সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫
পরিচয় দেন এমবিবিএস ডাক্তার। পাশাপাশি জ্বর, ক্যান্সার, সিজার ও হার্টসহ সব রোগের চিকিৎসা দেন গ্যারান্টি সহকারে। নিজেই করেন ল্যাব পরীক্ষা। শুধু ডাক্তারই নয়, একাধারে সাংবাদিকও তিনি। বরিশালের উজিরপুরের সনদবিহীন এমবিবিএস ডাক্তার দাবিদার এই প্রতারকের নাম রেজাউল করিম। সময় সংবাদের বরাতে জানা গেছে প্রতারণা এমন অভিনব গল্প!

রোগীর ছদ্মবেশে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সাতলায় মায়ের দোয়া ক্লিনিক অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে জানা যায়– রেজাউল করিম নিজেকে এমবিবিএস চিকিৎসক পরিচয়ে সব রোগের চিকিৎসা দেন এখানে।
একজন গণমাধ্যমকর্মী তার পেটে ব্যথার কথা জানালে তাৎক্ষণিক রক্ত ও আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করেন নিজেই। সাথে বিল করেন ১৫০০ টাকার।
তবে কিছু সময়ের মধ্যে গণমাধ্যম কর্মী আঁচ করে ভোল পাল্টে ফেলেন এই প্রতারক। প্রতারক রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা দেই। যেগুলো আমার দ্বারা সম্ভব।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই বিতর্কিত হাসপাতালে সিজার ও ক্যান্সারসহ প্রায় সব রোগের রোগী এনে চিকিৎসার নামে ভর্তি করানো হয়। এমবিবিএস দাবিদার রেজাউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এমবিবিএস সনদই না থাকা, দেশি-বিদেশি ভুয়া চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ডিগ্রি নিয়ে মিথ্যাচার করা।
অভিযুক্ত রেজাউল করিম তার এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে দুই বছর আগে গণমাধ্যমে যে তথ্য দিয়েছিলেন, বর্তমান কথার সঙ্গে তার মিল নেই। দুই বছর আগে এই প্রতারক বলেছিলেন, ‘এইচএসসি ঢাকার মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে শেষ করেছি।’ কিন্তু এখন বলছেন, ‘গোপালগঞ্জ লালমিয়া সিটি কলেজ।’
বিভিন্ন সময়ে অপ-চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। এমনকি মামলায় জেলও খেটেছেন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে।
অভিযান চালিয়ে ল্যাবটি প্রশাসন বন্ধ করলেও কিছুদিন পর পুনরায় অদৃশ্য শক্তিতে চালুর কথা জানিয়েছেন খোদ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শওকত আলী প্ল্যাটফর্মকে জানিয়েছেন, ‘তিনি ভারতের একটি সনদপত্র দেখান, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। আপনি দেশের বাইরে এমবিবিএস কম্প্লিট করলে দেশে এসে পরীক্ষা দিয়ে বিএমডিসি সনদ নেয়ার কথা। কিন্তু তার বিএমডিসি সনদ নাই! এজন্য এটার কোনো বৈধতা নেই। তিনি যেহেতু এমবিবিএস-ই না, ফলে তার দেখানো এসব ডিগ্রির কোনো দাম নেই। এর বাইরে তার সিএমইউ-ডিএমইউ কোন ডিগ্রিই নাই।’
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বরাতে জানা গেছে প্রতারক রেজাউলকে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। তিনি আবার জেল থেকে বেরিয়ে আগের মতো একই কাজ করেন।
অভিযোগ আছে, গাড়িতে সাংবাদিক স্টিকারের ফুটেজ দেখে অপকর্ম আড়াল করতে ডাক্তার দাবিদার রেজাউল করিম নিজেকে সাংবাদিকও পরিচয় দেন। রোগী ধরার ১৫-২০ জনের শক্তিশালী দালাল চক্রও তৈরি করেছে এই প্রতারক। প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেই চক্রের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন অনেকেই।
নার্স নিয়োগের নামে এমনকি নারী রোগীদের সঙ্গেও রেজাউলের যৌন কুপ্রস্তাবের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সবশেষ নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে বলে জানা যায়।
ভুক্তভোগী নার্স ও নারী রোগীরা জানান, তিনি নানা সময় নার্সদের যৌন হয়রানি করতেন। সিজার শেষেই তিনি এক নারীকে কুপ্রস্তাব দেন এবং সেটা ভুক্তভোগী নারীর পরিবার জানতে পারলে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। আরেক নারী মামলা করেও বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তবে এ বিষয়ে যথারীতি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দাবি করে নিজেকে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী ডাক্তার বলতে অনঢ়। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমডিসি কোনো রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখাতে পারেননি তিনি।
এমবিবিএস চিকিৎসক দাবিদার প্রতারক মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি এমবিবিএস ডাক্তার। এখন কেউ যদি আমাকে হয়রানি করতে কিছু বলে, বলতে পারে। তারা বিএমডিসির ডাক্তার, আমরা এনএমওর ডাক্তার। তারা আমাদের থেকে আলাদা। তারা চাচ্ছে আমাদের ছোট করতে।’
এর আগে, আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসনের স্থানীয় অসাধু কর্তাদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে চিকিৎসা চালানোর অভিযোগ থাকলেও, বর্তমান প্রশাসন যেকোনো ধরনের অপকর্ম ঠেকাতে নজরদারি বাড়াচ্ছে, বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সময় সংবাদের বরাতে জানা যায়, উজিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলী সুজা বলেছেন, ‘এখানে যদি কাউকে ম্যানেজ করে এমন কর্মকাণ্ড চালানো হয়, সে বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি। তাকে আমরা নজরদারিতে রাখছি। আমরা খুব দ্রুতই আইনি ব্যবস্থা নেব।’
বরিশালের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাক্তার সব্যসাচী দাস বলেন, ‘ওনার যে ডিগ্রিগুলো দেখান, সেখানে বিএমডিসির স্বীকৃত কোনো ডিগ্রি নেই। ফলে তিনি ডাক্তার লিখতে পারবেন না এবং কোনো রোগীর চিকিৎসা করাতে পারবেন না।’