নারীদেহে যোনিমুখে যে পাতলা পর্দা থাকে, সেটাকে হাইমেন বা বাংলায় সতীচ্ছেদ বলা হয়। প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী এই পর্দা অটুট থাকলে নারী কুমারী এবং পর্দা ছিঁড়ে গেছে মানে নারী অসতী। এমনকি এই একবিংশ শতকে এসেও বিয়ের প্রথম রাতে রক্তাক্ত বিছানা দিয়ে নারীর সতীত্ব বিচার করে উপমহাদেশের অনেক মানুষ। এটি শতভাগ ভুল ধারণা! যৌন সম্পর্ক ছাড়াও কঠোর কায়িক শ্রম বা ব্যায়ামের কারণেও হাইমেন ছিঁড়ে যেতে পারে। অনেকে অপূর্ণ হাইমেন বা হাইমেন ছাড়াও জন্মগ্রহণ করতে পারে। হাতি, শিম্পাঞ্জি, তিমি, ঘোড়ার মাঝেও হাইমেন দেখা যায়। হাইমেনের একটা কাজ হতে পারে ফিমেল রিপ্রোডাক্টিভ ট্রাক্টে জীবানু প্রবেশে বাঁধা দেয়া।
Hymen শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘hyalos’ থেকে, যার অর্থ পর্দা (membrane)। পূর্বে পেরিটোনিয়াম, পেরিকারডিয়াম, মেনিঞ্জেস ইত্যাদি সব ধরণের পর্দার জন্য গ্রীকরা Hymen শব্দটি ব্যবহার করত। গ্রীক বিয়ের দেবতা Hymen এর নাম থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে Vesalius নারীদেহে যোনিমুখের পাতলা পর্দার নাম দেন Hymen। স্পাইডার লিলি নামে একটি ফুলের গনের নাম Hymenocallis, কারন এই ফুলের মাঝে একটি সাদা পর্দা থাকে। একটি ফিতাকৃমির নাম Hymenolepis, কারন এই কৃমির মুখে একটি পর্দা থাকে। গ্রীক মিথোলজিতে এক মৌমাছির নাম ছিল Melissa (meaning bee in Greek), যে জিউসের বিয়েতে সবাইকে মধু পান করতে দিয়েছিল। জিউস খুব খুশী হয়ে মেলিসাকে বর চাইতে বললেন। মেলিসা চাইলো এমন কোন ব্যবস্থা যাতে কেউ তাঁর পরিশ্রমের মাধ্যমে আহরন করা মধু চুরি করতে না পারে। জিউস মেলিসাকে দিলেন হূল, যা দিয়ে মধু চোরদের প্রতিহত করতে পারে। মৌমাছি, ভিমরুল, বোলতার গনের নাম Hymenoptera, কারন এদের পাখা পাতলা পর্দার মত।
গ্রীক মিথোলজিতে Dionysus/Bacchus (god of revelry) ও Aphrodite (goddess of love) এর পূত্র হাইমেন ছিল বিয়ের দেবতা। যদিও কেউ কেউ হাইমেনকে এপোলোর পূত্র হিসেবে বিবেচনা করে। গ্রীসে বিয়ের দিন বর যখন কনের বাড়িতে যায় তখন সবাই সমবেতভাবে একধরনের ছান্দিক কবিতা আবৃতি করতে করতে যায়, যে কবিতায় দেবতা হাইমেনের স্তুতি হয়, সেই কবিতাকে বলে ‘hymenaios’। ধারণা করা হয় হাইমেন সব বিয়েতে অংশগ্রহন করে থাকে। যদি অংশ না নেয় তবে সেই বিয়ে টিকেনা। তাই বিয়ে টিকানোর জন্য জোরে জোরে তাঁর নাম ধরে ডাকা হয়। গ্রীক মিথোলজিতে বিভিন্ন দেব-দেবী বা তাদের সন্তানদের বিয়েতে হাইমেনের উপস্থিতি দেখা যায়।
রেনেসাঁ পরবর্তী ইতালীর চিত্রকলায় হাইমেনকে একজন যুবক হিসেবে দেখা যায়, যার পরনে থাকে ফুলের ঘাগরি, হাতে থাকে একটি প্রজ্বলিত টর্চ। অন্য গল্পে আছে হাইমেন ছিল এথেন্সের খুব সুন্দর এক যুবক, যে এক নারীকে পছন্দ করত, মেয়েদের রুপ ধরে তাঁকে অনুসরন করত এবং সব জায়গায় প্রবেশ করত যেখানে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিলনা। একদিন পুরো দল ডাকাতদের খপ্পরে পড়ে। বন্দী করে হয় সবাইকে। সবাই ঘুমিয়ে পরলে হাইমেন চুপিচুপি উঠে ডাকাতদের গলা কেটে হত্যা করে। তারপর হাইমেন তাঁর পছন্দের নারীকে বিয়ে করার শর্তে সব নারীকে মুক্ত করে এথেন্সে ফিরে যায়। সবাই শর্তে রাজি হয় আর হাইমেন তাঁর পছন্দের নারীকে বিয়ে করে। তাঁর এই বিবাহিত জীবন এত সুখের ছিল যে এথেন্সের লোকজন তাঁর সম্মানে প্রতিবছর উৎসবের আয়োজন করে। এভাবেই হাইমেন বিয়ের উৎসবের সাথে যুক্ত হয়। আর বিয়ের রাতের সাথে হাইমেন জড়িত!!! বিয়েতে ‘hymn’ নামের এক ধরণের সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।
মূল লেখক
অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আশফাকুর রহমান
বিভাগীয় প্রধান, এনাটমি
আদ-দ্বীন আকিজ মেডিকেল কলেজ, খুলনা
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার
সুমাইয়া নার্গিস
শতামেক
সেশন ২০১৬/১৭