলো খাতায় থাকতে হবে-
ক) রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তারিখ, রোগী ইমার্জেন্সিতে আসার সময়, রোগী বা তার সাথের লোকের বলা আঘাতের সম্ভাব্য সময়।
খ) রোগীর নাম, পূর্ণ ঠিকানা।
গ) সনাক্তকারীর নাম, ঠিকানা, রোগীর সাথে সম্পর্ক। রোগীর সাথে যিনি আসবেন, তিনিই সনাক্তকারী। একাধিক এটেন্ডেন্ট থাকলে সবচেয়ে কাছের সম্পর্কের ব্যাক্তির নাম লিখুন। এটি বিবেচনা করে লিখবেন। যেমন রোগীর বউ উপস্থিত থাকলে খালুর নাম কিংবা বাপ উপস্থিত থাকলে চাচাতো প্রতিবেশীর নাম না লেখাই ভালো।
ঘ) ক থেকে গ পর্যন্ত লেখার ক্ষেত্রে মেডিকেল এসিস্ট্যান্টের সহায়তা নিতে পারেন, তবে বাকিটুকু আপনিই লিখবেন। এবার লিখতে হবে এমন একটি হেডিং- History of assault কিংবা History of physical assault. এর নিচে পয়েন্ট আকারে আঘাতের বর্ণনা লিখবেন, এবং অবশ্যই medico-legal term ব্যবহার করে। কোনটা কি ধরণের আঘাত, এ ব্যাপারে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। Abrasion, Bruise, Laceration, Incised wound, Incised-looking wound, Punctured wound কোনটা কি- প্যাঁচ যেন না লাগে। প্রতিটি আঘাতের থ্রি-ডি পরিমাপ উল্লেখ করুন যতদূর সম্ভব। অনেকেই এভাবে লেখেন (উদাহরণ)- An incised looking wound on the right parietal region of the scalp measuring about 3cmx2cmx1cm. এটি ভুল নয়, তবে Length, Breadth, Depth-এই শব্দগুলো ব্যবহার করে একটু Narrative style-এ লেখা ভালো। লাঠি দিয়ে, রুলার দিয়ে আঘাতে parallel bruise পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে railway-line type bruise বা tram-line type bruise অভিধাটি ব্যবহার করুন।
ঙ) Remark-এর ঘরে লিখবেন রোগী admit করেছেন, না refer করেছেন, না চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন (treatment given)। এছাড়া রোগীকে কোনো Investigation দিলে সেটিও উল্লেখ করুন। সাধারণত এক্সরেই দেয়া হয়ে থাকে, তবে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ultrasonogram for pregnancy profile দিতে ভুলবেন না, সেটি আঘাত যেখানেই থাকুক না কেন। কারণ তলপেটে সরাসরি আঘাত ছাড়াও আঘাতের সময় গর্ভবতী মহিলাটি পড়ে গেলে বা ধস্তাধস্তির সময় বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। রোগী বাড়িতেই যান বা হাসপাতালেই ভর্তি হোন, তাদের বলুন Investigation-এর রিপোর্টের ফটোকপি ইমার্জেন্সিতে জমা দিতে। আপনি এক্সরে প্লেট দেখে ডায়াগনসিস করতে পারলেও একজন রেডিওলোজিস্টের স্বাক্ষরিত রিপোর্ট জমা দিতে বলুন। মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্টকে বলুন একটি ফাইল তৈরি করতে। তিনি রিপোর্টের ফটোকপি পেলে খাতা খুলে তারিখ দিয়ে ঐ এন্ট্রিতেই এমন লিখে রাখবেন- x-ray report submitted. তারপর তিনি রিপোর্টের ফটোকপিটি ঐ ফাইলে সংরক্ষণ করবেন। পরে আপনার কাছে Injury Certificate (প্রচলিত ভাষায় এমসি- medical certificate)-এর জন্য পুলিশ বা কোর্টের কাছ থেকে অনুরোধ/আদেশ এলে ঐ রিপোর্টের ফটোকপি আপনার কাজে লাগবে। Remark লেখা শেষ হলে স্বাক্ষর ও তারিখ দিন।
(বিঃদ্রঃ অনেক উপজেলায় এমনকি ‘মারামারির খাতা’ও আলাদা নয়, রিপোর্টের ফাইল বানানো তো দূরের কথা। ‘মারামারির খাতা’ অবশ্যই একটি গোপনীয় খাতা, এমনটি না থাকলে আপনি নিজ উদ্যোগে কর্তৃপক্ষকে বলে খাতা আলাদা করুন। রিপোর্টের ফাইলও বানাতে বলুন। আমি এটি করতে পেরেছি। আপনিও পারবেন।)
*‘মারামারির খাতা’র ব্যাপারে কয়েকটি সতর্কতাঃ
১) এই খাতার গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
২) মেডিকেল এসিস্ট্যান্টকে বলুন কেউ খাতা দেখতে চাইলে সেটি না দেখাতে। রোগীর লোকও এটি দেখতে পারে না। যদি ঘাউরা নেতা-ফেতা, পুলিশ এসে জোর করে- তাহলে যেন ইমার্জেন্সি ডাক্তারকে তিনি ডাকেন। ডাক্তার এসে খাতা দেখানোর ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করবেন। যদি আপনার আরএমও বা অন্য কোনো সিনিয়র ডাক্তার খাতা দেখিয়ে দিতে বলেন, তাহলে তিনি এমন বলেছেন, সেটির রেকর্ড রাখুন। এটি কিভাবে করবেন, আপনি নিজেই বুঝে নিন। যেমন- আমার এক সিনিয়র ডাক্তার এক নেতাকে খাতা দেখানোর ব্যাপারে আমাকে অনুরোধ করার পর আমি তার ভয়েস রেকর্ড করে রেখেছিলাম। আমি বাধ্য হয়েছি এটা করতে, তবে খাতা দেখিয়েছি আমার উপস্থিতিতে। এ ধরণের সতর্কতা জরুরী, কারণ, আপনার লেখার ওপর কোনো কাবিল ওভাররাইটিং করে রাখলে আপনার বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
৩) আদালত থেকে অনেক সময় খাতার বিশেষ এন্ট্রির ফটোকপি চাওয়া হয়। বিলম্ব না করে আদালতের নির্দেশ পালন করুন।
(আবারও বিঃদ্রঃ- লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে বলে আজ এখানেই শেষ করছি। এই লেখায় যা ভুলভ্রান্তি আছে- সব আমার ব্যর্থতা। সিনিয়র, জুনিয়র সবাইকে বলছি আমার ভুল হলে আমাকে ধরিয়ে দিন। আমি সংশোধনের চেষ্টা করবো। পরবর্তীতে সময় পেলে কয়েকটি বিষয় নিয়ে লিখবো। যেমন- Injury Certificate-এ কি লিখবেন, কিভাবে লিখবেন, ঘাউরা পার্টি কিভাবে ম্যানেজ করবেন ইত্যাদি। সবাই ভালো থাকুন।)
Nice interesting helpful post….. More information are needed as soon as possible.
thanx vaiya