৩০ মার্চ, ২০২০
ডা. জহির সাদিক
এমবিবিএস, ডিসিএইচ, এমসিপিএস, এফসিপিএস
শিশু বিশেষজ্ঞ, জাবের আল আহমেদ আর্মড ফোর্সেস হাসপাতাল, কুয়েত
আমি যে হাসপাতালে আছি এখানে একটা ফাস্ট ফুড কর্ণার আছে। সেখানে আমেরিকান কোম্পানি স্টারবাকসের কফি পাওয়া যায়।
কফি নাম শুনলেই কল্পনাতে মান্না দের সেই কফি হাউজের আড্ডার লাইনগুলো ভেসে উঠে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখানে আড্ডার আ-ও নেই। ব্যস্ত ডাক্তার এবং নার্সরা যে যার মতো কফি হাতে যার যার নিজস্ব রুমে ঢুকে পড়ছে। করোনার কারনে সবাই একটু বেশি মাত্রায় সাবধান। কেউ কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে চাইছে না। অবিশ্বাস এখন সার্বজনীন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকেই হয়তো ভাবছে আমি বাদে পৃথিবীর সবাই ভাইরাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সপ্তাহখানেক ধরে করোনা ভাইরাসের কারনে স্টারবাকস মেডিকেল স্টাফদের জন্য ফ্রি কফি সার্ভিস অফার দিয়েছেন। উদ্দেশ্য মেডিকেল স্টাফদেরকে করোনার সাথে লড়াইয়ে উৎসাহিত করা। তাদের মনোবল কে চাংগা করে রাখা। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ প্রতিদিন ডিউটির ফাঁকে এক কাপ কফি এনে আয়েশ করে একটু সময় দিয়ে সেটাতে চুমুক দিই। ফ্রি জিনিসের স্বাদই অন্যরকম। কেমন জানি গা টা দ্রুত চনমন হয়ে উঠে। অথচ আগে পকেটের পয়সা খরচ করে কফিতে চুমুক দেবার সময় শরীরের মধ্যে অমন চনমনে ভাবটা ঠিক আসতো না।
এভাবে কয়েকদিন ভালোই চলছিল। কিন্তু আজ সকালে ডিউটিতে এসে মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। করোনা বিস্তার রোধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফাস্ট ফুড কর্ণারটি বন্ধ করে দিয়েছেন। সুতরাং আজ থেকে ফ্রি কফিতে আর চুমুক দেয়া হচ্ছে না। মাত্র কয়েকদিনে কেমন জানি কফির নেশাটা পেয়ে বসেছিল।
আমার সাথে কুয়েতি এক সিস্টার ডিউটিতে আছেন।
আমার চেহারা দেখে মন খারাপ কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম এবং কফিশপটি বন্ধ হয়ে যাবার বিষয়টি তাকে খুলে বললাম।
কোন কথা না বাড়িয়ে সিস্টার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। বলে গেলেন যে পনেরো মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবেন। মিনিট পনেরো পর সিস্টার একটা কফির মগ হাতে নিয়ে ঢুকলেন। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,”এটা আপনার।”
মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিতেই পুরো শরীর এবং মনের সতেজতা ফিরে আসলো। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ কফিতে চুমুক দেবার ফাঁকে ফাঁকে সিস্টারকে ধন্যবাদ দিতে থাকলাম।
আমার ধন্যবাদ দেবার ফ্রিকোয়েন্সী দেখে সিস্টার ভদ্রমহিলা বলতে বাধ্য হলেন, “এত বেশি ধন্যবাদ দেবার দরকার নেই.. Don’t think that I’ll give you a mug of coffee every day. This is the first and this is the last.”
সিস্টারের মুখ থেকে এমন ঠাস ঠাস ইংরেজি শুনে ধন্যবাদ দেয়া আপাতত বন্ধ রাখলাম।
এরমধ্যে এক বৃদ্ধ তার সাত বছরের অসুস্থ নাতি ছেলেকে নিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন। বৃদ্ধের মুখে কোন মাস্ক নেই।
বললাম, “মাস্ক পরেননি কেন?”
বৃদ্ধ স্ফীত এক হাসি দিলেন। আকাশের দিকে ইংগিত করে বললেন, হায়াত মউত সব উনার হাতে। মউত যখন আসবে তার এক সেকেন্ড আগে কিংবা পরে হবে না। বৃদ্ধের উপর কিঞ্চিৎ রাগ হলো। আমি কোন কথা বাড়ালাম না। মনে হলো এই ধরনের মানুষদেরকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই।
আমি বাচ্চাটাকে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলাম।
যাবার সময় বৃদ্ধ আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “তবে তুমি সাবধানে থাকবা.. তোমার প্রটেকশনে থাকার খুব দরকার.. এইসময় তোমরা সুস্থ থাকলে অনেক মানুষ তোমাদের থেকে বেঁচে যাবে। আল্লাহ তোমাদের সবাইকে সুস্থ রাখুক, ভালো রাখুক। তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করছি বাবা।”
আমি ভিনদেশী এক বৃদ্ধের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনে কিছুটা ইমোশনাল বোধ করলাম। হঠাৎ করে দেশে থাকা আমার বৃদ্ধ বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়লো। এখনো যারা তাদের দিন এবং রাতের বেশিরভাগ সময় আমাকে এবং আমার পরিবারকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে সময়গুলো কাটিয়ে দেন।
তবে এটা ঠিক যে আজকের এই বৃদ্ধ বাবার সামান্য ওই ভালো কথাটুকু আমার কাছে স্টারবাকসের একশো মগ ফ্রি কফির চেয়েও অ-নে-ক কিছু।।
এইসময়ে আমরা সবাই সবার জন্য দোয়া করি। পুরো পৃথিবীর সুস্থতার জন্য দোয়া করি।।