ঢাকায় বসবাসকারী অধিকাংশ ফুসফুসজনিত রোগের ঝুঁকিতে আছেন

রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৪

ঢাকা মহানগরী বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে প্রতিনিয়ত নানা কারণে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, যার মধ্যে ফুসফুস জনিত রোগের প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ।

শিল্পায়ন, যানজট, বায়ু দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, এবং গাছপালা কমে যাওয়ার ফলে ঢাকার বাসিন্দারা উচ্চ মাত্রার পরিবেশগত দূষণের সম্মুখীন হচ্ছেন, যা তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার পরিবেশে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ রয়েছে, তা এখানকার বাসিন্দাদের দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

ঢাকায় বায়ু দূষণের বর্তমান অবস্থা

ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রা থেকে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর শীতকাল আসার সাথে সাথেই ঢাকার বায়ুমানের আরো অবনতি ঘটে। শীতকালে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় শহরের বাতাসে কঠিন কণার ঘনত্ব অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়, যা শ্বাসযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এছাড়াও, গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে বিভিন্ন কল-কারখানা এবং যানবাহনের নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।

ফুসফুস জনিত রোগসমূহ

বায়ুদূষণের কারণে যে সমস্ত ফুসফুস জনিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা, এবং ক্যান্সার উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া, ধুলা, বিষাক্ত গ্যাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের কারণে সিওপিডি (COPD) বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অ্যাজমা: বায়ু দূষণের কারণে ঢাকার শিশু ও বৃদ্ধরা অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অ্যাজমা একটি দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, যা দূষিত বায়ু গ্রহণের ফলে আরও তীব্র হয়।

ব্রংকাইটিস: ঢাকার ধুলা ও ধোঁয়ার কারণে ব্রংকাইটিসের প্রকোপ বাড়ছে। এই রোগে শ্বাসনালীতে প্রদাহের সৃষ্টি হয়, যা রোগীর জন্য খুবই কষ্টদায়ক।

ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD): দীর্ঘ সময় ধরে দূষিত বায়ুতে বাস করলে সিওপিডি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ধ্বংস করে দেয়।

ফুসফুসের ক্যান্সার: অত্যাধিক দূষিত কণা এবং রাসায়নিকের সংস্পর্শে থাকলে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে, ধোঁয়া এবং রাসায়নিক পদার্থের ক্রমাগত সংস্পর্শে থাকলে এই ঝুঁকি মারাত্মক হয়ে ওঠে।

ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান কারণসমূহ

ঢাকার ফুসফুস জনিত রোগ বৃদ্ধির পেছনে মূলত কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া এবং নির্মাণ কাজের কারণে বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি।

অপরিকল্পিত শিল্পায়ন: ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলোতে অসংখ্য কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। এই কারখানাগুলোর বেশিরভাগই পরিবেশগত বিধি মেনে চলছে না এবং পর্যাপ্ত ফিল্টার ব্যবস্থা ছাড়াই দূষিত ধোঁয়া নির্গত করছে।

নির্মাণ কাজ: ঢাকায় প্রচুর সংখ্যক নির্মাণ কাজ চলছে। নির্মাণের সময় বাতাসে উড়ন্ত ধূলা ও বালি দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

যানবাহনের ধোঁয়া: ঢাকার অধিকাংশ পুরানো যানবাহন থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। এসব ধোঁয়া ফুসফুসের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ইটের ভাটা: শহরের আশেপাশে অনেক ইটভাটা রয়েছে, যেগুলোর কালো ধোঁয়া বাতাসকে অত্যন্ত দূষিত করে তুলছে।

ঢাকার বায়ুদূষণ এবং পরিবেশগত দূষণের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে এখানকার মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘসময় ধরে দূষিত বায়ু গ্রহণ করছে, তাদের হৃদরোগ, স্ট্রোক, এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ঢাকার বাচ্চারা শ্বাসজনিত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বেড়ে উঠছে, যা তাদের ভবিষ্যতে সুস্থ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।

ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। পরিবেশ সংরক্ষণে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন যানবাহনে ফিল্টার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা এবং কল-কারখানায় পরিবেশবান্ধব যন্ত্রপাতি স্থাপন করা উচিত। এছাড়াও, বায়ুদূষণ রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল, কলেজ, এবং অফিসগুলোতে কর্মশালার আয়োজন করা জরুরি।

শুধুমাত্র সরকার বা পরিবেশ সংস্থা নয়, ঢাকার জনগণকেও এই বায়ুদূষণ রোধে সচেতন হতে হবে। নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করা, গাছ লাগানো এবং বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকেও এই বিষয়ে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

ঢাকার অধিকাংশ বাসিন্দা আজ বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুস জনিত রোগের ঝুঁকিতে আছে। এই ঝুঁকি থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদক: এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

অধ্যাপক একে আজাদকে প্রধান করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে ১২ সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠন

Mon Nov 18 , 2024
সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদকে প্রধান করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে ১২ সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মন্ত্রি পরিষদ বিভাগ গতকাল (১৭ নভেম্বর) এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, কমিশন অবিলম্বে কার্যক্রম শুরু করবে ও সংশ্লিষ্ট সব মতামত বিবেচনা করে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo