প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন
কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান,
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল
কাঁধ বা শোল্ডার আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের সকল কাজে হাত নড়াচড়ার সাথে কাঁধের নড়াচড়া খুবই স্বাভাবিক। এজন্য কাঁধের কোন সমস্যা বা ব্যথা হলে তা থেকে হাতের নড়াচড়া বাঁধাগ্রস্ত হয়। আর গঠনগতভাবে কাঁধ ইনজুরি বা আঘাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কাঁধে ব্যথা একটি সাধারণ বিষয়। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ১৫ জন প্রতি বছর কাঁধে ব্যথার সমস্যায় ভুগে থাকেন। একটু অসাবধানতা থেকেই কাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আজকের আলোচনার বিষয় “কাঁধে ব্যথা বা ইনজুরি, এর থেকে সাবধানতা ও সমাধান।”
শুরুতেই কাঁধের গঠন সম্পর্কে ধারণাঃ
আমাদের কাঁধ বা শোল্ডার, কাঁধের একটি হাড় ও বাহুর একটি হাড় নিয়ে গঠিত। সাথে কিছু মাংসপেশি ও লিগামেন্ট থাকে, যা শোল্ডার জয়েন্টকে শক্তিশালী করে। এখানে কাঁধের হাড়ে একটি ক্যাপসুল থাকে ও বাহুর হাড়ে একটি বলের মত অংশ থাকে, যা ওই ক্যাপসুলের মধ্যে আটকে থাকে। জয়েন্টটি ঝুলন্ত থাকার কারণে ও বেশী ব্যবহৃত হওয়ার কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
কাঁধে ব্যথার কারণঃ
কাঁধে ব্যথার মূল তিনটি কারণ হচ্ছে –
- মাংসপেশী বা লিগামেন্টস এ আঘাত,
- হাড় ভেংগে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া এবং
- স্নায়ুতে চাপ বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া, যা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে।
আঘাত জনিত ব্যথা কীভাবে হয়ঃ
আঘাত পাওয়া যে কোন ব্যথার অন্যতম কারণ।
(১) কাঁধ বা শোল্ডার জয়েন্টকে ঘিরে রাখে চারটি টেন্ডন বা লিগামেন্টস যাদের একত্রে বলে রোটেটর কাফ। আঘাতের কারণে এই রোটেটর কাফের যে কোন লিগামেন্ট আঘাত হতে পারে। এতে কাঁধে বা শোল্ডারে সাময়িক ব্যথা হতে পারে। এটি ঠিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় বা বিশ্রাম খুবই জরুরি, তা না করে যদি নিয়মিত ভাবে ব্যথার অঙ্গ দিয়ে কাজ করে গেলে দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা হতে পারে।
(২) আবার অত্যধিক ভারী জিনিস তুলতে গিয়ে বা জোরে হাতে টান লাগার কারণে মাংস পেশী ও লিগামেন্টস ইনজুরিসহ শোল্ডার ডিসলোকেশন বা জয়েন্ট থেকে ছুটে যেতে পারে।
(৩) বাচ্চাদের জন্মের সময় হাড় ভেংগে যেতে পারে।
(৪) ছোট বাচ্চাদের হাত ধরে উঠানোর সময় জোরে টান লাগার কারণে কাঁধে সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের কাঁধ ধরে উঠাতে পারেন।
(৫) ব্যায়াম করার সময় অধিক চাপের কারণে মাংস পেশি বা লিগামেন্টস আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। ক্রিকেট খেলায় যারা স্পিডে বল করে তাদের সমস্যা হতে পারে।
কাঁধের হাড় ফেটে যাওয়া বা ভেঙ্গে যাওয়াঃ
আঘাতে থেকে অনেক সময় হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে বা ফেটে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয়। অনেক সময় সূক্ষ্ম ফাটল খেয়াল করা হয়না। সেক্ষেত্রে তা দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথায় রূপান্তরিত হতে পারে। কাঁধের হাড়ের ইনজুরির মধ্যে সাধারণ ভাবে ক্লাভিকল বা কলার বোন আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ব্যথা হতে পারে। আবার কাঁধের হাড় বিশেষ করে বাহুর হাড় ফেটে ব্যথা হতে পারে। সাধারণত বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ধরণের ঝুঁকি বেশি। অস্টিও-পোরোসিস (হাড়ের একটি রোগ) এর কারণে হাড় ভঙ্গুর হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি খাওয়ার দরকার হতে পারে।
ফ্রোজেন শোল্ডারঃ
ফ্রোজেন শোল্ডার কাঁধের একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত মাঝ বয়েসী থেকে অধিক বয়েসীদের এটা হতে পারে। এক্ষেত্রে কাঁধের জয়েন্টে প্রথম দিকে ভেতরের আবরণীতে প্রদাহ হয়ে ব্যথা অনুভূত হয়। যে কারণে হাত নাড়াচাড়া করা থেকে বিরত থাকেন আক্রান্ত ব্যক্তি। দীর্ঘ দিন এই সমস্যা থাকলে কাঁধের জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়। তখন চাইলেও নাড়ানো যায় না, প্রচন্ড ব্যথা হয়।
কারা ফ্রোজেন শোল্ডারের জন্য ঝুঁকিতে থাকেনঃ
বয়স ৪০ বা তদোর্ধ্ব তারা এই সমস্যার ঝুঁকিতে থাকেন।
- যে সকল কারণে কাঁঁধের নড়াচড়া কমে যায়, যেমন- রোটেটর কাফ ইনজুরি, হাত ভেংগে যাওয়া, স্ট্রোক এর কারণে ও অপারেশন জনিত কারণে দীর্ঘদিন কাঁধের নড়াচড়া কমে যাওয়া।
- বিভিন্ন রোগের কারণে হতে পারে, যেমন- ডায়াবেটিস, থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, হৃদরোগ, যক্ষা ও পারকিন্সন রোগ।
- যারা দীর্ঘদিন অস্টিওআরথ্রাইটিস বা রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিস (হাড়ের রোগ) এ ভুগে থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে।
কিভাবে ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়ঃ
একটু সতর্ক থাকলেই আমরা এই সমস্যা থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
১/ আঘাত জনিত সমস্যা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা।
২/ নিয়মিত কাঁধের ব্যায়াম কাঁধকে ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩/ কাঁধ বা শোল্ডার যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ, তাই এর কোন সমস্যাকে হালকা করে না দেখা। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া। শুধু ব্যথার ঔষধ খেয়ে চিকিৎসা নিজে নিজে না করা।
ফ্রোজেন শোল্ডার হয়ে গেলে সমাধানঃ
এক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে কাঁঁধ নড়াচড়া করানো। যেহেতু ব্যথা হয়। ব্যথা দূর করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে যারা ব্যথার চিকিৎসা করেন তাদের পরামর্শ নিয়ে লোকাল ইনজেকশন নিয়ে ব্যথা কমিয়ে নিয়ে নিয়মিত এক্সারসাইজ বা কাঁধের ব্যায়াম করে এই ফ্রোজেন শোল্ডার থেকে রেহাই পেতে পারেন। নিয়মিত ফিজিওথেরাপি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
কাঁধের ব্যথায় এক্সারসাইজ বা ব্যায়ামঃ
যে কোন ব্যথায় এক্সারসাইজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(১) এক্সারসাইজের মাধ্যমে মাংসপেশি গুলোর স্ট্রেস নেয়ার ক্ষমতা বাড়ে। রক্ত চলাচল বাড়ে। এর ফলে টেনডন ও লিগামেন্টস ভালো পুষ্টি পেয়ে থাকে। নড়াচড়াও স্বাভাবিক থাকে।
(২) এক্সারসাইজের মাধ্যমে শরীর থেকে এনডরফিন নামক পদার্থ বের হয়, যা প্রাকৃতিক ব্যথা নাশক হিসাবে কাজ করে।
(৩) এক্সারসাইজের মাধ্যমে এনকেফালিন নামক পদার্থ বের হয়, যা মানসিক চাপ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
যে সকল এক্সারসাইজ আমাদের কাঁধকে ভালো রাখতে পারে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোঃ
শোল্ডার ওয়ার্ম আপ:
শোল্ডার কে রিল্যাক্স করুন। কয়েকবার সামনের দিকে কয়েকবার পেছনের দিকে ঘুরিয়ে আনা নেয়া করুন। ১৫-৩০ সেকেন্ড ধরে করুন।
এক্রোজ দা চেস্ট স্ট্রেস:
আপনার ডান হাতটি সোজা করে আপনার বুকের বরাবর রাখুন। এবার বাম হাত দিয়ে ডান হাতের কনুই বরাবর ধরে বুকের বাম পাশের দিকে চাপ দিন ও ধরে রাখুন ১০-১৫ সেকেন্ড। পদ্ধতিটি উভয় হাত ব্যবহার করে ৩-৫ বার করুন।
শোল্ডারের পেছনের দিকের অংশে স্ট্রেস:
আপনার ডান হাত দিয়ে বাম কাঁঁধকে ধরুন বা স্পর্শ করুন। এবার বাম হাত দিয়ে কনুইয়ের পেছন থেকে চাপ দিন ও ধরে রাখুন ১০-১৫ সেকেন্ড। অপর হাতে বিষয়টি একই ভাবে করুন। পুরো পদ্ধতিটি ৩-৫ বার করুন।
ট্রাই সেপস স্ট্রেস:
এটাতে বাহুর পেছনের মাংশপেশীতে স্ট্রেস দেওয়া হয়। আপনার ডান হাত উঁচু করে ডান হাত দিয়ে ডান কাঁধের পেছনের অংশ স্পর্শ করুন। এবার বাম হাত দিয়ে চাপ দিন ও ধরে রাখুন ৫-১০ সেকেন্ড। এভাবে অপর পাশে করুন।
রোটেটর কাফ স্ট্রেস:
ডান হাত কাঁধ ও কনুই বরাবর ৯০ ডিগ্রি কোণে বা সমকোণ এ রাখুন। এবার বাম হাত দিয়ে বাহু বরাবর ধরে বাম পাশে চাপ দিন, একই সাথে ডান হাত ডান দিকে নেওয়ার চেষ্টা করুন, একই সাথে হাত সোজা রাখুন। ৩-৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন। অপর হাত দিয়ে একইভাবে করুন। ৩-৫ বার পদ্ধতিটি করুন।
পেক্টরালিস স্ট্রেস:
দুই হাত পেছনের দিকে নিন। দুই হাতের তালু একত্রিত করুন। এবার দুই হাত সোজা করুন এবং ধরে রাখুন ৫-১০ সেকেন্ড।
আপার ট্রাপ স্ট্রেস:
বাম হাত বাম উরুর নিচে রাখুন। ডান হাত দিয়ে মাথার উপর দিয়ে কান স্পর্শ করুন। এবার মাথা ও ঘাড়কে ডান পাশে চাপ দিন ও ধরে রাখুন ৫-১০ সেকেন্ড। এভাবে বাম পাশে করুন। পুরো প্রক্রিয়াটি ২-৩ বার করুন। এতে কাঁধ ও গলা স্ট্রেস হবে। মাথায় ও ঘাড়ে রক্ত চলাচল বেড়ে যাবে।
কখন ব্যায়াম করবেন নাঃ
১) ব্যায়ামের সময় হাতে বা কাঁধে ব্যথা হলে।
২) ফ্রোজেন শোল্ডার অনুভব হলে।
৩) হঠাত আঘাত পেলে।
৪) অতিরিক্ত চাপের এক্সারসাইজ করবেন না, যাতে এক্সারসাইজের মাধ্যমে আঘাাত হতে পারে।
অধিক বয়স্করা কিভাবে ব্যায়াম করবেনঃ
অধিক বয়স্ক যারা ঘর থেকে বের হতে পারেন না অথবা বিভিন্ন সমস্যার কারণে বাসায় থাকতে হয়, তারা বিভিন্ন জয়েন্টস বা হাড়ের ব্যথায় ভুগে থাকেন, নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়। এদের ক্ষেত্রে অন্য কোন ব্যক্তি তাকে বা তার জয়েন্টসগুলোকে নড়াচড়া করিয়ে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে খুব সাবধানের সাথে করাতে হবে। তাদের ক্ষেত্রে অধিক চাপ দিয়ে নড়াচড়া করানো যাবেনা। শুধু স্বাভাবিক নড়াচড়া করাতে হবে।
সঠিক জীবনযাত্রার নিয়ম মেনে হাত ও পায়ের হাড়ের যত্ন নিতে হবে। কোন রকমের কোন আঘাত বা ব্যথাকে অবহেলা না করে, সঠিক চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।