৬ এপ্রিল, ২০২০
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিন্তু উপসর্গবিহীন যেকোন ব্যক্তি শুধুমাত্র কথা বলার মাধ্যমেই এই রোগের সংক্রমণ ঘটাতে পারে। কিন্ত শুধুমাত্র একটা সাধারন কাপড়ের মাস্ক দিয়ে আমরা জীবানুযুক্ত হাঁচি কাশির তরলকণা বা ড্রপলেট ছড়ানো প্রতিরোধ করতে পারি।
আপনাদের অনেকেই হয়তো অফিসে,পার্কে বা বাজারে গিয়েছেন, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং আপনাদের অনেকেই ইতোমধ্যে নিজের অজান্তেই হয়তো আক্রান্ত হয়ে গেছেন। কেউ কেউ হয়তো মারাও গেছেন। বাকীরা হয়তো ভাবছেন যে আরোগ্য লাভের পূর্বেই উনারা মারা যাবেন।
এই উদ্বেগের বিষয়টাই উল্লেখ করা হয়েছে “Nature”- এ প্রকাশিত রোমান ওউলফেল এবং তার সহযোগীদের প্রবন্ধে। এতে বলা হয়ছে যে প্রথম ৭ দিন আক্রান্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যাক্তির মাধ্যমে সংক্রমনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সাধারনত, এ সময় আক্রান্ত ব্যক্তির কোন ধরনের উপসর্গ দেখা যায় না।
সহজ ভাষায়, অসতর্ক ব্যাক্তির জন্যে কোভিড-১৯ হল এক নীরব ঘাতক। হতে পারে, আপনিও এরকমই অসতর্ক একজন। এদের দলভুক্ত হতে না চাইলে অবশ্যই মাস্ক পরুন এবং সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
N95 রেস্পিরেটর কিন্তু আপনার জন্য নয়। স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোতে এন ৯৫ রেস্পিরেটরের অপ্রতুলতা রয়েছে। হাসপাতালে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের সেবা প্রদানকালে স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষায় এই মাস্ক ব্যবহার করা হয়। আপনার মধ্যে এই ঘাতকের সংক্রমন ঠেকাতে ঘরে তৈরি মাস্ক অথবা রুমালের ব্যবহারই যথেষ্ট।
প্রবন্ধটিতে রোমান বলতে চেয়েছেন আমাদের জোর দিতে হবে কথা বলা, হাসি, শ্বাস ও হাঁচি কাশির ক্ষুদ্র তরলকণা বা ড্রপলেটের মাধ্যমে কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধ করা। কারন, আমাদের কথা বলার সময় মুখের লালা থেকে যে ছোট ছোট তরল কনা নিঃসৃত হয়/ ছিটকে আসে, তার মাধ্যমেই মূলত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পরে। যদিও খালি চোখে এসব কণা দেখা যায় না। সকলেই একমত যে এই কণাগুলো ৩-৬ ফুট দূর পর্যন্ত ছড়াতে পারে এবং এটাকেই নিরাপদ দূরত্ব বলা হচ্ছে।
নোবেলজয়ী ভাইরোলজিস্ট হ্যারল্ড ভারমাস এর মতে, একজন ব্যক্তিকে ৯৯ ভাগ ড্রপলেট বা তরলকণা থেকে সুরক্ষা দিতে তার মুখের উপর একটা পরিষ্কার কাপড়ের ব্যবহারই যথেষ্ট। বিজ্ঞানের এটি একটি সহজ প্রয়োগ। যখন আমরা অসুস্থ/আক্রান্ত হব, আমরা হয়ত জানবই না। আক্রান্তবস্থায়, কথা বলার সময় আমরা বাতাসে ভাইরাসযুক্ত তরলকণা বা ড্রপলেট ছড়িয়ে দিচ্ছি। সাধারণ একটি কাপড়ের মাস্ক এই তরলকণাগুলোর পরিভ্রমণ/ ছড়িয়ে পরা বাঁধা দেয়।
ডাঃ হারভি ফিনবারগ, ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স এর Emerging infectious disease & 21st century health threats বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি, বলেন, “আমি কোন সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করব না, কারন এটা স্বাস্থ্য সেবাদানকারীর জন্য। তবে আমি আমার একটি সুন্দর রুমাল ব্যবহার করব, অথবা বাঁদুরে টুপি। আমার অনেক ভালো ভালো বিকল্প আছে। ফিনবারগ নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি অভিমত দেন যে ভাইরাসটি ছড়ায় ড্রপলেট বা তরলকণার মাধ্যমে (যেমন কথা বলার সময়, শ্বাস নেবার সময়, হাঁচি-কাশির সময় বের হওয়া কণার মাধ্যমে)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র পরামর্শক প্রফেসর ডেভিড হেইমান্ন সিবিই বলেন, “এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে মাস্ক পরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চেয়েও বেশি কার্যকর”
“Nature”- এ প্রকাশিত ইউনিভার্সিটি অব হংকং এবং ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড এর পাঁচ বছর মেয়াদী এক গবেষনা প্রবন্ধে দেখা যায় মেডিকেলে ব্যবহারের উপযুক্ত নয় এমন মাস্কও শতভাগ তরল কনা বা এরোসল প্রতিরোধ করতে সক্ষম যার মাধ্যমে করোনাভাইরাস এর সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। এই প্রবন্ধে আরোও বলা হয়, এই ভাইরাসের সংক্রমন প্রতিহত করতে মাস্কের ব্যবহার হতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। কিন্তু আমরা সেটাই করতে পরছি না।
আরো খারাপ লাগে যখন দেখি বিশ্ব নেতারা এই মাস্ক ব্যবহারের গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে আপনি যদি অসুস্থ হন বা অসুস্থ কাউকে দেখতে যান শুধু তখনই মাস্ক ব্যবহার করুন। কিন্তু নতুন তথ্য মতে, এ বার্তাটি সঠিক নয়। মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই উপসর্গবিহীন। অনেক আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের অসুস্থতা সম্পর্কে অবহিতই নয়।
সাধারন মাস্কের ব্যবহার নিয়ে অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি দেখা গেলেও তথ্য প্রমান পাওয়া যাচ্ছে যে, যেসব দেশে মাস্ক কম ব্যাবহার হয় তাদের থেকে মাস্ক ব্যবহারের হার বেশী এমন দেশের মৃত্যুর হার অনেক কম।
মাস্ক ব্যবহারের নীতি পরিবর্তনের প্রভাব খুব স্পস্ট। দক্ষিন কোরিয়ায় ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত মাস্ক দুস্প্রাপ্য ছিল। এরপর সেদেশের সরকার তার সকল জনগনের মাস্কের সরবরাহ নিশ্চিত করে। তার আগ পর্যন্ত, দক্ষিন কোরিয়ায় কোভিড-১৯ এর আক্রান্তের হার ইতালীর মতই ছিল।
কিন্তু সকলের জন্য মাস্ক নিশ্চিত করার পরই সেখানে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমে এসেছে। এবং বর্তমানে দক্ষিন কোরিয়ায় আক্রান্তের হার নিম্নগামী। এবং ঐ দেশে কোন ধরনের অর্থনৈতিক লকডাউন করার প্রয়োজন ও পরে নি।
Stanford Economic Policy Research এর বিশেষজ্ঞদের মতে, “সমাজে সকলের মাস্ক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ প্রাপ্ত তথ্যের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ”। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল মাস্ক ব্যবহারে অর্থনৈতিক উপকারিতা তুলে ধরেন, “জনগনের পরিহিত প্রতিটি অতিরিক্ত মাস্ক এর বিপরীতে লাভ ৩০০০-৬০০০ মার্কিন ডলার বা সমমুল্যে, যেহেতু তারা ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করছেন”।
বিশেষত এসব কাপড় আপনি বিনামূল্যে পাবেন, কারন এটা আপনি টুকরো কাপড়, আপনার পুরানো যে কোন টি-শার্ট, সুতি কাপড় বা চাদর কেটে বানাতে পারবেন। এর ব্যবহারের উপকারিতা টাকায় হিসাব করলে অবাক হওয়ার মত। আপনি মাস্কে ১ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ১০০০ টাকা ফেরত পাবেন।
একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, মাস্ক পরার সুফল পেতে অধিকাংশ মানুষকেই মাস্ক পরতে হবে। ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের গবেষণায় দেখিয়েছে, ৫০ শতাংশ ভাইরাসের সংক্রমণ কমানো সম্ভব যদি জনগনের ৫০% মাস্ক পরে। আর ভাইরাসটি “কার্যত নির্মূলে” ৮০% জনগনকে মাস্ক পরতে হবে। এজন্যে, অনেক দেশে জনাকীর্ণ স্থান (যেমন গনপরিবহন বা বাজার) মাস্ক ব্যবহারের জন্য আইন প্রনয়ণ করা হয়েছে। কিছু দেশ এক্ষেত্রে আরো কঠোর নীতি ঘোষনা করেছে, যেমন ঘর থেকে বেরোলেই মাস্ক পরতে হবে।
ইসরাইল, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, হংকং, মঙ্গোলিয়াসহ আরো অনেক জায়গায় “সবার জন্য মাস্ক আইন” প্রনয়ণ করা হয়েছে এবং প্রতিদিন এ তালিকায় আরো নতুন নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। আমেরিকার বেশ কিছু প্রদেশ যেমন টেক্সাসের লারেডো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কাউন্টি স্থানীয় পর্যায়ে মাস্ক ব্যবহারের আইন প্রনয়ণ করেছে।
এসব পদক্ষেপ কোনভাবেই সামাজিক দূরত্ব এবং হাত ধোয়ার অভ্যাসকে বাদ দিয়ে নয়। এই ঘাতককে থামাতে হলে আমাদের আওতাধীন বা সাধ্যের মধ্যে সকল উপায়গুলো ব্যবহার করতে হব।
আমাদের সরকার যদি এসব পদক্ষেপের গ্রহণ না করে, সেক্ষত্রে, আমাদেরকেই এসব পদক্ষেপ গ্রহনে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের তৃণমূল জনগনের সচেতনতা, আন্তরিকতা ও চেষ্টার উপর গুরুত্ব দিতে হবে যেন আমরা সেই ৮০% মাস্ক ব্যবহার এর লক্ষমাত্রা অর্জন করে ভাইরাসটি নির্মূল করতে পারি অর্থাৎ শতকরা ৮০ জন যেন অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করে। আমরা জানি এটা সম্ভব।
চেক রিপাবলিক এর জনগন গত মাসেই তা করে দেখিয়েছে। এদেশে মাত্র তিন দিনে মাস্ক ব্যবহারের হার শুন্য থেকে শতভাগে পৌছাতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে মাত্র একটি মেধাদীপ্ত এবং কার্যকর সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যাম্পেইন। এরপরই, সেদেশের সরকার মাস্ক ব্যবহারে উপর আইন প্রনয়ণ করেন।
এখন আমাদের উচিত আমাদের সমাজকেও একইভাবে উদ্দীপ্ত করা।
লেখকঃ জেরেমি হাওয়ারড, মনোনীত গবেষণা বিজ্ঞানী, ইউনিভার্সিটি অব স্যান ফ্রান্সিসকো এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা, মাস্ক ফর অল।
বিদ্রঃ (চিকিৎসা কাজে বা হাসপাতালে ব্যবহার এর জন্য প্রযোজ্য নয় বা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবাকর্মী বা নার্সদের হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই সুপারিশগুলো সর্বসাধারন এর নৈমিত্তিক নিয়মিত মাস্ক ব্যবহারের জন্য ।
তিন লেয়ার হলে বেশী ভালো এবং প্রতিদিন ব্যবহার এর পর ভালো করে সাবান গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে।)
অনুবাদঃ আবু আহাম্মদ আব্দুল্লাহ
সম্পাদনাঃ ডাঃ মোঃ রিজওয়ানুল করিম
(সমন্বিত করোনা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)
নাহিদা হিরা /নিজস্ব প্রতিবেদক