তাঁদের নামের পাশে এমবিবিএস, এমডি (ডক্টর অব মেডিসিন), পিএইচডি, পিজিটি, মেডিসিনসহ আরও অনেকে অনেক সংক্ষিপ্ত শব্দের এসব মিথ্যা ডিগ্রির বিবরণ প্রদান করে বনে গেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক! দেশের সংবিধানমতে, চিকিৎসাসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই মৌলিক অধিকারের কথা বলে দেশের এক শ্রেণির ভুয়া চিকিৎসক মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। বার বার জেল-জরিমানার পরও তাঁরা একই নামে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন নিয়মিত। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাইনবোর্ড লাগিয়ে চেম্বার খুলে বসেছেন তাঁরা। দেশে এমন অন্তত ৫২ জন ভুয়া চিকিৎসকের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। এসব ভুয়া চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা না নেওয়া ও সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. বশির আহমেদ ভোরের পাতাকে জানান, ‘বিশেষজ্ঞ নামধারী ভুয়া চিকিৎসকদের কারণে দেশের চিকিৎসকদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এসব নামধারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ আইনে বা জামিন অযোগ্য ধারায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের বিকল্প নেই। সরকার ক্লিনিকগুলোতে যথাযথ মনিটরিং করছে না। এ সুযোগে কোনো কোনো ক্লিনিকে ভুয়া ডাক্তার বসছেন। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত দেশের চিকিৎসকদের, ক্লিনিক ও হাসপাতাগুলোতে মনিটরিং করা।’ জানা গেছে, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে চট্টগ্রামে ডা. হুমায়ুন কবীর, এমআর নিজামী, গিয়াস উদ্দিন, হারুন অর রশিদ, অসীম সেন, নেপাল দাশগুপ্ত, গোপাল মজুমদার, আর জে সাহাকে দ- দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা ছাড়া পেয়ে আবারও একই প্রতারণায় নেমেছেন। তাঁদের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে চেম্বার খুলে তাঁরা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে দ-িত ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তারদের স্বীকারোক্তির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর শত শত ভুয়া ডাক্তার তৈরি হয়। স্থান পরিবর্তন করে এবং কৌশলে বাণিজ্য করে আসছেন তাঁরা। তাঁদের নামের পাশে এমবিবিএস, এমডি, পিএইচডি, পিজিটি, মেডিসিন, চর্ম, শিশু প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডিগ্রির মিথ্যা বিবরণ লাগিয়ে প্রতারণা করা হয়। অনেকে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা না করেও এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। ভুয়া চিকিৎসকদের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বক্তব্য, ‘আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। প্রায় সময়ই ভুয়া চিকিৎসকদের শনাক্ত করে অর্থ জরিমানা ও জেল প্রদান করে থাকি। কয়েকজন ভুয়া চিকিৎসক আছেন যাঁদের বার বার জরিমানা ও জেল দেওয়া হয়েছে। তাঁরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বেরিয়ে পুনরায় চিকিৎসা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।’ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অ্যাক্ট-২০১০ অনুযায়ী বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন না পেলে কেউ এলোপ্যাথি চিকিৎসা করতে বা ব্যবস্থাপত্র লিখতে পারেন না। যোগ্যতার সার্টিফিকেট যাচাই-বাছাই করে বিএমডিসি কর্তৃক এ রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয়। সেজন্য স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ন্যূনতম এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও এ সংক্রান্ত বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তালিকাভুক্ত ৫২ ভুয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক : শেখ সাহাব উদ্দিন, মো. আলী হোসেন, গোলাম কিবরিয়া, মো. নুরুন্নবী, মো. এমরান হেসেন, আকরাম হোসেন, এসএম আবদুস সবুর, মো. ওসমান গনি, দেবেশ সরকার, মজিব উল্যাহ, মোশাররফ হোসেন, আতিয়ার রহমান, হাসিনা আক্তার, এসএম সাহাবুদ্দিন, ফাতেমা সাখাওয়াত, মো. আল আমিন, এম কাওসার আহমেদ, শাহানা জামান শানু, এমএ বারেক, উজ্জ্বল কান্তি দেব, চিত্র সরকার, হুমায়ুন কবির, এমআর নিজামী, মো. গিয়াস উদ্দিন, আর জে সাহা, হারুন অর রশীদ, নেপাল দাশগুপ্ত, অসীম সেন, গোপাল মজুমদার, আবদুল মতিন, এমআর শামীম, মোহাম্মদ শামীম, মুহিতুর রহমান, আরিফ হোসাইন, এখলাসুর রহমান, মোহাম্মদ জান্নাতুল ফেরদৌস, জহুরা বেগম, মাহবুবুর রহমান, নাজনীন নাহার, ফজলুর রহমান, রাজীব শরীফ, হাফিজুর রহমান, একরামুল ইসলাম, বোরহান উদ্দিন, আমির হোসেন, রাকিবুল হোসেন, শরিফ হোসেন, শহিদ হাসান, নুরুন নেসা, কামরুল ইসলাম ও সুমন মিয়া। তাঁরা সবাই ভুয়া চিকিৎসক। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা চিকিৎসকদের সহযোগী বা কম্পাউন্ডার কিংবা ফার্মেসিতে চাকরি করে এক পর্যায়ে নিজেদের চিকিৎসক হিসেবে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন বলে জানা যায়।
এসএসসি পাস আকরাম হোসেন : ডা. আকরাম হোসেন ২০ বছর ধরে একই ধরনের অপরাধ করছেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা মাত্র এসএসসি পাস। বার বার ধরা পড়ার পরও তিনি সরকারি হাসপাতালের দালালদের সহায়তায় ভুয়া ডাক্তারের কাজ চালিয়ে যান। এই ভুয়া ডাক্তার আকরাম মিরপুরে আবারও একটি বাসা ভাড়া নিয়ে একই অপরাধ শুরু করেছেন।
এমবিবিএস এবং এমডি ডিগ্রিধারী গোলাম কিবরিয়া : ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গোলাম কিবরিয়া। ২০০৩ সালে ১৫ দিনের জন্য ভারতে গিয়ে কলকাতার চৌরঙ্গী রোড থেকে মাত্র ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে এমবিবিএস এবং এমডি ডিগ্রির দুটি সার্টিফিকেট কেনেন। ঢাকায় এসে পুরোদমে প্র্যাকটিস শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে দু’দফায় ধরা পড়ার পর কিবরিয়া আবারও সক্রিয় হয়েছেন।
ভুয়া ডাক্তারদের পাঁচ ধরনের ওষুধের ব্যবহার :ভুয়া এমবিবিএস চিকিৎসকরা সাধারণত পাঁচ ধরনের ওষুধ লিখে থাকেন। এগুলো খেলে যে কোনো রোগের সাময়িক উপশম হবেই। যেমন- উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ, গ্যাস্ট্রিক নিরাময়ের ওষুধ এবং পেটের সমস্যায় ইমোটিল জাতীয় ওষুধ। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, কথায় কথায় উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিলে তাৎক্ষণিক রোগমুক্তি হলেও শরীরের এন্টিবডি বিনষ্ট করে। সঠিক রোগ নিরূপণ না করে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। একইভাবে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও ঝুঁকিপূর্ণ। এটি শেষ চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এটি ব্যবহারে তাৎক্ষণিক রোগের উপশম হলেও জীবনীশক্তি কমে যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। ইমোটিল শরীরের নিম্নাংশের সাময়িক পেরালাইসিস বা অবস করে পাতলা পায়খানা নিঃসরণ বন্ধ করে। ফলে জীবাণু শরীরের ভেতর থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ইমোটিল সেবনে বৃহদান্ত্রের সাময়িক প্যারালাইসিস ধীরে ধীরে স্থায়ী প্যারালাইসিসে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ভুয়া চিকিৎসকদের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার ডাক্তার জেডএইচ বসুনিয়া বলেন, ‘ভুয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান সব সময় কঠোর। আমরা শিগগিরই জনসচেতনতার মাধ্যমে এসব প্রতারককে রুখতে ব্যবস্থা নেব।’
(সূত্রঃ ভোরের পাতা)