প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০, বৃহস্পতিবার
জুলফিকার সবুর
৪৮ তম ব্যাচ, ২য় বর্ষ
রংপুর মেডিকেল কলেজ
“তোমরা আমাকে সালাম দিবে কেন?
আমি তোমাদেরকে সালাম দিবো।”
একজন সত্যিকারের শিক্ষকের মানসিকতা বোঝানোর জন্য উক্তিটাই যথেষ্ট। গতকাল রাতে আমরা স্যারের অসুস্থতার খবর পাই৷
“এনাটমির আওয়াল স্যার আজকে রাত ৯.৩০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্ট্রোক, বাই ল্যাটেরাল এক্সটেনসর, পিউপিল আন ইকুয়য়াল এবং ফিক্সড ছিলো৷ বলতে গেলে স্যারের অবস্থা খুবই খারাপ। আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন ছিলো কিন্তু হাসপাতালের আইসিইউ নাকি বন্ধ! তাই বাধ্য হয়ে কমিউনিটি মেডিকেলে নিয়ে গেছেন।”
ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপে এই টেক্সট আসে। কিছুদিন আগেই স্যার কোভিড মুক্ত হয়েছেন বলে শুনেছি। আজ সকালে খবর পেলাম স্যারকে হেলিকপ্টার যোগে নেয়া হচ্ছে ঢাকায়। বিকাল ৩.৫৫ মিনিটে এনাটমি বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিনা ম্যাডাম নিশ্চিত করেন আমাদের সবার প্রিয় ডা. আউয়াল স্যার মৃত্যবরণ করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
রংপুর মেডিকেলের কেউ তার অসীম প্রজ্ঞা, ধৈর্য্যকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। তুমুল জনপ্রিয় একজন শিক্ষক। সিনিয়র ভাইরা বলতেন ‘গড অব এনাটমি’। সত্যি বলতে এনাটমির বেশ অনেক অনেক টিচার দেখেছি। তবে স্যারের মতো করে পড়ান এমন শিক্ষক গোটা দেশে ক’জন আছেন কিনা সন্দেহ। ভাইভা বোর্ডে ছিলেন সাক্ষাৎ যমদূত বলাবাহুল্য। তবে তার মতো করে শেখাতে পারতেন খুব কম শিক্ষক, খুবই কম। নিজেই দেখেছি বন্ধুদের, যখন আউয়াল স্যারের কাছে ভাইভা শুনে পরীক্ষা না দিয়েই চলে যেতো। সফট্ পার্ট ভাইভা দিয়ে আর পরীক্ষা না দিয়ে চলে যেতো। বিপরীত চিত্র ক্লাসে, সারাদিন ক্লাস না করলেও ৩ ঘন্টার ক্লাস হলেও চলে আসতো স্যারের ক্লাসে। স্যার কোনো টপিক পড়ানোর সময় নোট করে দিতেন। আর এই নোট পড়লে যে কোনো বই বা গাইডের দরকার হয়না তা তো অবশ্যই। সিনিয়রগণকে যদি বলা হতো,
“ভাই কিচ্ছু পারিনা। পেশাগত পরীক্ষা দিবো কি করে?”
সহজ উত্তর,
“আরেহ্ পেশাগত পরীক্ষার একমাস আগে আওয়াল স্যার, মাহবুব স্যারের ক্লাস করলে পরীক্ষা ক্লিয়ার।”
পেশাগত পরীক্ষা আসবে। তার আগের একমাস ও আসবে। রিভিশন ক্লাসও আসবে। আওয়াল স্যার আসবেন না। ৪৮ ব্যাচ করতে পারবে না স্যারের ক্লাস। আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা স্যারের ক্লাস আর করা হবে না। ভাইভায় দেখবো না স্যার মাহবুব স্যারের সাথে একই টেবিলে বসে আছেন। সবার আগে ডিসেকশনে হলে এসে পরীক্ষা নিতে শুরু করেছেন। পরীক্ষার শেষে সব বোর্ডে ঢু মারছেন। স্যারের প্রশ্নে আমরা ঘায়েল হচ্ছি! স্যারের কাছে দেয়া প্রথম টার্মের সফট্ পার্ট ভাইভায় বেশ অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পরেও অনেকটা খারাপ পরীক্ষা হয়।
থার্ড টার্ম লিখিত পরীক্ষার পর স্যারের রুমে হিস্টোলজি খাতা সাইন করতে গিয়ে দেখি বেশ পুরোনো একটা গ্রে’স এনাটমি। স্যার বলতেন,
“আমি এই বয়সেও যদি প্রতিদিন ফজরের পর পড়তে পারি। তোদের কি সমস্যা? তোরা তো হুতুতু বেবি”
স্যার কোথায় কি মজা করলেন সত্যি বলতে শেষ দিকের ক্লাস গুলোয় আমি সাইডে লিখে রাখতাম।
“তোরা তো হবি মানুষ মারা ডাক্তার। চোখে মলম লাগায় দিয়ে বলবি কিছু দেখা যায়? তারপর রোগীর পকেট থেকে টাকা নিয়ে নিজের পকেটে ঢুকায় নিবি। মানুষ মারা ডাক্তার হস না বাবা। তোরা তো ভালো কিন্তু পড়স না”
টিউটোরিয়াল খাতাটা পড়তে গেলেও কেমন লাগবে এখন। হেড-নেক আর ব্রেন-আইবল কার্ডে স্যারের পড়ানো এখনো কানে বাজছে। চোখে দেখতে পাচ্ছি স্যারের ক্লাস। পেশাগত পরীক্ষার রিভিশন ক্লাস তবে নিবেন না ডা. আউয়াল স্যার। একজন আদর্শ শিক্ষক। অসংখ্য শিক্ষার্থীর আদর্শ। আমরা আপনাকে প্রচন্ড রকমের শ্রদ্ধা করি স্যার। আপনার মতো পরহেজগার জ্ঞানী ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা নিশ্চয় জান্নাত নসিব করবেন। আমিন। ৪৮ তম ব্যাচের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা। আল্লাহ স্যারের পরিবারকে ও আমাদের সকলকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দিন। আমিন।
“তোরা একটু পড়াশোনা করিস বাপ”