প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ জুন, ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. তানিয়া হাফিজ
জেড. এইচ. সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল
সেশনঃ ২০০৩-০৪
চেম্বারে আমি যেসব গর্ভবতী মায়েদের চেকআপ করি তারা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকেন।
কেউ আছেন প্রেগনেন্সি প্রোফাইল টেস্ট দিলে আমার প্র্যাকটিসিং চেম্বারে করতে না চাইলে জিজ্ঞাসা করেন,
“ম্যাম টেস্ট অন্য জায়গা থেকে করলে হবে? আমি পপুলার/ এনাম/ ল্যাবএইড/ প্রাইম/ ল্যাবজোন/ ইউনিক/ সাইক ইত্যাদি স্থান থেকে করাতে চাচ্ছি।”
(আমার চেম্বারের আশেপাশে এগুলো আছে।)
আমি বলি,
“অবশ্যই হবে। ভাল কোন ডায়াগনোস্টিক সেন্টার অথবা হাসপাতাল থেকে করবেন, যেখানের রিপোর্ট গ্রহনযোগ্য।”
বিঃদ্রঃ এমন গর্ভবতীরা খুবই সচেতন। দেখা যায় নিজেরাই বলেন ২-৩ মাস পরপর ম্যাম আমাকে পরীক্ষা দিন। একটুতেই অস্থির হয়ে যান। ফোন করেন অথবা চেম্বারে চলে আসেন।
এক ধরনের গর্ভবতী আছেন যাদের টেস্ট করতে দিলে বলেন,
“ম্যাম আমি কোন টেস্ট করতে পারব না। আগের বাচ্চার সময়ও টেস্ট করি নাই। আর তাছাড়া আমাদের টাকাপয়সাও নাই টেস্ট করার মতো, শুধুমাত্র আল্ট্রা করবো ৬মাসে।”
বিঃদ্রঃ এই গর্ভবতীরা ১ মাস চেকআপে আসলেন, পরের ৩-৪ মাসে খোঁজ নাই। হঠাৎ ৪ মাস পরে একবার আসেন, আর একেবারে ৭ অথবা ৮ মাসে। এসে আল্ট্রা করেন পজিশন আর ছেলে নাকী মেয়ে জানার জন্য!
এবার শুনুন আরেক ধরনের গর্ভবতীদের কথা। বলেন,
“ম্যাম টেস্ট করবো, কিন্তুু এখন নয়। ৭-৮ মাসের দিকে করবো। অথবা ম্যাম বেতন পাই নাই। অথবা ম্যাম এখন না করলে হয় না? অথবা ম্যাম ঠিক যে টেস্টগুলো এখন প্রয়োজন সেগুলো দিন। ম্যাম, এতো টাকাতো এখন নাই। অথবা ম্যাম এখন আল্ট্রাটা করি, পরে অন্যগুলো করবো। নাহয় ম্যাম, এই ৭ টা টেস্ট থেকে কয়েকটা কমিয়ে দিন।”
চেম্বারে রোগী দেখতে গেলে এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের এসব পরিস্থিতিতে সহনশীল হতে হয়। সঠিক কাউন্সেলিং করেই তাদেরকে বোঝাতে হবে পরীক্ষাগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কেন করতে হবে, কখন করতে হবে, না করলে কী ক্ষতি হতে পারে, করলে কী সুবিধা তা বোঝাতে হবে।
প্রথম চেকআপে যে পরীক্ষাগুলো লিখতে হবে এবং যেভাবে পরামর্শ দিবেনঃ
CBC
রক্তের পরিমাণ (হিমোগ্লোবিন) কত জানা যায়। যদি কম হয়, এখনই চিকিৎসা করে সঠিক পরিমাণে আনা যায়। শেষের দিকে পরীক্ষা করলে, তখন বৃদ্ধি করা কঠিন হয়। আবার এর মাধ্যমে রক্ত কতটা কম, শুধু ঔষধ দিয়ে নাকি রক্ত বৃদ্ধির ইনজেকশন দিয়ে অথবা সরাসরি রক্তদানের মাধ্যমে বৃদ্ধি করা যাবে- তা বোঝা যায়। অনেক কম থাকলে থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা সেটা অন্য আরেকটা পরীক্ষা করে জানা যাবে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা রোগ।
এছাড়া রক্তে কোন ইনফেকশন আছে কিনা, থাকলে কী ধরনের রোগ জানা যাবে। সেটা সমাধান করলে আপনার ও আপনার শিশুর জন্য ভালো। ESR নামে যে উপাদান আছে এর বৃদ্ধির মাধ্যমে আপনার কী কী রোগ হতে পারে এটা আমরা সন্দেহ করে, সেই অনুযায়ী অন্য পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে সঠিক চিকিৎসা করতে পারি।
রক্তের পরিমাণ শেষের দিকে আরেকবার করতে হয়।
Blood Grouping Rh-typing
রক্তের গ্রুপ জানা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে হবে। আপনি যদি এখন টেস্ট করে জেনে রাখেন আপনার রক্তের গ্রুপ কী তাহলে সেই গ্রুপের ১/২ জনকে এখন থেকেই রেডি রাখতে পারবেন। যখন ডেলিভারি হবে তখন প্রয়োজন হলে তাকে কল দিলেই সমাধান। নয়তো ডেলিভারির ঐ ইমার্জেন্সির সময় আপনি ডোনার পাবেন না/খুঁজতে হবে। আর যদি নেগেটিভ গ্রুপ হয় তাহলে তো আরো সমস্যা।
RBS
এটা হলো ডায়াবেটিস এর টেস্ট। রোগী বলেন, “আমারতো ডায়াবেটিস নাই।” বলতে হবে, “আপনার আছে কি নাই সেটা বিষয় না। গর্ভকালীন সময় এটি করতে হবে। কারণ এমন অনেকেই আছেন যাদের আগে ডায়াবেটিস ছিল না, কিন্তুু গর্ভকালীন সময়ে পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে। আর যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে এর চিকিৎসা করতে হবে, নয়তো এটা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।
HBsAg
এই পরীক্ষাটা হল হেপাটাইটিস-বি এর। এটি করে জেনে রাখলে ডেলিভারির সাথে সাথে নাড়ি কাটার সময় বাচ্চার রক্তের পরীক্ষা করা হয়। এরপর শিশুকে ভ্যাকসিনও দেওয়া হয় তখন।
VDRL
মায়ের মধ্যে কোন যৌনরোগের জীবাণু আছে কিনা এটা জানা যায় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। কিছু জীবাণু আছে যা মায়ের শরীর থেকে গর্ভের সন্তানের মধ্যে যায়। তাই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে।
Urine R/M/E
রোগীরা এটা শুনলেই অনেকে ভুল করে বলেন ম্যাম এটাতো আমি করেছি। তারা বুঝাতে চান Urine for pregnancy test/Pregnancy strip test এর কথা। যখন বলা হয় তখন বোঝেন। এই পরীক্ষা করে আপনার প্রসাবে কোনো ইনফেকশন আছে কিনা জানা যায় (অনেকের পেট ব্যথা, প্রসাবে জ্বালাপোড়া হয়)। আর এই ইনফেকশনের চিকিৎসা না করলে আপনার ও গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। এ পরীক্ষা থেকে প্রসাবে সুগার যায় কিনা তাও জানা যায়, কিডনির সমস্যা কিছুটা বুঝা যায়।
USG of P/P
দেখা যায় আপনারা শেষের দিকে আল্ট্রা করতে চান, শিশু ছেলে না মেয়ে এটা জানার জন্য। কিন্তু আল্ট্রাসনোগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে।
প্রথমদিকে করলে জানতে পারবেন-
- গর্ভে কয়টা স্যাক আছে, অর্থাৎ গর্ভে কয়টা শিশু রয়েছে।
- স্যাকের বর্ডার ঠিক আছে কিনা
- প্রেগনেন্সি কনফার্ম করা
- এখন কত সপ্তাহ চলছে
- এক্টোপিক প্রেগনেন্সি কিনা
- ডেলিভারী তারিখ
- জরায়ু বা ডিম্বাশয়ে কোন সিস্ট, টিউমার বা অন্য সমস্যা আছে কিনা
- ডাউন সিন্ড্রোম ডায়াগনোসিস
মধ্যবর্তী সময়ে আল্ট্রা করলে-
- বাচ্চার অঙ্গপ্রতঙ্গের কোনো সমস্যা আছে কিনা এনোমালি স্ক্যান করে জানা যায়।
- পেটে এম্নিওটিক ফ্লুইডের পরিমান
- বাচ্চার মুভমেন্ট সম্পর্কে জানা
- বাচ্চার ওজন
- গর্ভফুলের পজিশন জানা যাবে।
শেষের দিকে আল্ট্রা করার সুবিধা-
- বাচ্চার ফিক্সড পজিশন,
- শিশুর সঠিক ওজন জানা যাবে।
এসব পরীক্ষার গুরুত্ব রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের জানাতে হবে। তাহলেই গর্ভকালীন সময়ে মায়েরা পরীক্ষাগুলো করার প্রস্তুতি নিবেন। আমি আমার রোগীকে এভাবে কাউন্সেলিং করি।