প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -২৫
” নার্স শিউলি আপা “
লেখক: ডা: আশিকুর রহমান রুপম,
সহকারী রেজিস্ট্রার, সার্জারি, বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সাল টা ২০১৭… সবে মাত্র ইন্টার্নশিপ শেষ করেছি। হাতে কাম কাজ না থাকায়, প্রাইভেট একটা হাসপাতালে অন-কল ডিউটি করি। তো একদিন রাতে ফলো আপ শেষ করে ওয়ার্ডের মধ্যেই কথা বলছিলাম সিনিয়র নার্স শিউলি আপার সাথে। সংগত কারনে, আপার আসল নাম, হাসপাতালের নাম এবং তার ঠিকানা গোপন রাখলাম। আপার বয়স চল্লিশোর্ধ হবে। হাতের কাজে খুবই দক্ষ। একদিন নাইট ডিউটিতে একটা খুব যুবকের বয়সের রোগী হঠাৎ সেপ্টিক শকে চলে যায়, তখন ওতো ভাল বুঝতাম না। হঠাৎ রোগীর জ্বর আসে শরির কেপে কেপে। আমি ফোন পেয়ে দৌড়ে এসে দেখি পালস থ্রেডি, বিপি ফল করেছে, রোগী ডিপ শ্যালো ব্রেদ নিচ্ছে। খুব অল্প জ্ঞানে বুঝেছিলাম রোগী শকে যাচ্ছে। সিনিয়র কল করলাম। তখনই দেখলাম নার্স শিউলি আপা ঝাপিয়ে পড়লেন। সবাইকে ডাক দিলেন। মুহুর্তের মধ্যে একটা টিম হয়ে গেল। একজন লেপ দিয়ে ঢেকে দিলেন। আপা আরেকটা ক্যানুলা করে স্যালাইন রানিং ড্রপে শুরু করলেন। একজনকে পাঠালেন ওটি থেকে কার্ডিয়াক মনিটর আনতে। আমি সদ্য পাশ ডাক্তার, আমার তেমন মাথায় কিছুই কাজ করছিল না। আমি ভাবলাম রোগীকে সরকারি হাসপাতালে রেফার্ড করবো। আপা বললেন, ভাইয়া রোগীকে পাঠালে রাস্তায় খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। আমরা বরং এখানেই আরেকটু চেষ্টা করি। এর মধ্যে সিনিয়র কল করে বললেন ২ আম্পুল কটসন দিয়ে দাও। আমি বলা মাত্রই আপা দিয়ে দিলেন। সবার অনেক ছোটাছুটি। রোগীর লোকজনের কান্নাকাটি। সবকিছুর মাঝে আল্লাহ তায়ালা সেদিন রোগীকে বাচিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ওয়ার্ডে গেলেই আমি আপার সাথে কথা বলতাম, গল্প করতাম।
তো সেদিনো ফলো আপ শেষ করে আপা কেমন আছেন জানতে চাইলে, আপা খুব কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন – “আমাদের আবার ভাল থাকা”, আমরা ছোট খাটো মানুষ।”
-কেন আপা? কি হয়েছে?
-আর দু:খের কথা শুনেন না ভাই।
-ছোট ভাই মনে করে বলতে পারে।
এরপর আপা তার জীবনের যে ঘটনাটা বললেন, তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আপা বহুদিন সৌদি আরবে চাকরি করে এসে নিজ দেশে নার্সের চাকরি করছেন। আপার বিয়ে হয় এক ডিভোর্সড লোকের সাথে। যার ঘরে ছিল তিনটি সন্তান। ২ ছেলে, ১ মেয়ে। লোকটা খুব ধার্মিক টাইপের ছিলেন। তার পূর্বের স্ত্রীর চারিত্রিক স্খলনজনিত কারনে তার সাথে সংসার ভেঙে যায়। সে অনেক বড় ঘটনা। সেদিকে নাইবা গেলাম। কারো চরিত্র বিশ্লেষন কোনো দিনই আমার আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠেনি।
যাই হোক, তার ঐ স্ত্রী তার মেয়ে নিয়ে যায় আর ছেলে দুইটাকে রেখে যায়। শিউলি আপার সাথে যখন ঐ লোকের বিয়ে হয়, তখন আপা এই সিংসারে এসে ছেলে দুইটাকে আপন করে নেন।
এমন লোককে কেন বিয়ে করলেন? জানতে চাইলে আপা বলেন তার পরিচিত অনেকেই তাকে বুঝিয়েছেন। কারন লোকটি সত্যিই খুব ভাল এবং ধার্মিক ছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পরে, ছোট বাচ্চাটির লিউকিমিয়া ধরা পড়ে। তখন আপা বাচ্চাটিকে নিয়ে ঢাকায় ১২ দিন ছিলেন কোনো একটি হাসপাতালে। বলতে বলতে আবারো আপার গলা ধরে আসে। একটু দম নিয়ে আবার বলতে থাকেন। ১২ দিন পর বাচ্চাটা তার কোলে থাকা অবস্থাতেই মারা গেল। মোবাইলে ছবি দেখালেন- বাচ্চাটার। এতদিন পরও মোবাইলে ছবি রেখেছেন, বাচ্চাটা কি বলে ডাকত, কি করত সব বলছেন- কথা গুলো যে নিখাদ ভালবাসার, তা অবিশ্বাস করার ক্ষমতা ছিল না আমার। তারপর ঘটল আসল ঘটনা। লোকটার বেচে থাকা একটাই ছেলে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে মেডিকেল প্রিপারেশন নিয়ে চান্স পেল না। তখন শিউলি আপা একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাকরি করতেন। কলেজ কর্তৃপক্ষকে অনেক অনুনয় বিণয় করে ছেলেটা তার ছেলে দেখিয়স গরিব মেধাবি কোটায় অর্থাৎ একদম ফ্রি তে ভর্তি করলেন কলেজে। ভাবা যায়- একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে বিনামূল্যে পড়তে পারার সুযোগ ছেলেটি পেল, শিউলি আপার ছেলে পরিচয়ে। ছেলেটি তখন এমবিবিএস ২য় বর্ষে। এখন ছেলেটি আর আপাকে মা বলে ডাকে না। সব সময় নাকি আপার সাথে খারাপ আচরণ করে। খাবারের তরকারি পছন্দ না হলে রাগ দেখায়, ঝগড়া করে। যে ছেলে তার বাবার উপর কথা বলতে পারত না, সেই ছেলে এখন বাবার সাথে গিয়ে চিৎকার করে কথা বলে। শিউলি আপার নামে বদনাম করে। এমনকি আপার সামনেও নাকি আপাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বাবার সাথে ঝগড়া করে।
এভাবেই চলছে শিউলি আপার জীবন… বলে ভাই, বলেন কি করে ভাল থাকি?