১৮৪৬ সালের ১৬ ই অক্টোবর উইলিয়াম থমাস গ্রীন মর্টন নামের এক ডেন্টাল ছাত্রের(পরে ডক্টর ডিগ্রী পান) হাত ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে চারা গাছটি এই গ্রহে রোপিত হয়েছিল আজ তা বিরাট মহীরুহ হয়ে স্বাস্থ্য সেবায় শান্তির শীতল হাওয়া বিলিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। বড় বড় জটিল অপারেশন নিরাপদে সফল হচ্ছে শুধু মাত্র এনেস্থেসিয়া বা এনেসথেসিওলজির প্রভূত উৎকর্ষতার জন্য। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর চেয়ে আমরাও কোন অংশে পিছিয়ে নেই। সেটা সম্ভব হয়েছে এখানে মেধাবী কিছু লোকজনের পদার্পণ, দেশে, বিদেশে হাতে কলমে শিক্ষা, সর্বোপরি সরকারি, বেসরকারি, কর্পোরেট হাসপাতাল সমুহের পৃষ্টপোষকতায়। আর জনগনের স্বাস্থ্য ও এনেস্থেসিয়া সম্বন্ধে সচেতনতার কথা না বললে ত গল্পটাই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। আগে যেখানে একজন অশিক্ষিত লোক আমাদের ডাকতার হিসেবেই জানত না, এখন তারা এনেস্থেসিওলজিস্টদের স্বনামে চেনে। অপারেশনের সময় যেচে খোঁজ খবর নেয়।
আমি কাজ করি শহর থেকে অনেক দূরে, গ্রামীন পটভূমিতে অবস্থিত একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে। দেশের স্বাস্থ্য খাতের নাটকীয় উন্নতির ছোঁয়া এখানেও লেগেছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ টি করে বড় বড় অপারেশন হয়। দুইটি আই,সি,ইউ, ও ৩টি এস,ডি,ও, বেড সহ ৩৭৫ বেডের হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও অন্ত:বিভাগে তিল ধারণের স্থান নেই। ম্যাজিকটা আর কিছুই না। অর্থনীতির উন্নতির সাথে সাথে বাড়ছে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা। সাথে স্বাস্থ্য সচেতনতা। রকেটের যুগে রকেটের গতিতে উন্নতি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের।
দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার লোকবল ও অবকাঠামোর মজুদ এখনো অপ্রতূল। তাই অবকাঠামো, লোকবল ও সেবার পরিধি বাড়াতে সরকার সদা তৎপর। এটা একটা স্বত:সিদ্ধ নজির যে, কোন কিছুর সংখ্যা ঢালাওভাবে বৃদ্ধি করতে গেলে ‘মান’ এর পতন ঘটে। এই সেক্টরে, যেখানে জীবন-মৃত্যু নিয়ে কারবার, সেখানে মানে’র অবমূল্যায়ন কিছুতেই কাম্য নয়। সকলের জন্য সমূহ বিপদ। সুস্বাস্থ্য মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। তবে মানের সাথে কম্প্রোমাইজ করে নির্বিচারে মেডিকেল কলেজ খোলার অনুমতি দিলে মান পড়তে বাধ্য। যেগুলো তৈরী করা হয়েছে এদের স্ট্যান্ডার্ড যেন মানসম্মত হয় সেদিকে নজর দেয়া বিশেষ প্রয়োজন।
চিকিৎসা বিদ্যার ঈর্ষনীয় উন্নতির সাথে সাথে এর একটি বিশেষায়িত শাখা এনেস্থেসিয়ারও হয়েছে অনেক উন্নতি। এখন ছোট ছোট শহরে হচ্ছে ‘লেপকল’ ‘হিস্টেরেক্টমি’, ‘টনসিল’, ‘ফেকো’ ‘সি,এসে”র মত অপারেশন। সার্জনরা অনেক আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। অভাব ছিল এনেস্থেসিয়ায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোকবলের। তা কাটাতে সরকার বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তবে এখনো সকল উপজেলায় ২৪ ঘন্টা এই সার্ভিস পাওয়া নিশ্চিত করা যায় নি। আফসোস!
এনেস্থেসিয়া এখন আর ও,টি, ‘তে সার্জারির রোগিকে অজ্ঞান করার মাঝে আবদ্ধ নেই। ডানা মেলেছে অসীম নীলিমায়…….। গড়পরতা সাধারণ সার্জারির সাথে নিত্য নূতন গজাচ্ছে শাখা-প্রশাখা। কার্ডিওভাস্কুলার, চেস্ট, নিউরো, শিশুর মত বিশেষ ‘সাব- স্পেশালিটি’ ত আছেই। বেরিয়ে গেছে পূর্নাংগ বিষয় হিসেবে ক্রিটিকেল কেয়ার মেডিসিন (আই,সি,ইউ), পেলিয়েটিভ কেয়ার, পেইন ক্লিনিক ইত্যাদি সব ‘হাইলি সাব স্পেশালিটি’।
এত আশা জাগানিয়া কথামালার মাঝেও এখনো আছে অনেক অপ্রাপ্তি। উপজেলা লেভেলে এনেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞের অভাব। নাই পোস্ট, নাই থাকার জায়গা, নাই যন্ত্রপাতি। জেলা পর্যায়ে নাই পর্যাপ্ত আই,সি,ইউ, পরিষেবা। এটা একটা ব্যয়বহুল প্রজেক্ট বটে। ভরসার কথা হল আমাদের উদার, জ্ঞানী অগ্রজদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় প্রচুর নবীন ডাকতারগণ এই আপাত: অলোভনীয় বিশেষ বিষয়ের প্রতি ঝুঁকছে অসীম আগ্রহ নিয়ে। এখন আমাদের কাজ হল এইসব তরতাজা যুবক-যুবতীদের এই আগ্রহকে স্বপ্নে রুপ দেবার ক্ষেত্র প্রস্থুত করে দেয়া। এই বিষয়ের আমলাতান্ত্রিক অনিয়মগুলো দ্রুত দূর করতে হবে। লোকবলের মারাত্মক অভাব বোধ করে এই বিষয়কে(এবং বেসিক সায়েন্সের কিছু বিষয়) ডাকতারদের মধ্যে আকর্ষণীয় করার জন্য সরকার কিছু লোভনীয় প্রনোদনা দেবার চিন্তা-ভাবনা করছে। কার্যকর হলে নি:সন্দেহে ভাল ফল বয়ে আনবে তা।
আমার একটা সবিনয় প্রস্তাব আছে এনেস্থেসিয়ার নীতি নির্ধারক কলিগদের কাছে। এই বিষয়ের বিভিন্ন ডিগ্রী গুলোকে সুবিন্যস্ত করে এক সমতলে আনা যায় কি? ডি,এ, এম,ডি (রেসিডেন্সী), এফ,সি, পি, এস, ইত্যাদি সব ডিগ্রীগুলোকে একীভূত করে একটি ছাতার নীচে আনা যায় কি না ভেবে দেখুন। রেসিডেন্সী ই মনে হয় সবচেয়ে যুৎসই ও বিজ্ঞান ভিত্তিক। যারা এই বিষয়ে ডিগ্রী নিতে মনস্থ করবে, তারা আশা করি কোন কিছুতেই পিছপা হবে না। তাতে করে অযথা একবার ডি,এ, আবার এফ,সি,পি,এস, বা এম,ডি, ইত্যাদি বিভিন্ন ডিগ্রীর পেছনে ঘুরে ঘুরে ডাকতাদের জীবনের মূল্যবান সময়ের অপচয় হত না। উপকৃত হবে দেশ। প্রয়োজনের তূলনায় অতি কম সংখ্যক লোকবলের কথা চিন্তা করে এদের জন্য (এবং অন্য বিষয়ে যাতে এমন কমতি আছে) রেসিডেন্সির সময় ‘এক বৎসর’ কমিয়ে দেয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এমন সিস্টেম মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে আছে। পরে পর্যাপ্ত লোকবল হলে অন্য সব বিষয়ের মত এদেরও ‘পুরা’ রেসিডেন্সী সময় বেঁধে দেয়া যাবে। যারা ডি,এ, করে তিন বৎসর কাজ করেছেন তাদের একটা ‘নমিনাল’ পরীক্ষা নিয়ে ঐ ডিগ্রী দেয়া যেতে পারে(অনারারি)।
আর আল্লাহর ওয়াস্তে স্বল্প মেয়াদী(৬ মাস)ট্রেনিং সার্টিফিকেট কোর্স একদম তুলে দেয়া উচিৎ। এতে লাভের চেয়ে বাড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনার হার(অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী)। সরকার আন্তরিক ভাবে এই বিষয়ের উন্নতি চায়। আমাদের নেতারা যদি যুগোপযোগী দিক নির্দেশনা দিতে পারেন এই বিষয়ের ডাকতারগণ দেশ বিদেশের গৌরব হবে একদিন। লাভ হবে দেশের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার।
১৭১ বিশ্ব এনেস্থেসিয়া দিবসের শুভেচ্ছা সকলকে। এবারের শ্লোগান-“প্রতিটি এনেস্থেসিয়ার জন্য চাই বিশেষজ্ঞ এনেসথেসিওলজিস্ট(“Qualified Anaesthesiologists in each anaesthesia.”) আর আমাদের মেডিকেলের শ্লোগান হল “এনেস্থেসিয়া বিবেচ্য হবে মান দিয়ে সংখ্যা দিয়ে নয়।”(We care for quality anaesthesia, not for numbers.”)
………………
লিখেছেনঃ
প্রফেসর মো: রফিকুল ইসলাম
জহুরুল ইসলাম মেডিকেল
কলেজ হাসপাতাল।