তিন মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম

সোমবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৪

গত ৮ নভেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিন মাস পূর্ণ করেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর গত তিন মাসে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করেছে তার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

গত তিন মাসে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উল্লেখযোগ্য অর্জন ও কার্যক্রম:

১. সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সারাদেশে ৮৭২ জন শহীদ এবং ১৯,৯৩১ জন আহতের তালিকা করা হয়েছে (এ তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি)। আহতদের জন্য ঢাকায় ১৩টি হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারাদেশের আহত ছাত্র জনতাকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

২. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহতদের সুচিকিৎসার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশের হাসপাতালসমূহে ‘সার্বক্ষণিক সমন্বয় সেল’ স্থাপন ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সমন্বয়ে ‘মেডিকেল বোর্ড’ গঠন করা হয়েছে।

৩.  ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত চক্ষু রোগীদের সুচিকিৎসার জন্য সেবা ফাউন্ডেশন ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উদ্যোগে গত ৪-৯ অক্টোবর নেপাল থেকে ৩ জন, গত ৭ অক্টোবর ফ্রান্স থেকে ১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ও ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছেন। গত ৩০ অক্টোবর থাইল্যান্ড থেকে তিন জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) চিকিৎসা দিয়েছেন। গত ২৬-৩০ অক্টোবর জার্মানি ও অষ্ট্রেলিয়া থেকে ২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জাতীয় বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারি ইনষ্টিটিউটে চিকিৎসা দিয়েছেন। আগামী ৫-১৮ নভেম্বর বিট্রিশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল নিটোরে চিকিৎসা দেবেন।

৪. জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন যাদের ঢাকায় রেফার করা হয়েছে তাদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য বিনামূল্যে এম্বুল্যান্সযোগে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

৫. আহতদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে হাসপাতালগুলোর ডেডিকেটেড অংশে তাদের স্থানান্তর করা হয়েছে। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, শেরেবাংলা নগর, ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অঙ্গহানি হয়েছে এমন গুরুতর আহত ২০ জনকে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

৬. আহতদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চিকিৎসা সম্পর্কিত অভিযোগ, পরামর্শসহ তথ্য সরবরাহের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক হটলাইন খোলা হয়েছে। হটলাইনে আসা কলসমূহ পর্যালোচনা করে সাথে সাথেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

৭. আন্দোলনে আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। অনেক হাসপাতাল বিনামূল্যে আহতদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর সাথে যোগাযোগ করে নামমাত্রমূল্যে চিকিৎসা সেবা যাতে পাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করেছে।

৮. যারা আহত হয়েছেন বিশেষত যারা চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, পায়ে আঘাত পেয়েছেন, অঙ্গহানি হয়েছে, তাদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে ডাক্তারদের মেডিকেল টিম এনে (চীন, নেপাল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশ হতে) চিকিৎসার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে চীনের এ্যাডভান্স মেডিকেল টিম বাংলাদেশে এসেছেন। তারা হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করে চিকিৎসায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়া, নিড বেস্ড অ্যাসেসমেন্ট-পূর্বক পরবর্তী সময়ে কি ধরণের সেবা বা সাপোর্ট দেয়া হবে সে বিষয়েও তারা অবহিত করবেন। এছাড়া, বিভিন্ন দেশ এবং বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

৯. হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত যাদের দেশে চিকিৎসা করতে দেশের হাসপাতাল অপারগতা প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শ অনুযায়ী উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদেরকে পর্যায়ক্রমে দেশের বাইরে পাঠানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ ফাহিম হাসান-কে সরকারিভাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে। তার চিকিৎসা বাবদ সর্বমোট ২৭ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

মো. বাসিদ খান মুসা (৭)-কে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। তার চিকিৎসা বাবদ সর্বমোট ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

জনাব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান কাসেমী (৩৯)-কে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে। তার চিকিৎসা বাবদ সর্বমোট ৭০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

জনাব মো. আব্দুর রশিদ (২৯)-কে দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে এবং

ইয়াসমিন আক্তার-কে দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

১০. ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে দেশের বিভিন্ন স্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও শহীদ পরিবারকে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে নীতিমালা প্রণয়ন এবং শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিচিতিসহ একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে একটি খসড়া নীতিমালা এবং আহত-নিহতদের একটা প্রাথমিক তালিকা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেছেন। প্রস্তুতকৃত তালিকা সর্বসাধারণের যাচাইয়ের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে ডেটাবেজ তৈরির সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।

১১. দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় সংস্কার ও চিকিৎসা সেবার গুণগত মান উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণের জন্য ১২ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা হয়েছে।

১২. দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল বিশেষত ঢাকায় বরাদ্দকৃত বেডের চেয়ে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা বেশি। রয়েছে জনবলের সংকট ছাড়াও আরও নানা রকম সমস্যা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সমস্যাগুলি পর্যায়ক্রমে সমাধান করতে কাজ করে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা স্বাস্থ্য খাতের ১৬টি উন্নয়ন সহযোগীর (বিশ্বব্যাংক,এডিবি, জাপান, ইউএসএ, ইউকে, কানাডা, গ্লোবাল ফাইনান্সিং ফ্যাসিলিটি, গ্লোবাল ফান্ড, ইউনিসেফ, ইউএসএফপিএ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, চীন, সৌদিআরব, এআইআইবি, গ্যাভী ও সুইডেন) নিকট আর্থিক অনুদান বা কারিগরি সহায়তা প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে গত ২৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ডি.ও.পত্র প্রেরণ করেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে আহত ছাত্র-জনতা চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে চলমান ২টি প্রকল্পের [১. ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপারডনেস (ইআরপিপি)’ ২. নগর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা (ইউএইচএনপি)] আওতায় সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব করে। উক্ত প্রস্তাব অনুযায়ী ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ারডনেস (ইআরপিপি)’ শীর্ষক প্রকল্পের অব্যয়িত ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যবহারের জন্য ইউনিসেফের সাথে সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সম্পাদন করা হবে। এ লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক ও ইউনিসেফ এর সাথে কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এছাড়া, বিশ্বব্যাংক নগর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা (ইউএইচএনপি) শীর্ষক প্রকল্পের অব্যয়িত ৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ১০ কোটি টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার দিয়ে সহায়তা প্রদান একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের গ্রহণের সম্মতির জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংককে ই-মেইল করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিশ্বব্যাংককের প্রাথমিক সম্মতি পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক টিএপিপি প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ডি.ও. পত্রের প্রেক্ষিতে চীন সরকার গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি জরুরি মেডিকেল টিম বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। চীনা মেডিকেল টিম ২৩-২৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক এবং পুনর্বাসন হাসপাতালে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় বার্ন এবং প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সিটিউট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে ভর্তিকৃত ছাত্র জনতার চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন। চীনা মেডিকেল টিমের রিপোর্টটি পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া, গুরুতর আহত ছাত্র জনতার উন্নততর চিকিৎসা কার্যক্রমের জন্য দুই দেশের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

১৩. বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় হতে ৫ কোটি টাকার অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে।

এছাড়াও বন্যা পরিস্থিতি ও চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদক: মঈন উদ্দিন আহমদ শিবলী

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ২০ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছে ১৯৫!

Tue Nov 12 , 2024
মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৪ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যা আছে ২০টি। কিন্তু আজ (মঙ্গলবার) সকাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৯৫। শয্যার তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা। শয্যাসংকটের কারণে অধিকাংশ শিশুকেই হাসপাতালের ওয়ার্ড ও বারান্দার মেঝেতে শুইয়ে রেখে চিকিৎসা দেওয়া […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo