প্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৪০ “
” ডাক্তারের জীবনে সিনেমার প্রভাব “
লেখকঃ ডা.ফাহমিদা শিরীন নীলা
গাইনী কনসালটেন্ট,
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বগুড়া
আমার মনে হয়, বাঙালীর মত রসিক জাতি দুনিয়াতে আর একটিও নেই। এদের রসবোধ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র, কেবল এগুলো ঠিকমত সংগ্রহ করে আপনি কতটুকু হাঁড়িতে পুরতে পারছেন, সেটাতেই বোঝা যাবে আপনি কতটা রসিক। হরেক রসের একটি উপাদান হল, বাংলা সিনেমা। আসুন দেখি, বাঙালী ডাক্তারদের জীবনে সচরাচর পড়া বাংলা সিনেমার প্রভাব!
১) অনেক রোগী এসেই বলে, ‘ল্যাও হামাক দেকে ওষধ লেখ্যা দ্যাও’। এদের যতোভাবেই জিজ্ঞেস করা হোক না কেন, কি সমস্যা নিয়ে এসেছে,এরা নিজের মুখে সেটা বলবেনা। স্থানভেদে এদের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও, হাত বাড়িয়ে দিয়ে এদের একটাই কথা, ‘লাড়ি দেকো, প্রেসার লাপো, দিয়ে কহো হামার কি হয়্যেছে?’ ‘সমস্যা কি আপনার?’ ‘ও হামি আগে সমিস্যা কহবো,তারপর তুমি অসুক ধরত্যে পারব্যা?’ (এমন মুখভঙ্গি যেন ভুল করে সে একটা হাতুড়ে ডাক্তারের হাতে এসে পড়েছে)
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ ডাক্তারবাবু এসে নাড়ি ধরেই রোগীর নাড়ীনক্ষত্র বলে দেন, ‘আপনার রোগীর কঠিন অসুখ হয়েছে।এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে।’ সুতরাং,সিনেমাপাগল বাঙালী ধরেই নিয়েছে ডাক্তার নাড়ী দেখেই অসুখ তো বটেই, মরার দিনক্ষণটিও বলে দিতে পারবে।
২) একদিন অপারেশন শেষে ওটি থেকে বের হচ্ছি, রোগীর এক আত্মীয় এগিয়ে এসে বিজ্ঞ ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডাম,অপারেশন কি সাকসেসফুল?’ আমি খুবই কৌতুকভরে তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেও আমাদের স্যারের মত বলতে পারলাম না, ‘ওই মিয়া,এইটা সিনেমা পাইছেন নাকি?’
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়েই বিজ্ঞ সার্জন রোগীর উদ্বিগ্ন আত্মীয়-স্বজনদের আশ্বাস দেন,’কনগ্রেচুলেশনস,অপারেশন সাকসেসফুল’।
৩)দুপুরের খাবারের পর একটু টকমিষ্টি কিছু মুখে না দিলে ভাল লাগেনা। একদিন দুপুরে চেম্বারে বসে ওষুধ কোম্পানির দেয়া মিষ্টি তেঁতুল খাচ্ছি। এক বন্ধু এসময় আসলো রোগী দেখাতে। পারিশ্রমিক ছাড়াই তার রোগী দেখে তাকেও দিলাম তেঁতুল খেতে। দুই দিন পর দেখি অন্য আরেক বন্ধু মেসেজ পাঠাইছে, ‘কনগ্রেটস ফর ইউর নিউ বেবী।’
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ বাচ্চা পেটে আসার প্রথম লক্ষণ, টক খাওয়া।
৪) এক রোগী এসে সমস্যা বলল, মাথা ঘোরে, বমিবমি লাগে,পেটে ব্যাথা,মাথা ব্যথা, পিঠে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, গা চুলকায় ইত্যাদি ইত্যাদি, চেম্বারে বসা থেকে শুরু করে যতোক্ষণ শুয়ায়ে পরীক্ষা করলাম চলতেই থাকল সমস্যার ফিরিস্তি। ওষুধ লেখার আগে যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাসিক বন্ধ আছে?’ সে এমনভাবে অবাক হয়ে লম্বা একটা ‘হ্যাঁআআ’ বলল যেন এটা না জানা আমার বিরাট অপরাধ। আগে কেন বলেনি,এ প্রসঙ্গ তুলতেই চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ও মা, আপনি না প্রেসার মাপ্যে দেকলেন! হামি কচ্চি যে,ও তো আপনি এম্নেই বুঝপেননি।’
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ প্রেসার মেপেই লেডী ডাক্তার হাসতে হাসতে বলেন,’মিষ্টিমুখ করান,আপনি তো মা হতে চলেছেন’।
৫) এক রোগীর মাসিক অনিয়মিত ছিল বলে বাচ্চা পেটে এসেছে বুঝতে পারেনি। পাঁচ মাস পেরোতেই যখন পেটে বাচ্চা নড়া শুরু করল, তখন আলট্রাসনোগ্রাফি করে প্রেগন্যান্সী বুঝতে পারল। সুস্থ মানুষটি বাচ্চা পেটে আছে জানার পর থেকেই বমি করা শুরু করল। দিনরাত তার বমি হয়,বমি বমি লাগে। অথচ বমি হওয়ার পিরিয়ড তার পার হয়ে গেছে বহু আগেই।
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ বাচ্চা পেটে আসবে আর বমি হবেনা, তাই কি হয়!
৬) কনসালটেন্ট হওয়ার পর একবার উপজেলার সরকারী হাসপাতালে নরমাল ডেলিভেরী করাচ্ছি, রোগীর মাথার কাছে তার শাশুড়ি দাঁড়ানো । দরজার কাছে দাঁড়ানো ননদের মেজাজ খুব গরম, সে এই হাসপাতালে মোটেই আস্থা রাখতে পারছেনা। একটু পর পর মাকে চাপা গলায় বকাবকি করছে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেন নিল না বলে। হঠাৎ, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাদের গরম পানি কই?’ ‘গরম পানি নিয়ে আমরা কি করব?’ সে এবার রাগে গজগজ করতে করতে কিঞ্চিৎ জোরেই ভৎর্সনা করে মাকে বলল, ‘কি কছিলাম তোক,কিছুই জানেনা এরা’
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ লেবার পেইন শুরু হলে দাই আসার সাথে সাথে ‘গরম পানি’ ‘গরম পানি’ করে চিৎকার করতে থাকে। আর অমনি পড়ি কি মরি করে রোগীর আত্মীয়ারা গরম পানির গামলা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আজও বুঝতে পারলাম না, সিজার ছাড়া নরমাল ডেলিভেরীতে গরম পানির কি প্রয়োজন?
৭) ফ্যান্টম প্রেগন্যান্সীর(বাচ্চা পেটে না থাকলেও রোগী নিজেকে প্রেগন্যান্ট মনে করে) রোগীকে আমি যতোই পেটে হাত দিয়ে আর আলট্রাসনো রিপোর্ট দেখে বোঝায় যে, ‘আপনার পেটে বাচ্চা নাই’, সে ততোই অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দেখি আগে বাড়ী যাই,ঠাকুর কি করে?’
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ ডাক্তার যতোই শেষ জবাব দিয়ে দিক, শাড়ীর আঁচল দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিতে দিতে মন্দির কিংবা মাজারে গিয়ে মাথা ঠুকলেই দাবার দান উল্টে যায়। কাজেই ডাক্তারের শেষ কথাই যে শেষ নয়, এটা ভাবাই যায়।
৮) ইনফারটিলিটির(বন্ধ্যাত্ব) রোগী বিয়ের দশ-বিশ বছর পর চল্লিশের কোঠায় বয়স যখন, তখন আসে ডাক্তারের কাছে। ‘এতোদিন চিকিৎসা করাননি কেন?’ ‘করিছি তো। পানিপড়া খাছ্যি মেএএলা।’ ‘খালি পানি পড়াতে কাজ হয়?’ ‘খালি ওট্যা নয় তো, তাবিজও লাগাছি।’ গলা বের করে দেখাবে ৮টা তাবিজ ঝুলছে গলার চেইনের সাথে, হাতের বাজুবন্ধের মত চার-পাঁচটা তাবিজ,কোমরে পাটের আঁশ মোটা করে দড়ির আকারে বাঁধা।
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ বাচ্চা হচ্ছেনা, দরবেশ এসে পানি পড়া বা ফুঁউউ দিয়ে দিল,একখান তাবিজ দিয়ে দিল, ‘যাহ্,সামনের চাঁদেই তোর কোল জুড়ে আসবে ফুটফুটে চাঁদের মত পুত্র সন্তান।’
৯) আমার প্লাসেন্টা প্রিভিয়া(ফুল বাচ্চার নীচে থাকা) রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন তিন-চার ব্যাগ। রোগীর লোককে সেকথা জানাতেই রোগীর মা বললো, ‘হামার গতর থ্যাকে সব রক্ত লিয়া ল্যাও বেটা। দেখো তো! হাঁর ধনকে হামিই রক্ত দিব। হাঁর যা রক্ত আছে শরীলে,ডাইরেক দিয়্যা দ্যাও হাঁর বুকের মানিককে।’ এ কথা বলেই পাশের বেডে শটান হয়ে শুয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ এখানে রক্ত দেয়ার আগে কোন ক্রস ম্যাচিং, স্ক্রিনিংয়ের দরকার হয় না। ডাইরেক্ট দাতা থেকে গ্রহীতার কাছে রক্ত ট্রান্সফার হয়ে যায়, পাশাপাশি বেডে।
১০)’ম্যাডাম, আমার দুইমাস হল বিয়ে হয়েছে, এখনো বাচ্চা পেটে আসেনি। আপনি ওষুধ লেখে দেন।’ ‘কেবল দুই মাসেই অস্থির হয়ে গেলেন। অপেক্ষা করুন। এখন ওষুধ লাগবেনা।’ ‘ না ম্যাডাম,আপনি ওষুধ দেন। আমার হাজবেন্ড কাছে থাকেনা তো! ঢাকায় থাকে,মাঝে মাঝে আসে।’ ‘একসাথে না থাকলে বাচ্চা আসতে তো সময় লাগবে। আরো কয়েকমাস দেরীই তো হবে।’ ‘না ম্যাডাম। আপনি লেখে দেন ওষুধ। আত্মীয়-স্বজন সবাই বলছে,এত দিন হল বিয়া হছ্যে,বাচ্চা হচ্ছেনা কেন?’
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ বিয়ে হোক বা না হোক, একটিবার নায়ক-নায়িকার টোকা লাগলেই নির্ঘাৎ বাচ্চা পেটে আসবেই আসবে।
১১) পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বললাম, ‘আপনার পিত্তথলিতে পাথর আছে, জরায়ুতে ইনফেকশন আছে, ইউরিনে ইনফেকশন আছে, রক্তে সুগার বেশী আছে,আপনার প্রেসারও বেশী।’ ‘যাক আলহামদুলিল্লাহ্। ম্যাডাম,খারাপ কিছু নাই তো, না?’ ‘আরও কিছু চান?’ ‘আরেকটু ভাল করে দেখেন। এই যে, এক্সরেটা দেখেন একটু ভাল করে,মাথায় কিছু হয়নি তো! মাঝে মাঝে মাথাব্যথা করে।’ যতই বলি,আর কিছু নাই,ততোই বলে,ভাল করে দেখেন। চেম্বারে বসে দশবার জিজ্ঞেস করেও সাধ মেটেনা, বাইরে বের হওয়ার পর আরও দু’তিনবার ঢুকে,পারলে ফোন নাম্বার জোগাড় করে কল দিয়েও একই কথা বলে,’ভাল করে দেখেছেন তো? খারাপ কিছু নাই, তাইনা?’
বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ যেখানেই ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাক না কেন, উল্টা করে ঝুলানো বুকের এক্সরে দেখে বলবে, আপনার ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে। আপনার হাতে আর সময় আছে মাত্র দুই মাস। আমার কেন যেন মনে হয়,এইসব রোগী সেইসব ডায়ালগ শোনার অপেক্ষায় বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, খারাপ কিছু নাই তো?
১২) তখনো রোগী শেষ হয়নি। ব্যস্ত হয়ে রোগী দেখছি, এইসময় ফোন বেজে উঠল, ‘ম্যাডাম, আজ সকালে আপনার কাছে একটা উগী নিয়ে গেছুনু। ওই যে অক্ত ভাঙ্গা রোগী। উগী তো একনো উঠ্যা খাড়া হব্যার পারিচ্চে না। অক্ত ভাঙ্গা আইছেই! আপনের প্রেসক্রিপশনের ব্যাক ওষধই তো খিলাছি। কি ওষধ দিলেন,কাম হল না ক্যা??? বাংলা সিনেমা ফ্যাক্টঃ একডোজ ওষুধ পেটে পড়ার সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে নায়িকা স্বামীর হাত ধরে গানের সাথে সাথে নাচও শুরু করে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে,’এ জীবন মধুময় সে তো তোমারি কারণ…উ উ উ উ’
মযা ফেলুম আফা??? এমুন রোগী থাকতে আর কিছু লাগে নি???
সিরিয়াসলি!…. বয়স্ক (কথায় কথায় পুরানো আমলের কথা টেনে আনে যেন সে ৪০০ বছর বয়সী) এবং অশিক্ষিত যারা তাদের নিয়ে এটুকু সমস্যা হবেই। সেবা খাতে এধরণের অনেক সমস্যা থাকে কিন্তু তবুও আপনারা যে মানুষের সেবা করে যান তার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।