প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২ জুলাই, ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. রায়হানুল আরেফীন
ডেন্টাল এন্ড মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জন,
২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, নোয়াখালী
আড়াই বছরের ফুটফুটে বাচ্চাটি যখন মায়ের কোলে করে আমার দায়িত্বে থাকা নন পেয়িং ১৪ নম্বর বেডে ভর্তি হল, তখনই ওর মায়ায় পড়ে গেলাম। আসলে মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম ওর অদ্ভুত কিউট হাসিটার। যখন জানলাম ওর বাড়ি লক্ষীপুর, তখন আরো বেশি আপন মনে হল।
আমি কিংবা আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্যার, ম্যাম, ট্রেইনিরা যতই ওকে পছন্দ করুক, ও ভর্তি হয়েছিল এক ভয়ংকর অভিশাপ মাথায় নিয়ে; ওর মা-বাবা, আত্মীয় স্বজনদের বুকভরা কষ্টের কারণ হয়ে। জন্মের পর থেকে ওর মাকে একটানা কথা, গালমন্দ শুনতে হয়েছে, এরকম বিচ্ছিরি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য। শুধু ওর প্রবাসী বাবার একচ্ছত্র সাপোর্ট ছিল বলে, ওর মা সহ্য করতে পেরেছেন। অনেকের কাছে শুনেছেন কোথাও যদি এ রোগের চিকিৎসা হয়, তো পিজি হাসপাতাল। সে আশাতেই এত দূর থেকে নিজের একমাত্র বাচ্চাকে নিয়ে ছুটে এসেছেন এবং ভর্তি করেছেন আমাদের ডিপার্টমেন্টে।
বাচ্চাটির নাম নজরুল। ওর কুৎসিত অসুখটির মেডিকেল টার্ম ফ্রন্টোন্যাজাল এনকেফালোসিল। ব্রেইন থেকে উৎপন্ন হয়ে রোগীর কপালে দুই চোখের মাঝখানের জায়গা থেকে একটা বড় পিন্ড বের হয়ে ঝুলতে থাকে। দিনদিন এটা বড় হয়ে হাতির শুঁড়ের মত আকার নেয়। তখন রোগীকে দেখতে অনেকটা হাতির বাচ্চার মতই লাগে। তো এরকম দেখতে একটা বাচ্চাকে নিয়ে কি আমাদের সমাজে মুখ দেখানো যায়!
নজরুল কে নিয়ে প্রিঅপারেটিভ প্রেজেন্টেশন করলাম। স্যাররা নিউরোসার্জারী ও অফথালমোলজি কনসাল্টেশন নিতে বললেন। ওগুলোতে আমি সাথে করে নিয়ে গিয়ে অপিনিয়ন নিয়ে আসলাম। একটা মেডিকেল বোর্ডে স্যাররা ডিটেইলড ট্রিটমেন্ট প্ল্যান দিলেন। দুই ধাপে সার্জারী হবে। প্রথমে একটা জটিল অপারেশন, এর ৬ মাস পরে আরেকটা। প্রয়োজনীয় সব ধরনের ইনভেস্টিগেশন শেষ হল।
অবশেষে ১৫ ই মার্চ, ২০১৪ তারিখ ওর অপারেশনের তারিখ পড়লো। যেহেতু মাথার খুলি কেটে ভিতরে অপারেশন করতে হবে, এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। হাই রিস্ক বন্ডে সই করতে হয়েছিল ওর মাকে। মনে আছে আগের দিন সন্ধ্যায়, ওর বাবা সৌদি আরব থেকে ফোন করে প্রায় আধাঘন্টা আমার সাথে কান্নাকাটি করে কথা বললেন, অনুরোধ করলেন উনার বাচ্চার যেন ক্ষতি না হয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার উনার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে, সবকিছু নিয়মিত আমি উনাকে বুঝিয়ে দিতাম।
একটা ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি ওটিতে নিউরোসার্জারীর একজন সহযোগী অধ্যাপক স্যারের নেতৃত্বে আমরা অপারেশনটি সফলভাবে শেষ করলাম। তার মুখের সামনের শুঁড়টি রয়েই গেল। আগামী ৬ মাস আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে- এটি আকারে ছোট হয় কিনা এবং ওর কোন নিউরোজেনিক অসুবিধা দেখা দেয় কিনা। এ অবস্থাতেই ওর মা ওকে নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
এরমধ্যেই ওর মা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন আর আপডেট দিতেন। তেমন কোন অসুবিধা হয়নি নজরুলের। অক্টোবর মাসে সময়মত ওরা এসে ভর্তি হয়ে গেল। সন্ধ্যার সময় রুটিন রাউন্ডে ওকে দেখতে গেলাম। বিছানায় বসে মিটিমিটি হাসছে। অভিশপ্ত মাংসপিণ্ডটির আড়ালে ওর চোখদুটোতে রাজ্যের মায়া। বললাম,
“কিরে ব্যাটা কাল থেকে তো তোর এই শুঁড় থাকবেনা। আমাদেরকে গুতা দিবি কী দিয়ে?”
কি বুঝলো কে জানে! খিলখিল করে হেসে আমার কোলে ঝাপ দিল। আমি বাকি রাউন্ড ওকে কোলে নিয়েই দিলাম। সব বেডের রোগী, এটেনড্যান্টদের কাছ থেকে দোয়া নিল।
১৪ ই অক্টোবর, ২০১৪ তারিখে নজরুলের দ্বিতীয় সার্জারী হল। ওএমএস এর বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজী বিল্লুর রহমান স্যার ও সহকারী অধ্যাপক ডা. সাখাওয়াত হোসেন স্যারের নেতৃত্বে এই অপারেশনটি ও খুব সুন্দরভাবে শেষ হল। অভিশপ্ত শুঁড়টি ওর মুখ থেকে চিরবিদায় নিল। ধীরে ধীরে ক্ষত শুকিয়ে গেল। স্টিচ অফ করে দিলাম। ওদের ছুটি হয়ে গেল।
সেদিন সকালে যাওয়ার সময় আমি ওকে কোলে নিলাম। বললাম,
“কিরে, মামার কথা মনে থাকবে?”
ও শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল। ওর হাসিতে আমার বুকে চিনচিন করে উঠলো, সুখের ব্যথা। হঠাৎ ওর মা আমার হাত ধরে জোরে কেঁদে দিলেন। বললেন,
“আপনে আমার ভাই। আপনের কারণে আমার নজরুল নতুন জীবন পাইলো। আপনে ওর জন্য দোয়া কইরেন।”
আমি বললাম,
“আপনি ওরে নিয়া চিন্তা কইরেননা আপা। ও ইনশাআল্লাহ অনেক বড় হবে, আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। ওর জন্য সবসময় আমার দোয়া থাকবে।”
বলতে বলতে আমার দুচোখ ও ভিজে উঠলো। আমি শার্টের আস্তিনে মুখ লুকালাম। ওরা বিদায় নিল। বাড়ি যাওয়ার পর নজরুলের নিজের পরিবার তো বটেই, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই অনেক খুশি। এতদিন যারা ওকে অপয়া ভাবতো, দূর দূর করে অভিশাপ দিতো, এখন তারা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে; ওকে কোলে নেওয়ার প্রতিযোগিতা হয়।
ওর মা নিয়মিতই আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখতেন এবং ওকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করে গেছেন কয়েকবার। এরপর আর কোন অসুবিধা হয়নি নজরুলের, এলাকার অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে হেসে খেলেই বড় হচ্ছে ও। এখন ওর বয়স প্রায় নয় বছর।
এরকম শতশত নজরুলের গল্প ডাক্তারদের জীবনে জড়িয়ে আছে। একজন কার্ডিয়াক এরেস্টের পেশেন্টকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা, একজন পিপিএইচ এর পেপার হোয়াইট রোগীর জীবন বাঁচানো, দুরারোগ্য বা জন্মগত নানা ত্রুটি নিয়ে জন্মানো রোগীকে সফল অপারেশনের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলার যে অপার্থিব আনন্দ- তা অন্য কোন পেশায় বা কোটি টাকা দিয়েও কেনা সম্ভব নয়।
শুধু দামী গাড়ি-বাড়ি, সম্পত্তি, ক্ষমতা আর স্যালুট পাওয়াতেই জীবনের সব প্রাপ্তি নয়। মানুষকে রোগ থেকে সারিয়ে তোলা, কারো মনের একদম ভিতর থেকে দোয়া ও সম্মান করা, একজনের দুঃখী জীবনটা সুখে ভরিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে পরম তৃপ্তি; পৃথিবীর এ ক্ষুদ্র জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য আরো অনেককিছু লাগে বলে আমার মনে হয় না। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ অনুগ্রহের কারণেই আমরা এ সুযোগ পেয়েছি।
আমাদের পেশায় লাঞ্চনা-বঞ্চনা-গঞ্জনা-হতাশা-অপ্রাপ্তি কোনকিছুরই শেষ নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এগুলো সবই আমাদের সিস্টেমের দোষ, পেশার নয়। মানুষ আমি, তাই আমাদের পেশার প্রতি মানুষের মনোভাব, হিংস্র আচরণ দেখে অনেক সময়ই ভীষণ মন খারাপ হয়, হতাশায় দুমড়ে মুচড়ে যাই। কিন্তু দিনশেষে এ “নজরুল”দের হাসিটুকুই আমাদের প্রেরণা, হতাশা কাটানোর টনিক।
ফিনিক্স পাখির মত আমরা আবার বাঁচি, ডাক্তার হয়ে বাঁচি।