৭ এপ্রিল, ২০২০
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় গতকাল বিভিন্ন খাতে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে জীবন বাজি রেখে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা সেবা যারা দিচ্ছেন, সেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের দুবেলা খাবারের বিষয়ে সরকারিভাবে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রকার বরাদ্দ নেই! গত শুক্রবার চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশনে থাকা এক ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। সেখানে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য স্টাফসহ মোট ১৭ জনকে গতকাল থেকে আলাদা (কোয়ারেন্টাইনে) থাকতে হচ্ছে। নগরীর আসকার দিঘীর পাড়ের আঞ্চলিক লোকপ্রশাসন কেন্দ্রে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন তাঁরা। করোনা মোকাবেলায় গঠিত জেলা পর্যায়ের কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের সেখানে রাখা হচ্ছে।
তবে আলাদা রাখতে স্থান নির্ধারণ করলেও এসব স্বাস্থ্য কর্মীদের খাবারের ব্যবস্থার বিষয়ে কোনো ধরনের বরাদ্দ দেয়া হয়নি। যদিও কমিটি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও এ বিষয়ে আলাদা কোনো বরাদ্দ বা তহবিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেয়নি। এ অর্থের সংস্থান কিভাবে হবে, সে বিষয়েও কোনো কিছু বলা হয়নি। আর আলাদা কোনো বরাদ্দ না থাকায় চিকিৎসকদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেই এসব স্বাস্থ্য কর্মীর খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ কাজ করছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের মাঝে। সরকারের ঘোষিত হাজার কোটি টাকার প্রণোদনায় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য ঝুঁকি ভাতা বা বীমার সুবিধা থাকবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন চিকিৎসক নেতারাও। কিন্তু সরকারের ঘোষণার পর এ নিয়ে হতাশ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা।
করোনা মোকাবেলায় গঠিত জেলা পর্যায়ের কমিটির সদস্য সচিব ও চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বিও বলছেন, জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে আপাতত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে এ বাবদ কোনো ধরনের বরাদ্দ দিতে না পারার বিষয়টি অস্বীকার করেননি সিভিল সার্জন। তাঁর দাবি- এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে একটু সময় প্রয়োজন।
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী বলছেন, জীবন বাজি রেখে যেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত, তাঁদের জন্য ঝুঁকি ভাতা বা বীমা সুবিধা সরকার ঘোষণা করবেন বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু এসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের খাবারের ব্যবস্থার জন্যও কোনো বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অথচ, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিল্লীর সরকার করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মীদের পাঁচ তারকা হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের দাবি- আমাদের এখানে এসব স্বাস্থ্য কর্মীদের নিরাপত্তা, যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাটা সরকারের তরফ থেকেই করতে হবে। সরকারের পক্ষে জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ের কমিটি এ ব্যবস্থা করুক।
জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আইসোলেশন ওয়ার্ডে (করোনা রোগীর সেবায়) দায়িত্ব পালন করা ১৭ জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। টানা ৭দিন দায়িত্ব পালন করার পর রোববার (গতকাল) থেকে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে যেতে হয়েছে এসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের। এসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী এই ১৪ দিন পরিবার থেকেও দূরে থাকবেন। অন্য কারো সাথেও মিশতে পারবেন না। ১৪ দিন পর পুনরায় দায়িত্ব পালনে হাসপাতালে ফিরে যাবেন।
শুক্রবার প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর গতকাল করোনা আক্রান্ত দ্বিতীয় রোগীকেও নেয়া হয়েছে জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে। সেখানেই করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা চলমান থাকবে। করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে ইতোমধ্যে চারটি বিশেষ টিম গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে দুটি টিমে ৬ জন করে এবং বাকি দুটি টিমে ৫ জন করে সদস্য রয়েছেন। ১৭ জনকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর পর বর্তমানে আরো ২০ জন চিকিৎসা সেবার দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানালেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ। সবমিলিয়ে ৪০ জনের খাবারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে বলেও জানান হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক। যদিও চাঁদা তুলে খাবারের ব্যবস্থার বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি তিনি। তাঁর দাবি- কোয়ারেন্টাইনে যারা আছেন, তাদের নাস্তার জন্য হয়তো নিজেদের কিছু দিয়ে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। তবে করোনা রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত এক চিকিৎসক বলছেন, স্বাস্থ্য কর্মীদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার স্থানটি নিয়েও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তাঁরা কোথায় থাকবেন এ নিয়ে। অথচ অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছ থেকে জোরালো তৎপরতা দেখা যায়নি। এখন স্থান নির্ধারণ করা হলেও খাবারের বিষয়ে কোন বরাদ্দ দেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চিকিৎসক বলেন, করোনা রোগীর সেবা দেয়ার সময় স্বাস্থ্য কর্মী বা চিকিৎসকের সক্রমনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যার কারণে রোগীর সেবা দেয়ার পর বাধ্যতামূলক ভাবে আলাদা থাকা প্রয়োজন। নয়তো তাদের কাছ থেকে অন্যদেরও সংক্রমণ হতে পারে। তাই সতর্কতা ব্যবস্থা হিসেবেই এসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রয়োজন। এ জন্য সরকার চাইলে কোনো একটি ভালো মানের হোটেল ঠিক করতে পারতেন। যদিও আঞ্চলিক লোকপ্রশাসন কেন্দ্র ছাড়াও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির একটি হোস্টেল এবং কাস্টমস ট্রেনিং হাউজকে নির্ধারণ করেছে করোনা মোকাবেলায় গঠিত জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কমিটি।
চিকিৎসক নেতা ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন করোনা রোগীর সংখ্যা কম। কিন্তু রোগীর সংখ্যা বাড়লে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। সেটি হলে আরো বেশি সংখ্যক স্বাস্থ্য কর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে কোন বরাদ্দ না পেলে এসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের খাবারের বিষয়টি নিয়ে ভুগতে হতে পারে।
প্রসঙ্গত, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় চট্টগ্রামে দুটি হাসপাতাল নির্ধারণ করেছে করোনা মোকাবেলায় গঠিত জেলা পর্যায়ের কমিটি। চট্টগ্রামের জেলাপ্রশাসক এই কমিটির সভাপতি, আর সিভিল সার্জন সদস্য সচিব।
নির্ধারণ করা দুটি হাসপাতালের একটি ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতাল, অপরটি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় প্রস্তুতি হিসেবে বিআইটিআইডি হাসপাতালের ৫০টি এবং জেনারেল হাসপাতালের ১০০টি আইসোলেশন শয্যা এরই মধ্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। থাকার পর পুনরায় দায়িত্ব পালনে হাসপাতালে ফিরে যাবেন ওই টিমের সদস্যরা। নির্ধারিত দুটি হাসপাতালে এভাবেই চলবে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা।
এই ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকদের ফেসবুকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। করোনা ইউনিটে কাজ করা ডাক্তার-নার্সসহ সর্বস্তরের স্বাস্থ্যকর্মীগণ নিজের ঘর ছেড়ে এসে কাজ করছেন। এসময় নিজেদের মধ্যে আবার রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে নিজেদেরও চিকিৎসার প্রয়োজন পড়বে। করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেদের সংক্রমিত হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। সেক্ষেত্রে সংক্রমিত হয়ে গেলে অতিরিক্ত ১৪ দিন থাকা লাগছে কোয়ারেন্টাইনে। ৭ দিন করোনা ইউনিটে ডিউটির পাশাপাশি ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন; সবমিলিয়ে আপনজন থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন প্রায় ২১ দিন!!
সর্বোপরি মানসিক চাপ, অসুস্থ হলে শারীরিক সমস্যা, প্রাণহানির শঙ্কা এসবের মুখেও আবার অন্নসংস্থানের চিন্তা নিয়ে তারা অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন। ঘরবাড়ি ছেড়ে এসে পড়ে থাকা চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর বিড়ম্বনা দ্রুত লাঘবের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁরা।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ অংকন বনিক জয়