চিকিৎসকের জন্য এবার ফাঁসির দড়ি।
গণমাধ্যমে শিরোনাম-ডাঃ রোজির ফাঁসির দাবি। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ সবাই জানেন, কিন্তু যেটা জানেন না সেদিন কি হয়েছিল। কি হয়েছিল জেনে নেয়ার আগে আসুন চিকিৎসকের ফাঁসির দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনের প্ল্যাকার্ডগুলোতে কি লেখা ছিল। ঘটনা যাই হোক এই প্ল্যাকার্ডগুলোই জীবন্ত দলিল বাংলাদেশের চিকিৎসক সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কি ভাবে?
“চিকিৎসক নাকি ঘাতক”! “ডাক্তার হলেই কি মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেয়া যায়”! “ডাক্তার রূপে মানুষ খেকো”! “প্রসূতি মায়ের চিকিৎসা কেন একজন নারী ডাক্তারের কাছে নিরাপদ না”! “ডাঃ রোজির বিচার হোক ভুল চিকিৎসা বন্ধ হোক”! “ডাঃ রোজির শেভরনস্থ চেম্বার বন্ধ করা হোক”! “ডাঃ রোজির সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হোক”!
এবার আসুন গণমাধ্যমে মেহেরুন্নেচ্ছা রীমার দুঃখজনক মৃত্যু নিয়ে কি কি অভিযোগ করা হয়েছে তাঁর স্বজনদের জবানে- ‘রোববার রাতে অপারেশনের কথা বলে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় রীমাকে, কিন্তু রাতে অপারেশন না করে ডাক্তার রোজী টাকার লোভে অন্য জায়গায় চলে যান। পরে ভোরে এসে তাড়াহুড়ো করে অপারেশন করেন। “টাকার লোভে তিনি সারারাত এখানে সেখানে ঘুরে ভোরে যেনতেনভাবে অস্ত্রোপচার করেছিলেন বলেই…ডাঃ রোজি মেয়েকে মেরে পালিয়ে যান…” “ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে কয়েক ঘণ্টা পর তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সিনিয়র ডাক্তাররা দিনে ২০-২৫টি অপারেশন করে থাকেন। এ কারণে অনেক সময় অস্ত্রোপচারে তাদের মনোযোগ থাকে না”।
আসলে কি ঘটেছিল-রোগী মেহেরুন্নেচ্ছা রীমার প্রি এক্ল্যাম্পসিক টক্সেমিয়া অফ প্রেগন্যান্সি সহজ বাংলায় গর্ভকালীন খিঁচুনির ঝুঁকি ছিল। ডাঃ শামীমা সিদ্দিকী রোজির তত্ত্বাবধানে তিনি যখন সর্বশেষ চেক আপে আসেন তখন তাঁকে এবং পরিবারকে EDD(Expected Date of Delivery) ৯/১০ জানুয়ারি অর্থাৎ সন্তানের সম্ভাব্য প্রসবের ৩ দিন আগে ৭ তারিখে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলা হয় এবং (LSCS)সিজার করা লাগবে জানানো হয়। কিন্তু তখন তাঁকে ভর্তি করানো হয় নি এবং রোগীর পক্ষ থেকে নর্মাল ডেলিভারি করানোর জন্য অনুরোধ করানো হয়। কিন্তু মা ও গর্ভের সন্তানের ঝুঁকি বিবেচনায় ডাঃ রোজি তাতে রাজি হননি। ৯ তারিখ সন্ধ্যা বেলায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তখনো নর্মাল ডেলিভারি চেষ্টা করতে ডাঃ রোজিকে বলা হয়। ১০ তারিখ ভোর রাত ১২টার পর তারা নিজেরাই (LSCS)সিজার করতে সম্মত হন। রাত একটার দিকে হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তারকে দিয়ে ডাঃ রোজিকে ফোনে জানানো হয় যে তারা চান রোগীকে যেন তখনই (LSCS)সিজার করা হয়। তখন ডাঃ রোজি জানান সকাল ৮টায় তাঁর একটা কনফারেন্স আছে, তিনি কনফারেন্স এর আগে রোগীর পক্ষ চাইলে (LSCS)সিজার করতে পারেন।
ভোর ৬-৩০ এ রোগীর অপারেশন হয়, অপারেশনের পূর্বেও রোগীর রক্তচাপ বেশি থাকে(এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেশি থাকে বলেই সিজার করা হয়)। অপারেশনে ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে ডাঃ রোজি রক্তদাতা প্রস্তুত রাখতে বলেন কিন্তু তখন কোন রক্ত লাগেনি। অপারেশনে তেমন কোন জটিলতা না হওয়ায় তিনি রোগীকে পোস্ট অপারেটিভে নেবার পর কর্তব্যরত চিকিৎসককে ফলোআপ দিতে বলে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। স্বাভাবিক (LSCS)সিজারের রোগীর মত নার্স রোগীকে দেখে, তখন রোগীর জরায়ুপথে বা সেলাইয়ের জায়গায় কোন অস্বাভাবিক রক্তপাত ছিলো না, তবে রোগী কাঁপছিল(এটা অনেকেরই হয়ে থাকে)। এর পর অন্তত দু থেকে তিন বার নার্স রোগীকে দেখে আসে। সকাল ৯টার পর নবজাতক শিশুকে মায়ের বুকের দুধ দিতে গিয়ে রোগীর আত্মীয় স্বজন সর্বপ্রথম খেয়াল করে রোগীর প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। এ সময় একজন সিনিয়র মেডিকেল অফিসার রোগীকে ফলোয়াপ দিয়ে ডাঃ রোজিকে ফোন দিয়ে জানান। উপস্থিত চিকিৎসক বুঝতে পারেন রোগীর ইউটেরাস এটোনিক(জরায়ু সংকোচনে অক্ষম) ডাঃ রোজির নির্দেশ মত সেই চিকিৎসক করণীয় যা যা ব্যবস্থা আছে (প্রসব পরবর্তী রক্তপাতের ধারাবাহিক ম্যানেজমেন্ট যেমন, ফান্ডাল ম্যাসেজ, অক্সিটোসিন, আর্গোমেট্রিন চালু, ৪ ব্যাগ রক্ত দেয়া) গ্রহণ করেন এবং ডাঃ রোজিকে আপডেট জানাতে থাকেন। রোগীর অবস্থা অবনতি হলে ডাঃ রোজি কনফারেন্স অসমাপ্ত রেখেই ছুটে আসেন সকাল ১০:৩০ এ। পৌঁছেই তিনি রোগীর পরবর্তী ম্যানেজমেন্ট যেমন কনডম ক্যাথেটার, আরো রক্ত দেয়ার কথা রোগীর আত্মীয়স্বজনকে জানান, এবং রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে প্রয়োজনে জরায়ু ফেলে দেয়া লাগতে পারে জানিয়ে অনুমতি নিয়ে জরায়ু অপারেশন করে ফেলে দেন। দ্বিতীয়বার অপারেশনের সময় তিনি বিশেষজ্ঞ এনেস্থেশিস্ট সহ সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এসময় মোট ১৪ ব্যাগ রক্ত রোগীর আত্মীয়স্বজন যোগাড় করে যার ৯ ব্যাগ রোগীকে দেয়া হয়। অপারেশনের পরেও রোগীর অবস্থা আরো অবনতি ঘটতে থাকলে তাঁকে আইসিইউতে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রোগী হাইপোভলেমিক শকে চলে যায় এবং সেটার ও ম্যানেজমেন্ট (ডোপামিন/ডবুটামিন) করা হয়। আইসিইউতেই রোগীর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর কথা জানতে পেরে রোগীর লোক তাৎক্ষনিক ভাংচুর শুরু করে। আইন শৃংখলা বাহিনী উপস্থিত হলে তাদের কে বলা যতক্ষণ তারা ভাংচুর শেষ না করছে ততক্ষণ যেন তাদের বাঁধা না দেয়া হয়। ঘটনা তদন্তে সেদিনই বেশ কয়েকজন সিনিয়র অধ্যাপকের সমন্বয়ে অভ্যন্তরীন তদন্ত করা হয়।
পুরো ঘটনায় রোগী শব্দটি ব্যবহার করেছি। “রোগী” শব্দটি বদলে গিয়ে যদি আমার বোন, স্ত্রী বা সন্তান হতো তবে হয়ত চিকিৎসক হলেও এরকম পক্ষপাতহীন নির্মোহভাবে লিখতে পারতাম না। সমবেদনার বদলে হয়ত মেহেরুন্নেছার বাবা, ভাই কিংবা সহপাঠীর মত ক্ষোভের গরল উগরে দিতাম নিঃসন্দেহে। কিন্তু এতে কি পরিস্থিতি বদলাবে? কতটুকই বা যৌক্তিক এই আচরণ? আইন কী বলে? চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সেবা কোথায় দাঁড়িয়ে আসুন দেখি।
প্রথমে আসি আসলে কেন মেহেরুন্নেচ্ছা মারা গেলেন?
প্রসব পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে হাইপোভলেমিক শকে রোগী মারা গেছে। ঘটনার সময়ে সেখানে উপস্থিত চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে আরো যা জানা গেল, রোগীর ইউটেরাস এটোনিক(মানে জরায়ুর সংকোচন প্রসারণের স্বাভাবিকতা ছিলনা), এবং ক্লিনিক্যালি রোগীর ডিআইসি (Disseminated Intravascular Coagulation অর্থাৎ রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধছিল না এবং এটা সাড়া শরীর জুড়ে)। অপারেশনের পরে যেহেতু রোগী স্বাভাবিক ছিল এবং রক্তক্ষরণ হয় অন্তত দু ঘন্টা পর সেহেতু এখানে যিনি অপারেশন করেছেন বিনা তদন্ত সাপেক্ষে তাঁকে দোষারোপ করা অনুচিত হবে। কারণ জরায়ু যদি অপারেশনের টেবিলেই এটোনিক থাকত এবং ডিআইসি তখনই হত তাহলে কখনোই রোগীর অপারেশন কোন জটিলতা ছাড়াই শেষ হত না এবং রোগীর রক্তক্ষরণ তখন থেকেই বন্ধ হতো না। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, রোগীর প্রি এক্ল্যাম্পশিক টক্সেমিয়া ছিল তাই রোগীর এধরনের জটিলতা দেখা দেয়ার একটা সম্ভাবনা অবশ্যই থাকে, দুর্ভাগ্যকজনক হলেও সত্যি মেহেরুন্নেছার ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। এবং এ ধরনের কোন জটিলতা ঘটতে পারে বলেই ডাঃ রোজি আরো আগেই অপারেশন করতে চেয়েছিলেন।
হাসপাতাল এবং চিকিৎসক কি নির্দোষ? চিকিৎসক এবং হাসপাতালের দোষ ধরার মত সক্ষমতা কি আসলেই সাধারণ মানুষ রাখে কিনা সেটাই হলো প্রশ্ন। এতক্ষণ যাকে আমরা ডাঃ রোজি, ডাঃ রোজি বলে ফাঁসি চাইছি, ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত বলছি, চেম্বার বন্ধ করে মালামাল ক্রোক করতে বলছি তিনি কেবল ডাঃ শামীমা সিদ্দিকী রোজি নন তিনি অধ্যাপক ডাঃ শামীমা সিদ্দিকী রোজি। তিনি কেবল একজন মেহেরুন্নেচ্ছা রীমার চিকিৎসা করেন নাই তাঁর পেশাগত জীবনে অন্তত কয়েক লক্ষ রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ভালো করেছেন। তাঁর মত অধ্যাপক কিংবা নূন্যতম একজন চিকিৎসকের ভুল ধরতে হলেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা একাধিক চিকিৎসকের বোর্ড হওয়ার প্রয়োজন আছে। তাহলে কি মেহেরুন্নেচ্ছারা মারাই যেতে থাকবে? চিকিৎসকেরা ভুল চিকিৎসা দিয়েই যাবে?না সেটা কখনোই কাম্য নয়। অবশ্যই চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসা দেয়া এবং সেটা নির্ণয়ের, মান নিয়ন্ত্রণ এবং নীতি নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বিএমডিসি, বিএমএ, সরকারকে কঠোর এবং নিয়মিত হতে হবে।
ডাঃ রোজির ফাঁসি হবে না? রোগীর কিছু হলে হাসপাতাল ভাংচুর!
দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ভুল চিকিৎসায় কখনোই ফাঁসি হতে পারেনা এবং এটা যৌক্তিক ও না, কোন চিকিৎসক কোন অবস্থাতেই চাইবেন না তাঁর রোগীর মৃত্যু হোক। দেশের প্রচলিত আইনে ভুল চিকিৎসা সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু বলা নেই যেটা বলা আছে সেটা দায়িত্বে অবহেলা সংক্রান্ত। এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাও তেমন একটা তৎপর নয়, তারা আন্তরিক থাকলেও অভিযোগের অভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। চিকিৎসক এবং রোগী উভয়েরই সুরক্ষার জন্য বর্তমান সরকার আইন প্রণয়ন করেছে তবে সেটা এখনো পাশ হয় নি। এর মাঝেই হাসপাতাল ভাংচুর চলছে, চিকিৎসকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। নতুন বছরের মাত্র এই কয় দিনেই অন্তত তিনটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, একটি সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের গায়ে হাত তোলা হয়েছে। এর সমাধান কোথায়? যে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি নিজেই জানেন না তাঁর দেশের সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগ ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে, চিকিৎসকদের অভিভাবকরা জুনিয়র সিনিয়র কারো পাশেই আন্তরিক বা কঠোরভাবে দাঁড়ান না, চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি বা বজায় রাখার মনিটরিং নেই, বিদেশি হাসপাতালের দালালেরা গণমাধ্যমকে দৃশ্যমান (বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে) ও অদৃশ্যমানভাবে কিনে নিয়েছে(তাই পত্রিকায় চিকিৎসা নিয়ে নেতিবাচক খবর), যে দেশে বিদেশী চিকিৎসকেরা বিনা অনুমতিতে অবৈধ ভাবে প্র্যাকটিস করে(বাংলাদেশে আইনগত ভাবে অনুমতি নিয়ে চেম্বার করা যায় না বিদেশি চিকিৎসকদের), দেশের সেরা অধ্যাপকরা উট পাখির মত গর্তে (নিজ চেম্বারে) মাথা ডুবিয়ে রেখে ভাবে নিরাপদ আছি( একে একে অধ্যাপকেরা আক্রান্ত হবেন) সে দেশে একজন মেহেরুন্নেছা মারা গেলে, একজন অধ্যাপক শামীমা সিদ্দিকী রোজির ফাঁসি দাবিতে মিছিল হলে কারো কিছু যায় আসে না।
ঐ প্ল্যাকার্ডের জবাব মন্ত্রী মহোদয় দেন নি, চিকিৎসকদের মাথারাও দেয়নি, সাধারণ চিকিৎসকগণের পায়ের নিচে মাটি আর গায়ে সম্মানের পোশাক নেই(সর্বশেষ পে স্কেল অনুযায়ী) তবু সঠিক তথ্য জানিয়ে লিখলাম, প্ল্যাকার্ডের প্রত্যেকটা কথা মিথ্যা, এবং এর দায়ভার বহন করে গুটিকয়েক চিকিৎসক, সমগ্র চিকিৎসক সমাজ- ঘাতক না, মানুষ মারার লাইসেন্স নেয়নি, মানুষ খেকো ও না, চেম্বারের ব্যবসা করে না, ভুল চিকিৎসা করে না”। ভুল চিকিৎসার বিজ্ঞাপন যারা বুঝে দেয় তারা বিদেশের দালাল, যারা না বুঝে দেয় তারাই বিদেশি হাসপাতালের কাস্টমার, আর যারা কিছু না বলে নিষ্ক্রিয় থাকে তারা যে কোন মুহূর্তে নিজেরাই ভিক্টিম হয়ে যেতে পারে।
লেখা ডাঃ মোহিব নীরব
বা***ত বাঙ্গালি !