মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫
স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব দিতে গঠিত সংস্কার কমিশন এমবিবিএস পরীক্ষা পরবর্তী সময়ে চিকিৎসক নিবন্ধন পরীক্ষা চালু করার সুপারিশ করতে পারে। এছাড়াও ওষুধের প্রাপ্যতা, চিকিৎসা শিক্ষার মান ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেবে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন।
জানা গেছে, বিদ্যমান স্বাস্থ্য কাঠামোর অনেক কিছুই ভেঙে নতুন করে গড়া কিংবা কিছু ক্ষেত্রে কাঠামো বহাল রেখে সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সুপারিশ করবে সংস্কার কমিশন।
সংস্কার কমিশন কাজ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয়টি বিভাগের স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ওষুধশিল্প, বেসরকারি মেডিকেল কলেজসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করেছে। মাঠপর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর সমাধানের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার কাজ করছে। কমিশনের একজন সদস্য প্ল্যাটফর্মকে জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হবে।
গতবছরের ১৮ নভেম্বর গঠিত ১২ সদস্যের এ কমিশনকে গঠনের তারিখ থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কমিশনের দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু অগ্রাধিকার চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। তাঁদের বিবেচনায় প্রয়োজন, প্রাপ্যতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। বিবেচনায় নেওয়া ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসকদের মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যশিক্ষা, চিকিৎসক-রোগী সুরক্ষা, ওষুধ, পুষ্টি, চিকিৎসা ব্যয়সহ প্রাসঙ্গিক সবকিছু। গত তিন দশকে যেসব সমস্যার সমাধান করা যায়নি, সেসব থেকেও পরিত্রাণের পথ খোঁজা হচ্ছে।
কমিশন প্রান্তিক মানুষের কাছে ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা দূর করার প্রস্তাব করবে। সুলভ মূল্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, সরকারি হাসপাতালের দেওয়া ওষুধের তালিকা বড় করার মতো প্রস্তাব থাকবে। এতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের বিদ্যমান তালিকার সংস্কার প্রয়োজন হবে।কমিশনের একজন সদস্য বলেছেন, ১৯৮২ সালে প্রথম ওষুধ নীতি প্রণয়নের সময় অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় ছিল ১৫০টি ওষুধ। তবে তালিকায় শেষ পর্যন্ত থাকে ১১৭টি। ২০০৮ সালে দুই শর বেশি ওষুধকে জরুরি ওষুধের এই তালিকায় রাখা হয়। তবে ওষুধ কোম্পানিগুলোর চাপের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। নিয়ম অনুযায়ী, সরকার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দেয়। তাতে ওষুধগুলো সাধারণ মানুষের জন্য সুলভ হয়। এসব ওষুধে লাভ কম হওয়ায় কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখায় না। রোগের ধরন এবং চিকিৎসাপদ্ধতির পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কমিশন তালিকা সময়োপযোগী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কমিশন জনস্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে স্থানীয় সরকার ও সরকারের মূল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সঙ্গে ‘সমন্বয়ের সেতু স্থাপন’ করার কথাও বিবেচনা করছে। বিকল্প হিসেবে নগর স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে পুরো ব্যবস্থাই স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার কথা বলবে। কমিশনের সদস্যরা বলছেন, স্থানীয় সরকার আইনের মাধ্যমে নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা হলেও সেই স্বাস্থ্যসেবার প্রায় শতভাগই নিছক কাগজে-কলমে। নগরাঞ্চলে স্থানীয় সরকারের স্বাস্থ্য অবকাঠামো নেই। তাই সাধারণ মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনেও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হয়।
কমিশনের সদস্যরা বলেছেন, দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার কিছু অবকাঠামো থাকলেও সেখানে সেবার যথাযথ আয়োজন নেই। প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রামে ত্রুটি রয়েছে। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কমিশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে স্বাস্থ্যসেবার প্রথম রেফারেন্স পয়েন্ট করার প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে। এর সদস্যরা এই প্রসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা বিবেচনায় নিচ্ছেন।
একাধারে চিকিৎসক-সংকটের দিকে গুরুত্ব দিয়ে এবং বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গত কয়েক দশকে সরকারি ও বেসরকারি বহুসংখ্যক মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন বছরে অন্তত ১০ হাজার চিকিৎসক তৈরি হচ্ছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ হারে চললে কয়েক বছর পর চিকিৎসকের তুলনামূলক আধিক্যও দেখা দিতে পারে। কমিশনের একাধিক সদস্য এদিকে ইঙ্গিত করে চিকিৎসা শিক্ষার মানের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, নতুন চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ মানহীন হয়ে তৈরি হচ্ছে।
কমিশনের এক সদস্য বলেছেন, ‘চিকিৎসক তৈরির সক্ষমতার সঙ্গে মানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কার্যত পেশাটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। অথচ চিকিৎসকের ওপর মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করে।’
চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে মানের পাশাপাশি আরও দুটি বিষয় সামনে এনেছে কমিশন। এগুলো হচ্ছে চিকিৎসক তৈরির সক্ষমতা অতিরিক্ত না হওয়া নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসকদের নিবন্ধন বিষয়ে সংস্কার আনা। ডিগ্রি পাওয়ার পর একজন চিকিৎসক বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে নিবন্ধন পান। এরপর তাঁকে পেশাগত জীবনে আর কখনো যোগ্যতা ও পেশাগত উৎকর্ষের জন্য পরীক্ষা বা যাচাইয়ের সম্মুখীন হতে হয় না। কমিশন বিএমডিসি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কয়েক বছরের বিরতিতে যোগ্যতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করবে বলে জানিয়েছেন এক সদস্য।
কমিশনের পর্যবেক্ষণ, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পুরোটাই চিকিৎসককেন্দ্রিক। তারা জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে এই ‘চিকিৎসকনির্ভর’ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছে। স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের বণ্টন ও পদায়ন যথাযথভাবে না হওয়ার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে কমিশন। তারা উল্লেখ করে, দেখা যায় কোনো উপজেলায় অবেদনবিদ থাকলেও শল্যচিকিৎসক নেই। আবার কোথাও শল্যচিকিৎসক থাকলেও নেই অবেদনবিদ। প্রয়োজন অনুযায়ী নেই মেডিকেল অফিসার।
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত কয়েক দশকে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিটি শাখা কার্যত ভেঙে পড়েছে। সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের কোনো ক্ষেত্রকেই এককভাবে শতভাগ কার্যকর করা যাবে না। তাঁদের মতে, সংস্কার কমিশনের উচিত হবে স্বাস্থ্যের প্রতিটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তাব তৈরি করা। কোনো বিষয়ে সংস্কার এবং কোনো বিষয়ে শক্তিশালীকরণে নজর দিতে হবে।
চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসকদের মানোন্নয়ন, ওষুধ, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, জরুরি চিকিৎসাসহ সব বিষয় কমিশন তাদের সুপারিশে তুলে ধরবে বলে প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষার মান খুবই খারাপ। যে হারে মানহীন চিকিৎসক তৈরি করা হচ্ছে, তার নজির বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। চিকিৎসা শিক্ষার মান ঠিক করার বিষয়টি সুপারিশে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। বেসিক সায়েন্স শিক্ষকের সংকট সমাধানের উপায় বের করতে হবে। দেশে আর নতুন মেডিকেল কলেজের প্রয়োজন নেই।’
চিকিৎসকদের বিএমডিসির নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রয়োজনের দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বহু দেশে চিকিৎসকদের প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর পর পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। তিনি জরুরি চিকিৎসাকে নতুন কাঠামোর মধ্যে আনা, স্বাস্থ্যবিমার ওপর গুরুত্ব দেওয়া, সাধারণ মানুষের জন্য দুরারোগ্য এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসার অর্থায়নের উপায় নিয়ে ভাবার পরামর্শ দেন।
প্ল্যাটফর্ম/