সেই মেডিক্যাল কলেজের দিনগুলোর কথা; সবে মাত্র গান লেখা শুরু করেছি; প্রায় প্রতিদিন হোস্টেলে চলে আসে হ্যাপি আখান্দ আর আমার রুমে বসে গীটার বাজায়। আর আমি সুযোগ পেলেই চলে যাই লাকী ভাইয়ের বাসায় আজিমপুর কলোনি থেকে মিরপুরের কলোনী, পরে রাজারবাগ, সব শেষে আরমানীটোলায়.
আমাদের বাৎসরিক পিকনিক হবে। আয়োজন হলো সারাদিন জাহাজে করে বুড়িগঙ্গায় ভেসে বেড়ানো হবে। সকাল বেলা জাহাজ ছাড়া হলো মিটফোর্ড থেকে। ভাটির দিকে চলবে সারাদিন। দুপুরে জাহাজের মধ্যেই রান্না এবং খাওয়া দাওয়া। সে এক হুলস্থূল কাণ্ড, আনন্দ। সবাই দেখেছে আমি আমার এক বন্ধু কে সঙ্গে নিয়ে এসেছি যে চাপ দাড়িওয়ালা, চোখে সান গ্লাস। মাথায় পাগড়ির মতো কাপড় বাঁধা। আমার এই বন্ধু বেরসিক এবং অসামজিক ধরনের, কারণ সে সারাক্ষণ একটি কেবিনে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। আমি তাঁকে প্লেটে খাবার দিয়ে আসি। দু’একজন কৌতুহলি হয়ে জিগ্যেস করলে বলি- এক বন্ধু, ওর মন খারাপ তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
জাহাজ চলতে চলতে যখন পড়ন্ত বিকেল তখন জাহাজের ছাদের ওপরে গোল হয়ে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমি উপস্থাপনা করছি। একজন একজন করে আমাদের ক্লাসের ছেলে মেয়েরা কেউ কেউ একা কেউ কেউ দলগত সংগীত পরিবেশন করলো। কেউ কবিতা আবৃত্তি করলো, কেউ বলে কৌতুক। আর আমার লেখা প্যারাডি গান তো আছেই যা মিটফোর্ডের যে কোন অনুষ্ঠান হিট আইটেম হিসাবে থাকতো। কিন্তু আজকে প্যারোডি শেষ করে আমি একটু সিরিয়াস হয়ে গেলাম; বললাম,
-আচ্ছা, এই রক্তিম বিকেলের আলো পার হয়ে সন্ধ্যা আসি আসি করছে। এই সময় যদি লাকী আখান্দের গাওয়া ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা গানটা গাই তাহলে কেমন হয়? কেউ কেউ চিৎকার করে,
– আরে রাখ তো আতলামি প্যাঁচাল, গানটা ধর। আমি বলি,
-না, গান তো ধরবোই, কিন্তু যদি গানটা আমাদের সঙ্গে লাকী আখান্দ ধরেন তাহলে কেমন হয়? আবারো কয়েকজনের চিৎকার-
– এই তোর চাপাবাজি বন্ধ কর। গানটা ধর। আমি গান ধরলাম,
“আবার এলো যে সন্ধ্যা শুধু দুজনে, চলো না ঘুরে আসি অজানাতে …”
ঠিক তখন আমার সেই চাপ দাড়িওলা বন্ধু সকলের সামনে এগিয়ে এসে একে একে পাগড়ি, দাড়ি, সানগ্লাস খুলে ফেলে মাইক হাতে নিলেন এবং গান ধরলেন, আবার এলো যে সন্ধ্যা…… তিনি আর কেউ নন স্বয়ং লাকী আখান্দ। এতক্ষণ এভাবেই ছদ্মবেশে ছিলেন আমাদের মাঝে। বুঝতেই পারছেন আমার ক্লাসমেট ছাত্রছাত্রীদের কী অবস্থা হতে পারে! সকলের উন্মাতাল চিৎকার, আনন্দ, উল্লাস।
হ্যাঁ, লাকী ভাইকে এই প্রস্তাবটা যখন দিয়েছিলাম, যেখানে সবাই তাঁকে টাকা পয়সা দিয়ে নিয়ে অনুষ্ঠান করে, আর আমি কিছুই দেবো না শুধু সকলের জন্যে সারপ্রাইজ ছাড়া, তিনি বলেছিলেন ‘তুমি আমাদের মতোই পাগল, চলো মজা করি”।
এভাবেই লাকী আখান্দ শুধু আমার গানের জগতে নয় আমার মননে এঁকে দিয়েছেন এক ধরনের প্রশ্রয়, অহংকার, স্নেহ, ভালবাসা। এই যে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে আর আমি পাশে হাটুভেঙ্গে বসে, এমন কত যে রাত কেটেছে গান নিয়ে; এক সময় মধ্য রাতে নিজে উঠে গিয়ে ভাত চড়িয়ে, শিং মাছের ঝোল রেঁধে খাইয়েছেন। এতো শুধু গান করার জন্যে না; একজন মানুষ হিসাবে কোথায় যেন যোগসূত্র গেঁথে গিয়েছিল বয়সের ব্যবধান পার হয়ে। আমি আমার কোন আপন আত্নীয়কে হারিয়েও তো এতোটা নিঃস্ববোধ করবো না। এতো টা চোখের জল ফেলবো না। শেষবার বাংলাদেশ থেকে আসার সময় বলেছিলেন, আমাকে নিয়ে যাও, একটা স্টুডিও বানাও ওখানে…
আমরা কেউ কাউকে নিতে পারি না লাকী ভাই, শুধু বুকের মধ্যে ধারণ করতে পারি। চির বিদায়, চিরদিন থাকবেন আমাদের বুকের চিনচিনে ব্যাথায়, আনন্দে, গানে, স্মৃতিতে……
…….
লিখেছেনঃ
ডা. সেজান মাহমুদ
চিকিৎসক এবং লেখক।