প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৩ জুন ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. সুমন হুসাইন, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এবারই এমবিবিএস পাস করেছেন। করোনাকালে যেচে পড়ে হাসপাতালে ডিউটি নিয়েছেন। কৃষক মা-বাবা তাঁকে হার না মানতে শিখিয়েছেন। তাঁর গল্প আজ আমরা শুনবো।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের জামসাপুর গ্রামে জন্মেছি। বাবা একজন কৃষক। সেই সঙ্গে একটি সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ করেন। স্কুলবেলাতেই পড়াশোনার সঙ্গে চাষবাসও করেছি। কোনো কেনো ছুটির দিনে দিনমজুরিও করতাম। আমার আরো দুই বোন আছে। মায়ের সঙ্গে তারাও কষ্ট কম করেনি। পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি ২০১১ সালে। সব বিষয়েই এ+ পেয়েছিলাম।
তারপর ঢাকায় এলাম। নটর ডেম কলেজে ভর্তির সুযোগ পাই। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। ঢাকায় থাকা-খাওয়া আর পড়াশোনার খরচ কম নয়। বাবা খুব অল্পই পাঠাতে পারতেন। ভর্তি হওয়ার পর থেকেই টিউশনি করতাম আর ব্র্যাকের মেধাবিকাশ থেকে মাসিক দুই হাজার টাকা বৃত্তি পেতাম। তবুও কষ্ট ছিল। অনেক দিন তো না খেয়েও কাটিয়েছি। সকালের খাবার দেরি করে দুপুরের সময় খেতাম, যেন এই খাবার দিয়েই সকাল-দুপুর-রাত তিন বেলাই কেটে যায়। নটরডেম কলেজের ওই দুটি বছর আমার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের ছিল। সেই সঙ্গে ওই সময়টার কাছেই আমি বেশি ঋণী। কলেজে থাকতে ক্লাব করেছি, বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেছি, লেখালেখি করেছি। অনেক মানুষের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তাই কলেজটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
বাবা যা শিখিয়েছেন
বাবার জীবন থেকে শিখেছি, কিভাবে টিকে থাকতে হয়। ঈদে মা-বাবা নতুন কাপড় নেননি কখনো। আমাদের হাসিখুশি রাখতে তাঁদের চেষ্টা দেখতাম। আমরাও কখনো অযথা আবদার করিনি। ঈদের জামা বানাতাম সবুজ রঙের, স্কুল ড্রেসের মতো, যেন এক কাজে দুই কাজ হয়ে যায়। এইচএসসিতে বাংলায় কেবল এ+ পাইনি, তবে জিপিএ ৫ ছিল। কলেজ শেষ করে ভেবেছিলাম সেনাবাহিনীতে ঢুকব। তবে পরীক্ষায় টিকিনি। কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) ভর্তির সুযোগ পাই। পজিশন ভালো ছিল বলে বুটেক্সেই ভর্তি হই।
আমাকে ডাক্তারই হতে হবে
শুরু হলো আবার সেই সংগ্রাম। আবার সেই না খেয়ে থাকার দিন। বাড়ি থেকে ছোটবেলার সাইকেলটা নিয়ে আসি। সাইকেল চালিয়ে টিউশনিতে যাই, ভার্সিটিতে ক্লাস করি, আবার মেডিক্যালের কোচিংয়েও যাই। বাড়িতে অবশ্য জানাইনি যে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করছি মেডিক্যালের জন্য। কারণ সুযোগ না পেলে তাঁরা আবারও কষ্ট পাবেন।
মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের দিনই প্রথম মা-বাবাকে জানাই যে, চেষ্টা করেছিলাম আর সুযোগও পেয়েছি। মা-বাবা খুশিতে কাঁদলেন, আমারও ভালো লাগল খুব। ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর আর অর্থকষ্টে থাকতে হয়নি। টিউশনি করে ভালোই টাকা পেতাম। বরং কেউ অর্থকষ্টে থাকলে তাকে সাহায্য করতাম। এখনো করি। বন্ধুরা মিলে ২০১৫ সালে ইচ্ছেকুঁড়ি ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করি।
নটরডেমে থাকতেই এক-আধটু লেখালেখি করতাম- কলেজের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় বা কলেজ ম্যাগাজিনে। ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গল্পের বই ‘একটি মৃত্যু এবং লাল পিঁপড়ারা’। পরের বছরের বইমেলায় প্রকাশিত হয় মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা আমার আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘গলে পড়ে জোছনা’।
ডাক্তার হলাম
গেল ৯ মার্চ মেডিক্যাল শেষ বর্ষে আমাদের ফাইনাল প্রফের (প্রফেশনাল) রেজাল্ট। তখন করোনাও ঢুকল দেশে। ইচ্ছা ছিল ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে তাড়াতাড়িই জয়েন করার। ব্যাচের সবাই মিলে এপ্রিলের ১ তারিখে জয়েন করার কথা ছিল। কিন্তু লকডাউন শুরু হলে আগেই আবাসিক হল বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমি অবশ্য বাড়ি গেলাম না। ময়মনসিংহ শহরে থেকে গেলাম। জয়েন করার পেপারওয়ার্ক শেষ করে হাসপাতাল অফিসে জমা দিলাম ২৭ মার্চ।
অফিস থেকে বলল, “একা একা কেন জয়েন করবেন? দেশের অবস্থা খারাপ, এত ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই।”
উপপরিচালক স্যার আর ইন্টার্ন কো-অর্ডিনেটরকে বললাম—”স্যার, আবাসিক হল জয়েনিংয়ের আগে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওরা তো জয়েন করতে পারছে না ইচ্ছা থাকলেও। আমি ময়মনসিংহে আছি, আমি জয়েন করতে চাই। একজন মানুষকেও যদি বাঁচতে সাহায্য করতে পারি!”
তাঁরা সম্মতি দিলেন না। আমি গাইনির হেড ম্যাডামকে ফোন দিয়ে ওয়ার্ডে যাই।
ম্যাডাম বললেন, “সবাই চলে গেছে, তুমি যাওনি কেন?”
বললাম—”ম্যাডাম, ডিউটি করব।”
ম্যাডাম বললেন, “আচ্ছা করো।”
২৯ মার্চ আন-অফিশিয়ালি জয়েন করি। অর্থাৎ বেতন ছাড়া। কোনো রেকর্ডও থাকবে না, অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধাও না। আমি পরিচালককে মেইল করে জানালাম—স্যার, আমি ব্যক্তিগতভাবে গাইনি ইউনিট ৪-এ জয়েন করেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।
রান্নাও করি
মার্চের ২৫ তারিখে একটা রাইস কুকার কিনেছিলাম। ওটা দিয়েই রান্না করে খাই। সকালে খিচুড়ি, রাতে আলু ভর্তা, পরদিন সকালে আবার ভাত-আলু ভর্তা। ভাত-ভর্তা-খিচুড়ি…চলছে এভাবেই। তিন মাস হলো। এর মধ্যে রমজান মাস এলো। মর্নিং, ইভিনিং, নাইট ডিউটি করি। তারপর ঈদ এলো।
ঈদের দিন সকালে মাকে ফোন করে বলি—”মা, একটু সেমাই খাইয়ে দাও, আমি হাঁ করি।”
একটু পরেই বুঝেছি, ভুল হয়েছে কথাটা বলে। যা ভেবেছিলাম তা-ই! মা কান্না জুড়ে দিলেন।
বললেন, “সেমাই খাতি চালি, তো বাড়িই আসতি!”
ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় বাবা ফোন দিলেন, “মুনি, নামাজ পড়তে যাচ্ছি।” বুঝলাম, আব্বাও কাঁদছেন। বাবা কঠিন মানুষ, কোনো দিন কাঁদতে দেখিনি। বাবা কোনো দিন আমাকে ছাড়া ঈদের নামাজ পড়তে যাননি। প্রতি ঈদে নামাজ পড়া শেষে আমরা একসঙ্গে দাদার কবর জিয়ারত করি। এবার হলো না।
২৯ মার্চ থেকে ৬ জুন আন-অফিশিয়ালি ডিউটি করেছি। মা ফোন দেন প্রতিদিন, “বাড়ি আসিস নে ক্যা তুই? এখনই ভুলে যাচ্ছিস আমাগের? মায়াদয়া নাই তোর?”
একটি ঘটনা
ঈদের দিন ভোরবেলা, ৪টা হবে। মেডিসিন ওয়ার্ডে এক রোগী এলো। ১৪ বছরের একটা ছেলে। পেটের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। সঙ্গে ওর মা ছাড়া কেউ নেই। প্রয়োজনীয় সব ট্রিটমেন্ট দেওয়া হলো। তবে রাত চলে যাওয়ার একটু আগে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। তখন আমরা অ্যাডমিশন ওয়ার্ডে, রোগীর বেশ চাপ।
ওর মা এসে বললেন, “ছেলেটা আমার নড়াচড়া করছে না।”
দৌড়ে গেলাম। পেটটা শক্ত হয়ে গেছে, পালস পাচ্ছি না, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। শকে চলে গেছে রোগী। তবে বুঝতে পারছি, এখনো আছে। আমি নতুন, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। দৌড়ে গিয়ে সহকারী রেজিস্ট্রার স্যারকে ডেকে আনলাম।
ফ্লুইড চালু করা হলো, কিছু ইনজেক্টেবল ড্রাগ দেওয়া হলো। ওর মা আশা ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়েছেন চিত হয়ে। নার্স আর আমরা দুজন ডাক্তার মিলে প্রায় আধাঘণ্টা যুদ্ধ করলাম। আস্তে আস্তে ও পা নাড়ল, হাত নাড়ল। পালস দেখলাম, পাচ্ছি। মোটামুটি স্টেবল অবস্থায় চলে এলো। ওর মা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। চিকিৎসা শেষ করে অ্যাডমিশন রুমে গেলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল।
এবার অফিশিয়ালি
আমার ব্যাচের পাস করা ১৮৫ জনের মধ্যে ১২০ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে অফিশিয়ালি জয়েন করল ৬ জুন। আমারও অফিশিয়ালি জয়েনিং হয়। তবে তার আগের দুই সপ্তাহ মেডিসিন আর গাইনি বিভাগে একসঙ্গে ডিউটি করেছি। এমনও হয়েছে, গাইনিতে ইভিনিং করেছি, মেডিসিনে নাইট। হাসপাতালে ডিউটি টাইম বাদেও প্রতিদিন চার-পাঁচটা করে রোগী দেখে আসতে হয়েছে বিভিন্ন ওয়ার্ডে। অনেক গর্ভবতী মা করোনার কারণে হাসপাতালে আসতে পারছেন না, বাড়িতে গিয়ে প্রেসার মেপে দিয়ে আসছি। ক্যানোলা লাগাতে পারছে না বা ইনজেকশন দিতে পারছে না, খবর পেয়ে আমি গিয়ে করে দিয়ে আসছি। তবে ওই সময় পরিচালক স্যার, উপপরিচালক স্যারও অনেক সাহায্য করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
আমি যে ডাক্তার!
আমি বেশি কিছুই করিনি, দেশের এই দুঃসময়ে আমার যা করা উচিত ছিল তা-ই করেছি। এখানে ত্যাগের কিছু নেই। আমাদের সব ডাক্তারের জীবনটাই এমন। তবে আমার এই কাজ দিয়ে একটা জীবনও যদি বেঁচে গিয়ে থাকে, সেটাই আমার প্রাপ্তি। আমি চাই—সবাই ভালো থাকুক, পৃথিবী সুস্থ হোক, সুস্থ হোক আমার প্রিয় মাতৃভূমি।
সূত্র: কালের কন্ঠ, ২৩ জুন, মঙ্গলবার, অবসরে