একটি ডাক্তার শাসনের(পেটানোর) গল্প, কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নেত্রকোণা, বেলা সাড়ে ১১টা, ৭/২/১৬। ৮-১০জন ব্যক্তি মারধোর শুরু করলো ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারকে। কর্তব্যরত স্যাকমো, ক্লিনার এগিয়ে আসলে তারাও রেহাই পেলেন না। হইচই শুনে আউটডোর থেকে মেডিকেল অফিসাররা এগিয়ে এলে একজন মেডিকেল অফিসারকে একা পেয়ে চোর পেটানোর মত পেটানো হল। উপায় না দেখে এবার তিনি জীবন বাঁচাতে ছুটলেন। দৌড়ে পালালেন ইউএইচএন্ডএফপিও এর অফিস কক্ষে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রাখলেন।

ডাক্তার শাসন কেন?

ইলেক্ট্রিক শকের একটি বাচ্চাকে ইমার্জেন্সিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। তাৎক্ষনিক ইসিজি করে তাকে হাসপাতালে ভর্তির অথবা উচ্চতর চিকিৎসার্থে রেফার করা হচ্ছিল। বাচ্চাটির শক খাওয়ার ঘটনা জানতে পেরে তাঁর আত্মীয় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এটেন্ডদের দাবি(আবদার) হাসপাতাল থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসককেই অন কলে তাঁকে দেখতে যেতে হবে। তখন ঘড়িতে সময় বেলা ১২টার বেশি। আউটডোর তখনো খোলা, অফিস টাইম, ইমার্জেন্সি ২৪ ঘন্টা খোলা রাখতেই হবে তাই চিকিৎসক কলে যেতে রাজি হননি। শুরু হলো অশ্রাব্য গালাগালি, কিল ঘুষি (শাসন)। প্রথমে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, এরপর আকাঙ্ক্ষিত মেডিকেল অফিসার যিনি আউটডোরে ডিউটি করছিলেন।

শাসনের পর?
চিকিৎসকেরা স্থানীয় এবং উর্ধতন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের তাৎক্ষনিক এ ঘটনা অবগত করেন। উত্তর আসে SHOW MUST GO ON, কোন অবস্থাতেই যেন আউটডোর বন্ধ রাখা না হয়। চাইলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন জানানো হয়। কিন্তু ব্যবস্থা কার বিরুদ্ধে নেয়া হবে? শাসক যে স্থানীয় পর্যায়ের জন প্রতিনিধির আত্মীয়। এতো তাঁর মহানুভবতা যে জনপ্রতিনিধি হয়ে নিজ আত্মীয়ের কৃতকর্মের জন্য তিনি ক্ষমা চাইতে এসেছেন। আরেকটা নাটক মঞ্চস্থ হবার অপেক্ষায়, ৮-১০ জন ব্যক্তি হাসতে হাসতে ক্ষমা চাইবেন দু-এক দিনের ভেতরে।

একটি সরল অংকঃ

বাংলাদেশ সরকারের মোট ১৫২৭ ধরনের ছাপানো ফর্ম অনলাইনে পাওয়া যায়। এর মাঝে সবার উপরে-কর্মস্থলে ডাক্তারদের উপস্থিতি পরিবীক্ষণ ছক। সমমর্যাদার আর কোন কর্মকর্তাকে কি কর্মস্থলে হাজিরা খাতায় সই করতে হয়? সমপদ মর্যাদার আর কোন সরকারি কর্মকর্তাকে কখনোই কে এভাবে শারীরিক আঘাত করা হয়েছে? পেশাজীবী হিসেবে কেনই বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে থাকতে চান না? এই সরল অংকের সমাধান কেউ কি করেছে কখনো? কেউ দায়িত্ব নিয়েছে?

কেন্দুয়ায় এটাই প্রথম ঘটনা নয়। সাড়া বাংলাদেশে প্রতিদিনই এরকম ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা কোন দুর্ঘটনা নয় বরং সাধারণ মানুষের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, এর সাথে দানবদের ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ঢালাও লাইসেন্স দেবার ফল।

আমার কাজ কি ঘটেছে সেটা ধামাচাপা পড়ার আগে জানিয়ে দেয়া। এ সবগুলোরই সম্ভাব্য সমাধান সম্ভব কিন্তু সে সুযোগ আমাকে কেউ দেবে না।

কেন্দুয়া উপজেলায় সাম্প্রতিক কালে এটি তৃতীয় ঘটনা। এর আগে আরেকজন মেডিকেল অফিসারের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে হাসপাতালের সামনে রাস্তায় এলোপাথাড়ি মারধোর করা হয়। স্থানীয় বখাটেরা নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা দাবি করে। এ ঘটনায় পরবর্তীতে মামলা হলে তিন দিনের মাথায় অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়। এরপর আর কোন আগ্রগতি নেই।

এর আগে তৎকালীন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সে অঞ্চলে চিকিৎসা ব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে একটি দাপ্তরিক চিঠি জারি করায় এর পেছনে দায়ী ব্যক্তি হিসেবে একজন মেডিকেল অফিসারকে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। চিঠির বিষয় বস্তু ছিল-ডাক্তার পদবি ব্যবহার অবৈধযাদের জন্য তারা ডাঃ পদবি ব্যবহার করতে পারবেনা, লাইসেন্সবিহীন অননুমোদিত ওষুধের দোকানে বিনা প্রেস্ক্রিপশনে ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা, মানহীন রেজিস্ট্রেশনবিহীন কৌটা কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করা। এরফলে সে সময় ঐ অঞ্চলের সকল ফার্মেসি এক জোট হয়ে ওষুধ বিক্রি বন্ধ রেখেছিল, ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের সংগঠন, পল্লী চিকিৎসকদের চাপের মুখে ঐ চিঠি প্রত্যাহার এবং পরে পাল্টা চিঠি জারি করার ব্যবস্থা করা হয়। একজন চিকিৎসক কে দায়ী করে তাঁকে পেশাগতভাবে এবং সামাজিকভাবে হেয় করা হয়, ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে চিকিৎসা প্রদানের পরিবেশ ব্যহত করা হয়।

কেন্দুয়া কোন ব্যতিক্রম নয়। গোটা বাংলাদেশটাই কেন্দুয়ায় পরিণত হচ্ছে। পরিণত হচ্ছে না পরিণত করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপরঃ স্বাস্থ্য সেবা দানকারী, স্বাস্থ্য সেবার বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা, স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের পদ্ধতি। বিদেশি প্রেস্ক্রিপশনে তৈরি করা স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে মন্তব্য করছি না, স্বাস্থ্য সেবায় কি কি সুযোগ সুবিধা, ইনফ্রা স্ট্রাকচার, ইন্সট্রুমেন্ট আছে সেটাও আপনারা জানেন, কিন্তু যেটা সাধারণ মানুষ জানে না, পেশাগত ও নিরাপত্তার দিক থেকে স্বাস্থ্য সেবা দানকারীরা কী ভয়াবহ অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মাঝে কাজ করেন সেখান থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নূন্যতম স্বাস্থ্য সেবা পাবে সেটা অলীক স্বপ্নই। বেতনের টাকায় অংকে কিছু যায় আসে না…

ডাঃ মোহিব নীরব
উন্নয়নকামী।

ডক্টরস ডেস্ক

3 thoughts on “একটি ডাক্তার শাসনের(পেটানোর) গল্প, কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

"একুশে পদক" পেতে যাচ্ছেন,অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ

Fri Feb 12 , 2016
এবার ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ‘একুশে পদক’ যারা পাচ্ছেন বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সাংবাদিকতা, গবেষণা, ভাষা ও সাহিত্য এবং শিল্পকলায় গৌরবোজ্জ্বল ও প্রশংসনীয় অবদান রাখায় ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যাক্তি এই সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারের জন্য মনোনিত হয়েছেন। এই তালিকা অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হয়। এই […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo