গাইনী এন্ড অবসের প্রতি আমার আলাদা একটা দুর্বলতার আছে। ইন্টার্নীর সময় আমার এসিট্যান্ট রেজিস্টার ছিলেন ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করা এক বড় ভাই, যিনি হাসতে হাসতে সিজার করতেন আর সারাদিন আমাদের সাথে আড্ডা দিতেন, ক্যারাম খেলতেন।
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। আমি কখনোই গাইনোকলজিস্ট হবার চেস্টা করিনি, কিন্তু ডেলিভারীর পর বাচ্চার কান্না আর মায়ের হাসিমাখা মুখের স্মৃতি আজও আমাকে স্বপ্ন দেখায়, বাঁচতে শেখায়।
বহু সিজারিয়ান অপারেশানে এসিসট্যান্সি করেছি, উপজেলায় থাকার সময় প্রচুর ডেলিভারী করিয়েছি, সেসব কথা ভাবলে ভীষন নষ্টালজিক লাগে। কি দুরন্ত সময় ছিলো তখন, কতই না সুখী ছিলাম!!
তখন মানুষজন অনেক সম্মান দিতো, পুরুষ ডাক্তার বলে কেউ কখনো নাক সিটকায়নি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর অপ্রতুলতায় যথাসাধ্য চেস্টা করতাম বলে ওদের কৃতজ্ঞতা উপচে পড়তো। আর এখন? রোগীর আস্থা অর্জন দূরের কথা ভালো ব্যবহার পাওয়াই দুস্কর।
আমার পরম সৌভাগ্য, আমি আমার উপজেলায় কাজ করার সময় একজন অমায়িক গাইনী সার্জন পেয়েছিলাম, সৌভাগ্য বশতঃ উনিও পুরুষ। বেশ কিছু পুরুষ গাইনোলজস্ট দেখে আমিও মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, মনে মনে শ্রদ্ধাবনত হই, হয়তো তাদের দলে আমিও থাকতে পারতাম।
কোন এক শুক্রবার একজন গর্ভবতী মা আমার কাছে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য আসেন। তিনি বলেন, তার এক আত্মীয় আমাকে দিয়েই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে বলেছেন। উনার আগের আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে বাচ্চার পজিশান উল্টো ছিলো ( ব্রীচ প্রেজেন্টেশান) তাই তিনি চিন্তিত।
আমি দেখেলাম, একবার, দুইবার। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, বাচ্চার অবস্থান পুরোটাই স্বাভাবিক, মানে ব্রীচ ক্যাফালিক হয়ে গেছে। কি সৌভাগ্য! রোগীর লোকজনতো পারলে আমাকে ধন্যবাদের বন্যায় ভাসিয়ে দেয়, ব্যপারটা এমন যে, আমি যে হাত দিয়ে বাচ্চাকে উল্টো থেকে সোজা করে দিয়েছি।
যাই হোক, রোগীর এমনিয়োটিক ফ্লুইড একটু কম ছিলো, ফিটাল ডিস্ট্রেস হবার আশংকায় ওদেরকে বললাম, গাইনীর কোন কনসালটেন্ট দেখিয়ে ভর্তি হতে। আমার মনে হচ্ছিলো, হয়তো পেশেন্ট লেবারেই আছে, নরমাল ডেলিভারী হয়ে যাবে হয়তো!
একটু পর আমার এক বন্ধুর ফোন পেলাম যিনি এলাকার সমাজসেবক। তিনি ফোন করে অনুরোধ করলেন, রোগীর সব দায়িত্ব যেন আমি নেই। রোগীটা গরীব! কোন এভেইলএবল কনসালটেন্ট ওই মুহূর্তে না পেয়ে আমাকে অগত্যা দায়িত্ব নিতেই হলো।
পিভি করে দেখা গেলো পেশান্ট লেবারে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ইস! যদি নরমাল ডেলিভারী হয়ে যেতো তো বন্ধুর কাছে আমার মুখটা আরেকটু উজ্জ্বল হত। যে বন্ধু নানা প্রয়োজনে আমাকে সাহায্য করে থাকে তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এত বড় সুযোগ মিস করি কিভাবে?
পেশেন্টকে ভর্তি করে, নরমাল ডেলিভারির ট্রায়াল শুরু করালাম। এরই মাঝে ফোনে গাইনীর কনসালটেন্ট এর সাথে কথা বললাম। উনি আশ্বস্ত করলেন, ৫/৬ ঘন্টা পর কল দিলে উনাকে পাওয়া যাবে।
নরমাল ডেলিভারির সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। রোগীর ব্যথাও বেড়েছে। অথচ, বাচ্চা নীচে নামছে না। এদিকে মেমব্রেইন রাপচারড, পানি নেই তেমন। মাল্টি গ্রেভিডায় এত দেরিতো হবার কথা নয়।একটু পর সবুজ ম্যাকোনিয়াম দেখে আমার ভয় হচ্ছিলো, বাচ্চাটা যদি খারাপ হয়ে যায়?
কনসালটেন্ট এর সাথে কথা বলে সিজার এর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মন মানছিলো না, তাই বললাম, সিজার এর প্রস্তুতি নিতে নিতে যদি নরমাল ডেলিভারী হয়েও যেতে পারে। আমি একবার ওটিতে যাই, আবার রুমের বাইরে হাঁটি। মহিলার ভীষন কষ্ট হচ্ছে। অবস্ট্রাকটেড লেবার হয়ে গেলেই বিপদে পড়বো।
কিছুটা প্রগ্রেস দেখে গ্লাভস পরলাম। ফিটাল হেডের চারদিকে হেক্সিটেইন ক্রিম দিয়ে একটু সুইপ করে দিলাম। প্লেইন ক্যাথেটার দিয়ে ব্লাডার খালি করলাম। মনে হলো যেন, ম্যাজিক। রোগী চাপ দিতেই ফিটাল হেড একটু সামনে এলো, মনে হচ্ছে ক্রাউনিং হবে হবে। লোকাল এনেস্থেশিয়া দিয়ে রেডি হলাম, যা থাকে কপালে ইপিশিওটমী দিয়েই দেবো। একটু পর ইপিসিওটমী দিয়ে দিলাম। বাচ্চাটা আমাকে অবাক করে দিয়ে আর সামনে এগুলো না।
এখন উপায়? ইপিশিওটমী দিয়ে ফেলেছি, এখন যদি নরমাল ডেলিভারী না হয়, মান সম্মান সব যাবে! নীচে ইপিসিওটমীর কাটা আবার উপরে সিজারের কাটা, নাহ আমি ভাবতে পারছি না!
মনের কষ্টে ইপিশিওটমীর কাটা জায়গার ব্লাড মুছি, আর ভাবী আহারে, এই যাত্রা যদি বেঁচে যাই, জীবনেও আর এনভিডি করাতে আসবো না।কনসালটেন্ট ফোন দিলেন, বললাম, স্যার মনে হয় হয়ে যাবে, আপনাকে একটু পর আপডেট জানাচ্ছি।
ফোন রাখতেই, মহিলার আরেক দফা পেইন এলো। ব্যাথার সাথে চাপ দিতে বললাম, আরে এইতো চলে আসছে। হেড ডেলিভারী হতেই আমার ভীষন ভালো লাগতে শুরু করলো, একটু রোটেশানে শোল্ডার ডেলিভারী হতেই, পুরো বাচ্চা আমার হাতে। ওয়াও!!
কিন্তু একি, বাচ্চার সাথে সাথে এত্তগুলো সবুজ পানি আর ম্যাকোনিয়াম দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। বাচ্চাকে ওয়াশ করলাম। সাকশান দিলাম। ভয়ে আছি, বাচ্চা কাঁদছে না কেন। হায়রে বাচ্চা না বাঁচলে এত কষ্ট করে লাভ কি?
পীঠে একটু প্রেশার দিলাম, অক্সিজেন দিলাম। একটু পরেই বাচ্চা কেঁদে উঠলো। আহা! কি মধুর কান্না। আমার তো ইচ্ছে করছে বাচ্চাটার সাথে আমিও কম্পিটিশান করে খুশীতে দুই দফা কেঁদে নেই। যাই হোক, যে পেইন আমাকে দিয়েছে এই বাচ্চা তার সাথে প্রতিযোগীতায় আমি জিতবো না এটাই স্বাভাবিক।
বাচ্চাটা এরপর তার উপস্থিতির প্রমান ভালো ভাবেই দিয়েছিলো। কান ঝালাপালা করে দেয়ার মত কান্না শুরু করলো। মনে হচ্ছে, এত দেরী করে পৃথিবীতে আনার জন্য উনি প্রচন্ড বিরক্ত। যাই হোক, কান্না শুনে ফেলসি, আর দরকার নাই, কুইক বাচ্চাকে রোগীর লোকের কাছে দিয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাতে বললাম।
আমার খুশী তখনো পূর্নতা পায়নি। পদে পদে যেখানে বিপদ সেখানে কি এত সহজে পার পাবো?
একটু পরে দেখলাম প্লাসেন্টা ডেলিভারী হচ্ছে না। অক্সিটোসিন দিয়েও লাভ হলো না। অগত্যা হাত দিয়ে ম্যানুয়াল রিমুভালের চেস্টাই করতে লাগলাম। কিছুক্ষন পরে প্লাসেন্টাও ডেলিভারি হলো।
মনের সুখে টেবিলে বসে, লোকাল এনেস্থেশিয়া দিয়ে যেই না ইপিশিওটমীর সেলাই শুরু করেছি, তখনই শুরু হলো ব্লিডিং। গরম পানির মপ দিয়ে চেপে ব্লিডার খুঁজে বাইট দিয়ে ইপিশিওটমী রিপেয়ার করতে পাক্কা ত্রিশ মিনিট। ততক্ষনে ঘেমে গেছি।
কনসালটেন্টকে খবর দিলাম, স্যার সিজার লাগবে না, নরমাল হয়ে গেছে! রোগীর লোকজনের সে কি আনন্দ। বাচ্চাটাই শুধু খুশী হলো না, সে কাঁদছেই।
আমার সেই বন্ধু আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানালো, আমিও ধন্যবাদ জানালাম আমার ঈশ্বরকে!
কিছু অভিজ্ঞতা কখনোই ভোলা যায় না। অনেক উৎকন্ঠার পর যখন ভালো কিছু অর্জন হয়, তখন ফেলে আসা কষ্টের অনুভূতি অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। গাইনোকলজিস্টরা বোধহয় এই অনুভূতি গুলো বারবারই পেয়ে থাকেন। নরমাল কিম্বা সিজার এর দোলাচল, পিপিএইচ এর ব্লিডিং এর শংকা, ফিটাল ডিসট্রেস অথবা এসফাইক্সিয়ার ভয়! এরপরই সেসব ভয়কে জয়! দারুন চ্যালেঞ্জিং।
আমার অভিজ্ঞতা নেই বলেই সামান্য ডেলিভারিতেই আপ্লুত হই অথচ গাইনীর স্যার ম্যাডামদের কাছে এগুলো নিত্যদিনের মামুলী ঘটনা। কত কষ্ট কত পরিশ্রম উনারা করেন সেটা বোঝার শক্তি কয়জনের আছে? আমার তো টেনশানে ঘুমই আসতো না!
আমার আফসোস আমি কখনো গাইনোকলজিস্ট হতে পারবো না! হ্যাটস অফ টু অল গাইনী এন্ড অবস স্পেশালিস্ট ফর দেয়ার এন্ডলেস সাপোর্ট ইন ইমার্জেন্সী অবসট্রেটিক কেয়ার অব আওয়ার কান্ট্রি!
সব মায়েরা সুস্থ্য শিশু জন্মদিক, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে, নিরাপদে!!
লিখেছেন: ডা. মৃণাল সাহা,
স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, বিএসএমএমইউ