প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩০ নভেম্বর ২০২০, সোমবার
ডা. কাওসার উদ্দিন
সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন)
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
নিরাপত্তা নাই, তার প্রধান কারণ কেউ নিরাপত্তা বিঘ্ন করলে তার তেমন কোন শাস্তি হয় না! এই যেমন ধরুন উপজেলার কোন পাতি নেতা তার অযৌক্তিক দাবি আদায় হয়নি দেখে বা চিকিৎসায় ভুল হয়েছে দাবি করে চিকিৎসকের উপর চড়াও হয়। এসব ঘটনার কোন বিচার হয় না, যা হয় তা হল সমঝোতা। বিচার না হওয়ার পিছনে দায়ী চিকিৎসকদের ক্ষমতাহীনতায় আইনের উদাসীনতা। পাশাপাশি আছে অনেক চিকিৎসকেরও উদাসীনতা, তারা চিন্তা করে ঝামেলায় গিয়ে লাভ নাই বরং এতে নিজের ঝামেলা বাড়বে, তাই তারাও পরে মিটমাটেই সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু যদি এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হত, থাকতো তেমন কার্যকর আইন, তবে কিন্তু এমন দুর্বৃত্ত মানসিকতার বাকি যারা আছে তারাও তখন সতর্ক হত। চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলার আগে শাস্তির ভয়ে ভীত হত, কমে যেত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
এরপরে আসি রোগী ও রোগীর স্বজনদের মানসিকতা নিয়ে। রোগ নিয়ে তারা খুব টক্সিক থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের টক্সিসিটি কমাতে বড় একটি বিষয় হল ”কমিউনিকেটিং এন্ড কাউন্সেলিং”। যে বিষয়ে আমাদের চিকিৎসকদের অনেক ঘাটতি আছে। এই ঘাটতির অনেকটাই আবার অনিচ্ছাকৃত যেমন- কোন চিকিৎসকের উপর যখন মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপ পড়বে, তখন এটা তার পক্ষে একদমই অসম্ভব সবাইকে যথোপযুক্ত কাউন্সেলিং করা। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে এই বিষয়টি প্রকট। কারণ সেখানে অত্যধিক রোগীর চাপ বাড়লেও নতুন পদ সৃজন করে সে অনুপাতে চিকিৎসক সংখ্যা বাড়েনি। সরকারি, বেসরকারি এই দুটো ক্ষেত্রেই আর যে প্রকট সমস্যাটি এর পিছনে দায়ী সেটি হল আমাদের দেশে কোন নিয়মতান্ত্রিক রেফারেল সিস্টেম চালু নেই। এটি চালু হলে একদিকে জিপি পোস্ট যেমন বাড়তো, তরুণ এমবিবিএস চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হত অন্যদিকে কমে যেত হাতুড়ে চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার তৎপরতা, সব মিলিয়ে উপকৃত হত মানুষ। জিপি লেভেল থেকে এসেন্ডিং অর্ডারে রোগী বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতো আর এতে বিশেষজ্ঞদের কাছে সাধারণ রোগীদের চাপ কমতো, প্রোপ্রার পেশেন্ট ডিস্ট্রিবিউশন হতো, আর এর ফলে রোগীদের ইভালুয়েশন যেমন আরো বেশি ভাল হতো, চিকিৎসকরাও সময় পেত সব রোগীর সাথে নিয়মমাফিক কথা বলার। আর এতেই একটি সুষম সুন্দর সিস্টেম গড়ে উঠতো। কিন্তু বর্তমানে এদেশে এগুলো একদমই নাই। আর এর ফলে রোগীদের মাঝে অসন্তোষ ধীরে ধীরে বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে তাদের চিকিৎসায় কোন অনিচ্ছাকৃত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তারা অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছে সহজে, হচ্ছে মারমুখী। হেলথ ট্যুরিজমও এর পিছনের একটি কারণ। অনেকে ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে, যাদের চিকিৎসা আমাদের চেয়ে ভাল না খারাপ সে হিসাবে যাবো না। কিন্তু তারা ভালভাবে রোগীদের সাথে কথা বলছে, সময় নিয়ে কথা বলার মত সিস্টেম তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় তারা রেখেছে। আর তাই সেখান থেকে রোগী ফিরে সেদেশের সাথে আমাদের দেশের চিকিৎসকদের ব্যবহারের পার্থক্য নির্ণয় করছে এবং এদেশের অনেক চিকিৎসকদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা বা অভ্যাসের দরুণ তাদেরকে সময়দান ও তাদের প্রতি করা ব্যবহারের সমালোচনায় লিপ্ত হচ্ছে। এর সমাধান একটাই, রোগীরা যেভাবে চায়, যতটুকু সময় কথা বললে তারা সন্তুষ্ট হবে ততটুকু সময় যেন তাদের দেয়া যায় সেভাবে আমাদের সিস্টেম ডেভেলপ করা। এতে রোগীদের অসন্তোষ ধীরে ধীরে কমে আসবে, কমবে চিকিৎসকদের নিরাপরত্তাহীনতা।
এবার আসি চিকিৎসকদের বিষয়ে। অনেক মেডিকেল, অনেক ডাক্তার। কিন্তু এই অনেক ডাক্তারদের সবার মানই এক রকম না। মেডিকেলের যথোপযুক্ত মান বজায় রাখার দায়িত্ব যথাযথ কর্তৃপক্ষের। তারা যদি শুধু মেডিকেল অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে, কিন্তু পরবর্তীতে ঠিকভাবে তারা তাদের মান বজায় রাখতে যথাযথ নিয়মের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে কিনা সেসব বিষয় দেখভাল না করে তবে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা চিকিৎসক বের হলেও গুনগত মানসম্পন্ন চিকিৎসক বের হবে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিষয়গুলো যখন এমন একটি পেশায় অনেকের পাশ, পোস্টিং, প্রমোশনের নিয়ামক হয় তখন তাদের মানে ঘাটতি থাকবেই। এই বিষয়গুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। উন্নত দেশগুলোর সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। আর এসব যদি ঠিকমত করা যায়, তাহলে যে অল্পকিছু ভুল চিকিৎসা দেয়ার মত ঘটনা ঘটে সেগুলো আর ঘটবে না, বাড়বে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা। সরকারি বেসরকারি চিকিৎসা সিস্টেমে চিকিৎসক বান্ধব হতে হবে। আর এতে উভয় ক্ষেত্রে হাসপাতালের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কার্যকর আইন প্রনয়ণ এবং এরকম কোন ঘটনায় আইনের দ্রুত প্রয়োগ ও বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সামগ্রিক অবদানগুলো সরকারী, বেসরকারী ও গোষ্ঠীগত বৃহত্তর গ্রুপগুলোকে মিডিয়ায় বারবার প্রচার করতে হবে। প্রচার করতে হবে চিকিৎসক নিগ্রহ হলে তার শাস্তির বিষয়গুলো।
সর্বোপরি, সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে হবে। যে স্বাস্থ্য সিস্টেমের পাশ, পদোন্নতি, পোস্টিং এর অনেক কিছুই তোষামোদি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নির্ভর, সেই সিস্টেমের পরিবর্তন অসম্ভব। যে সিস্টেমে দুর্নীতি সীমাহীন এবং নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের কাছে অসহায় হয়ে থাকতে হয়, সর্বোচ্চ অফিসে সাহায্য ও সহযোগিতার চেয়ে হতাশ ও হয়রানি হতে বেশি সে সিস্টেমের পরিবর্তন অসম্ভব। চিকিৎসক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আগে এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। আর অতি সম্প্রতি, রোগীর স্বজনদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রমাণের পূর্বেই একটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের কোন চিকিৎসককে নিয়ে মানহানীকর বক্ত্যবের প্রচার, যা সমগ্র চিকিৎসকদের উপর সাধারণ মানুষের নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তাকে তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকেই হাতে হাতকড়া পড়িয়ে গ্রেফতার করে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। সরকারি কোন সিস্টেম যখন এমন চিকিৎসক নিপীড়ন মূলক কাজ করবে তখন সেই সিস্টেম চিকিৎসক নিরাপত্তায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আশা করাটা দূরাশার শামিল।
তাই এই সিস্টেমগুলোর মানে ও নিয়ন্ত্রণে পরিবর্তন আনতে হবে, শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা আশাবাদী সুন্দর ও নিরাপদ একটি আগামীর। সেই আগামী শুরুটা যদি এখনই না হয়, তবে আগামী অনিশ্চিত, চিকিৎসক নিগ্রহের লিস্ট হবে আরো দীর্ঘায়িত। নিশ্চিত আগামীর লক্ষ্যে সবাইকে একসাথে একযোগে কাজ করতে হবে, তবেই হবে সর্বস্তরের সকল চিকিৎসকের একটি নিরাপদ কর্মস্থল, জনগণও হবে সন্তুষ্ট।