প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৩
” ডাক্তার ”
অদিতি চৌধুরী
নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ।
#মেডিকেল এর গেইট দিয়ে যখন ঢুকছিলাম মনের ভিতরটা চুরমার হয়ে গিয়েছিল। এডমিশন এর ফরম জমা দিতে গিয়ে মনে হচ্ছিল কোথায় যেন কোনকিছু ঠিক নেই। এই ছোট করিডড়ে আমি হাটব? আমার বন্ধুরা যখন নীল আকাশের নিচে গিটার বাজিয়ে গান গাইবে তখন আমি হয়ত কোন বাচ্চার যন্ত্রনার গগনবিদারী কান্না শুনব। ওয়ার্ড এ যাবার সময় ট্রলিতে লাশ দেখে অদেখার ভান করে চলে যাব। চকিত পিছন ফিরে আবার মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। দৃড় পায়ে দূরে চলে যেতে হবে লাশের পাশের ক্রন্দন থেকে। আমি কি পারব? এডমিশন এর কাজগুলো শেষ করছিলাম আর মনে হচ্ছিল পিছনের দরজাগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে। ফিরে যাবার পথ বন্ধ হচ্ছে।
#ফার্স্ট প্রফের রেজাল্টটা দেখে খুব খুশি লাগল। চলে গেলাম নদীর তীরে। অনেকদিন পর আড্ডা জমে উঠবে। আবার গল্প হবে। আমার ব্যার্থতার গল্প। আমার না পারার গল্প। আমার গল্প শেষ হবার গল্প। রেজাল্ট দেখে খুশি হবাত পিছনে কারন ছিল। ফেল টা না দেখলে বুঝতাম না কি করা উচিত। আমার চোখ খুব ঝাপসা হয়ে এল হঠাৎ। আর চিন্তা করলাম না। ট্যাবলেট গুলো ঠেসে দিলাম মুখে।
#ধুর, সব জানলা খুলে গেছে। বাইরের ক্যাচাল আর আলো! উফফ! চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। তোরা তোদের ক্লাসে যাবি,যাস না! যাবার সময় জানালাগুলো না খুলে গেলেই নয়? আবার যাবার আগে আমাকেই টানা লাগে প্রতিদিন ক্লাসে যাবার জন্য? জানিস নেশা করি, এসব ক্লাস টাস কি আবার আমার জায়গা নাকি?
এত শব্দ, আলো কেউ একটু বন্ধ কর সব……..পারছি না। আচ্ছা, জীবন নেশা না নেশা জীবন? বেচে থাকাটা নেশার মত, ঘোর ধরে যায়। চক্র,চাকা…..ঘুরছে…..আমিও ঘুরছি……
#সময় যাচ্ছে। প্রচন্ড ইচ্ছা হচ্ছে ওয়েটিং রুম থেকে দৌড়ে পালাই। মাথা নিচু করে বসে আছি। আড়চোখে দেখলাম স্যার চেম্বারে ঢুকছেন।আবার ইচ্ছা হল চলে যাই। পালিয়ে যাই। স্যারের ক্লাস একদিন করেছিলাম। স্যার মন্দ না। কিন্তু…..না, দরকার নাই।
“সুপ্ত আপনি?”
আমিই শেষ রোগী। পালাবার পথ নেই। হে দুনিয়া কিছু একটা কর। স্যার এর সামনে যাব না,প্লিজ। পাপীর কথা কে শুনবে!
দরজা খুলে গেল।
“তুমি! তোমার আবার কি সমস্যা!”
স্যারের কথা শুনে আমি দরজায় দাড়িয়ে ই আবার মাথা নিচু করে ফেললাম। স্যারের পিএস আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। খুব সম্ভবত বুঝতে চেস্টা করল একটু আগে ভার্সিটির স্টুডেন্ট পরিচয় দেয়া মানুষকে দেখে ডাক্তারসাব নিজের স্টুডেন্টর মত ব্যাবহার করছেন কেন!
স্যার আবার বললেন, “আসো। জমির,বের হবার সময় দরজা লাগিয়ে যেও।”
আমি বসলাম। মাথা নিচু করে।
“কি সমস্যা?”
আমি নীরব। কবি মাঝে মাঝে নীরব থাকেন।
স্যার মুচকি হাশি দিলেন মনে হল। তাকানোর সাহস হচ্ছে না। কি প্রচন্ড অসস্তি।
“একে তো ডাক্তার,তার উপর আবার সাইকিয়াট্রিস্ট, তার উপর আবার টিচার! কি না কি হয়,তাই না?”
কোন জবাব দিলাম না।
স্যার বললেন, “বিপিটা দেখি”
মিনমিনিয়ে বললাম, “স্যার, বিপি নরমাল।”
” নরমাল না এবনরমাল আমি বুঝব। এখন বল তো কি হয়েছে? ”
আমি হঠাৎ খুব বেপরোয়া হয়ে গেলাম। আর পারলাম না। শব্দ বের হল যে হারিয়ে গিয়েছিল।
স্যার অনেক সময় আমার দিকে তাকালেন। “কাল একবার আমার সাথে কলেজে দেখা কর,পারবে না?”
# সেই শুরু। স্যারকে কত দিন যে নেশারঘোরে বলেছি মেরে ফেলব তার ইয়াত্তা নেই। অশ্লীল তর ভাষায় গালিও দিতাম। স্যার কখন কিছু বলেন নি। কি এক অদ্ভুত কারনে সব সহ্য করে যেতেন। না খেয়ে আসতাম, স্যার খাইয়ে দিতেন কিছুমিছু। আমার সহ্য হত না ভালবাসাগুলো। অসহ্য লাগত।
গান্ধীজির মত অবস্থা! এক গালে চড় দিলে স্যার আরেক গাল হয়ত এগিয়ে দিতেন আই থিনক!”
“Dr. Shapto patient 129 is waiting.” নিজের বিচিত্র নাম শুনে প্রেজেন্ট এ আসতে বাধ্য হলাম।
এদেশের মানুষগুলো আজো নাম বলে সেপ্টো! এত বছর ধরে ডাক্তারি করি এখানে! তাও! হাসপাতালে কাজ শেষ হয় না। আর এই বিচিত্র নামে ডাকাডাকিও বন্ধ হয় না। অনেকদিন ভাল করে কেউ ডাকে না। দেশে একটা কনফারেন্স আছে। স্যারের সাথে দেখা হবে। স্যারের জন্য কি নিয়ে যাব?
স্যার তো দেখলেই বলবেন
” সুপ্ত,আমার দিকে তাকাও। তুমি তো এখনো আমার দিকে তাকাতে পারো না!” বলে হাসবেন, সান্তা ক্লজের মত হো হো হাশি!
ফাইল টেনে নিলাম। কাজ শেষ করতে হবে জলদি। যেতে হবে দেশে!