লিখেছেন ঃ ডাঃ মোহিব নীরব, প্রতিষ্ঠাতা-প্ল্যাটফর্ম
বাংলাদেশের প্রায় ৮৬ হাজার গ্রামের ১০ কোটি মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পল্লী চিকিৎসক অথবা ওষুধের দোকানদারের কাছে যায়। অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ যেমন স্বাস্থ্যের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ, অধিকার হিসেবে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। হ্যাঁ, বাংলাদেশ সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম্যুনিটি ক্লিনিক স্থাপন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার। তবে পরিসংখানগত ভাবে বাংলাদেশের ১০০ জন মানুষের মাঝে মাত্র ২০ জন মানুষ সরকারি এসকল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নেয়। অবশিষ্ট বিপুল সংখ্যক মানুষ সুলভ, সহজলভ্য ও দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা পেতে নির্ভর করে কবিরাজ, পল্লী চিকিৎসক, ওষুধের দোকানদার শ্রেণীর উপর। অপচিকিতসা, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রদানসহ প্রাতিষ্ঠানিক নূন্যতম শিক্ষার অভাবে এদের হাতে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। কাগজে কলমে বেআইনী হলেও বাস্তবিক অর্থে এদের কাছ থেকেই অধিকাংশ মানুষ শহরে-গ্রামে চিকিৎসা নিচ্ছে যাঁদের নূন্যতম নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। এর বিপরীতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ শুধুমাত্র ভৌগলিক কারণে অর্থব্যয়ের সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারে না, তাঁদের শেষ ভরসা বাড়ির পাশে সেই গ্রাম্য ফার্মেসি।
“জীয়ন” এর “প্রযত্ন” প্রকল্প মূলত এ সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। “জীয়ন” মডেলে একই সাথে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নির্ভরযোগ্য সেবা পাচ্ছে এবং গ্রামের সেই ওষুধের দোকানদার একটি প্রমাণিত ও নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থেকে চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করছে। “জীয়ন” টেলিমেডিসিন পদ্ধতি ব্যবহার করে ঢাকায় একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে রেফারেল সেন্টার পরিচালনা করছে যেখানে ৪টি জেলার দূর্গম বাজারের নির্দিষ্ট ওষুধের দোকানে আগত রোগীকে প্রশিক্ষিত ওষুধের দোকানদার শারীরিক পরীক্ষা ও রোগের ইতিহাস নিয়ে ভিডিওকনফারেন্স মাধ্যমে জানাচ্ছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরবর্তী কোন জিজ্ঞাসা/পরীক্ষার প্রয়োজন থাকলে সে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করছে এবং সব শেষে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র লিখে পাঠালে দোকানে রাখা প্রিন্টারে প্রিন্ট হচ্ছে। আগত রোগীকে নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে এ সেবা প্রদানের পাশাপাশি ডিস্কাউন্ট মূল্যে ওষুধ, স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান, রোগীর তথ্য ইলেক্ট্রোনিক্যালি সংরক্ষণ, রোগীর যদি উচ্চতর চিকিৎসার প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে “জীয়ন” নিকটস্থ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বিস্তৃত স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম, ডায়াগনস্টিক সেবা, শারীরিক পরীক্ষা, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা প্রদানে উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার হবে এবং ৪টি জেলার পর সমগ্র বাংলাদেশে এ সেবা ছড়িয়ে দেয়া হবে । “জীয়ন” এর অভিজ্ঞতা ও প্রাপ্ত তথ্য পরবর্তীতে স্বাস্থ্যখাতের নীতিনির্ধারণে ব্যবহার করা যাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধীনে একই রকম উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে সরকারিভাবে।
“জীয়ন” এর অতীত, ভবিষ্যতঃ
২০০৭ সালে হার্ভাড ইউনিভার্সিটি এবং এমআইটির একদল শিক্ষার্থী মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিকিৎসা প্রদানের ধারণা নিয়ে কাজ করেন যার নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশি মাস্টার্স শিক্ষার্থী মৃদুল চৌধুরী। ২০০৮ সালে এমআইটিতে এটি পুরষ্কৃত হবার পর একটি কোম্পানি গঠন করা হয় যারা মিশর সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশে এ ধারণা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে। ২০১০ সাল থেকে তাঁরা এমপাওয়ার নামে বাংলাদেশে ব্র্যাক, সাজেদা ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ কল্যাণ সহ বেশ কিছু এনজিওর সাথে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে কাজ করেন। ২০১৩ সালে “আমাদের ডাক্তার” প্রজেক্টটি স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করা শুরু করে, যা পরে জীয়ন নামে আলাদা সংগঠন এর রূপ নেয় । ইতিমধ্যে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ইউএসএইডের দুটো এওয়ার্ড এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) -এর সোশ্যাল ইনোভেশন ইন হেলথ এওয়ার্ড ও অর্জন করেছে জীয়ন। “প্রযত্ন” প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে মানসম্মত ও নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে “জীয়ন” কাজ করছে।
এখানেই শেষ নয়। জীয়ন স্বপ্ন দেখে আরও অনেক দুরে, আরও অনেক ওপরে। সম্প্রতি চিকিৎসা সেবাতে প্রযুক্তির ব্যাবহার নতুন মাত্রা অর্জন করছে। থ্রিডি প্রিন্টারে স্টেম সেলের মাধ্যমে কিডনি, লিভার প্রিন্ট করে প্রতিস্থাপন, আইবিএম ওয়াটসন সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে ক্যান্সার ডায়াগনসিস, ড্রোনের মাধ্যমে বান্দরবন বা হাওড় এর প্রত্যন্ত এলাকায় ওষুধ পৌঁছে দেয়া, মানুষের নিঃশ্বাস বিশ্লেষণ করে ক্যান্সার নির্ণয়ের বায়োমার্কার এনালাইজার প্রযুক্তি অথবা সাম্প্রতিক সময়ে রোবটিক আর্ম ব্যবহার করে আমেরিকান সার্জনের ইউরোপে অপারেশনের মত প্রযুক্তি অচিরেই বাংলাদেশের দরিদ্র বঞ্চিত মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে, দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বললেন সেই উদ্যোক্তা, রুবায়াত খান (সি ই ও, জীয়ন)।
“প্ল্যাটফর্ম” এর সাথে “জীয়ন” এর আনুষ্ঠানিক পার্টনার্শিপের পর তাঁদের ওয়েব সাইট সার্ফ করছিলাম, “হেড অফ কেয়ার” এর ভ্যাকেন্সি এনাউন্সমেন্ট দেখে একটা ভালো লাগা অনুভূতি হলো, এনাউন্সমেন্টের কিছু অংশ কোট করছিঃ We want someone who is SICK & TIRED, DISGUSTED, ASHAMED about current healthcare situation in Bangladesh, and wants to be a part of changing it. […] There are two types of people in the world. Those who accept the world as it is, and those who don’t. One of our core values is to “Be the Change that we wish to see in the world”.
শুধু হেড অফ কেয়ারই নয় “জীয়ন” আগামী কয়েক মাসে নূন্যতম ৫০ জন চিকিৎসককে তাঁদের টিমে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে কাজ করার জন্য। আগ্রহীরা [email protected] অথবা প্ল্যাটফর্ম এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
তলা বিহীন ঝুড়ি থেকে লাফ দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে একটি সম্মানজনক অবস্থানে এসেছে। স্বাস্থ্য খাতের অবিশ্বাস্য সাফল্যে দেশের জনগণ, সরকার, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিনিধি আইসিডিডিআর,বি, ব্র্যাক, গ্যাভি, গ্লোবাল ফান্ড, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অবদান অনস্বীকার্য, তেমনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে দি নেক্সট বিগ থিং হিসেবে ডক্টোরোলাডটকম, জীয়ন এবং সহযোগীরা যে উঠে আসছে তা জানাতে এ লেখা।