লেখক- ডাঃ বদর উদ্দিন উমর
সাবেক সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ ফার্মাকোলজি, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ।
এক
হঠাৎ করেই সব ঠিক ঠাক পাকিস্তানে ডাক্তারি পড়তে যাবো। ভাবিনি এভাবে বিদেশে চলে যেতে হবে , বাবা-মা, ভাই-বোন, নানা-নানী সব্বাই কে ছেড়ে। ইচ্ছে হলেই যখন-তখন আর ফেরা যাবে না। আমার মতো যারা অনেক আদরে মানুষ, এক দিনের জন্যও পরিচিত পরিবেশ ছাড়া লাগেনি কখনো, তারপর হঠাৎই দূরে চলে যাওয়া তারাই বুঝবেন যে কি ভয়াবহ ব্যাপার ঐ যাওয়া। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পেলাম ’৮৮ এর জুলাইর মাঝামাঝি কোনএকদিন। লেখা ছিল পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর শহরের কায়েদে আজম মেডিকেল কলেজে পড়ার জন্য আমি এবং জাভেদুল ইসলাম নামের আরেকজন মনোনীত হয়েছি। অতি সত্বর আমাদের উক্ত কলেজে যোগাযোগ করতে হবে। ছোট বেলায় মামার কাছ থেকে পাওয়া ষ্ট্যাম্প বুকে বাহাওয়ালপুর এর ডাক টিকেট দেখেছিলাম। এখন খোজ নিয়ে জানলাম পাঞ্জাব প্রদেশের প্রায় দক্ষিণ অংশে ভারতের সীমান্তবর্তী এক মরু শহর বাহাওয়ালপুর। প্রচণ্ড গরম সেই খানে গ্রীষ্ম কালে। এককালে স্বাধীন নওয়াবদের রাজ্য ছিল এটি। এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রা, ডাকটিকেট এমনকি সেনাবাহিনীও ছিল। তখনি শুরু হোল খোঁজা এবং পেয়েও গেলাম নিজের ষ্ট্যাম্প বুকে একটি দুমড়ানো পুরানো ডাকটিকেট! তখন খূব দুঃখ হো’ল এই ভেবে যে, শৈশবে না বুঝে অমন অনেক ষ্ট্যাম্প ছিঁড়ে ফেলেছি খেলাচ্ছলে। আজ সেগুলোই হতে পারতো মূল্যবান সংগ্রহ।
যাহোক, দু’তিন দিনের ভেতরে হাজির হলাম গুলশানের পাকিস্তান-দূতাবাসে। বুক দুরু-দুরু, পকেটে বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট, হাতে ফাইল বন্দী শিক্ষাগত সনদপত্র এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি। ভিসার জন্য ফর্ম পাওয়া গেল সহজেই। যথাযথ ভাবে তা পূরণ করে লাইনে দাঁড়ালাম। একজন একজন করে সামনে ডাকা হচ্ছে, কারো পাসপোর্ট রেখে দেয়া হচ্ছে একটা করে চিরকুট আর কারোটা ফিরিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে বিদায় নিতে। আমি তো তখন ভয়ে ঘেমে একদম নেয়ে উঠেছি। ডাক পরল আমার, ভাবলাম ইংরেজিতে না উর্দুতে কি না কি জিজ্ঞেস করে! প্রায় শুদ্ধ বাংলায় সৌম্যদর্শন এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি চাই। ফর্ম সহ ফাইলের সব কাগজ তার হাতে তুলে দিলাম। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটি স্মিত হাসি দিয়ে পাসপোর্টটি চেয়ে নিলেন এবং শূভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, আপনি আমাদের দেশে পড়তে যাচ্ছেন। বাহাওয়ালপুর গরম জায়গা হলেও খুব সুন্দর। আমাকে সেদিন বিকেলেই পাসপোর্ট ফেরত নিতে বলা হল। এতদূর নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়াতে খুশী মনে বাড়ী ফিরলাম।
এবার বিমানের টিকেট কাটার পালা। দৌড়াদৌড়ি করে আমার প্রাক্তন কলেজের অধ্যক্ষের সিল-সই নিলাম কনসেশন ফর্মে। তারপর বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে বহু কাগজ পত্র দেখিয়ে বিমানের কর্তা ব্যাক্তিদের বোঝাতে পারলাম যে, আমি সত্যি সত্যি পরতে যাচ্ছি। ২৫% কনসেশণ দেয়া হল। টিকেট সহ সবই তৈরি এখন আসল প্রস্তুতির পালা। ১৬ জুলাই ফ্লাইট-হাতে এক সপ্তাহের কম সময় আমার। বিদেশ বিভূঁইয়ে কি কি জিনিষের প্রয়োজন হতে পারে লিস্টি করে একে একে ভরা হতে লাগল স্যুটকেসে। প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তির টাকা জমা ছিল ব্যাংকে-তা দিয়ে কেনা হল ছোটো খাটো এক খানা টুইন-ওয়ান। গান ছাড়া আগেই আমার পক্ষে একদিনও কাটানো সম্ভব ছিলনা আর এখনতো যাচ্ছি বিদেশে। কিভাবে দিন কাটবে গান ছাড়া, তাই এই কাজ। রোজ দাওয়াত খেয়ে বেড়াচ্ছি নানী, খালা আর চাচার বাসায়। প্রচণ্ড গরমের দিন হলেও মায়ের চলল পিঠা বানানোর ধুম। কি জানি ছেলে আবার কত দিন বাদে ফিরতে পারবে!
দুই
পাকিস্তান সম্পর্কে একটা ভালো ধারনাই ছিল আমার। বাবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরীর সুবাদে ছোট্ট বেলায় কিছুদিন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে থাকা হয়েছিলো। পাক-হানাদার ও কুচক্রী ভূট্টো-ইয়াহিয়ার দল বাদে পাকিস্তানের সাধারন মানুষ বেশ সহজ সরল। কড়া ইসলামি আইনের অনুসারী সবাই আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভাল। কিন্তু প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাই আমার সব ধারনা একেবারেই পাল্টে দিল
জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বাবা-মা সহ সবাই কেঁদে কেটে বিদায় জানাল। যতক্ষণ দেখা যায় ইমিগ্রেশন কাউণ্টার এর কাঁচের মধ্যে দিয়ে তাদের হাত নাড়া দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম ডিপারচার লাউজ্ঞে। যথা সময়ে বিমানে আরোহণ করার অনুরোধ জানানো হল। বিমানে বসার পর থেকেই অজানা এক ভয় এবং আশংকা আমাকে গ্রাস করল। না জানি কেমন লোকজনের মুখো মুখি হব! কেমন ভাবে সবাই গ্রহন করবে ওদেশে! ভরসা ছিলেন সারওার ভাই। উনিও আমি যেই কলেজে যাচ্ছি সেখানেই ফাইনাল ইয়ারে পড়ছিলেন। সেই বছর যখন গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে এসেছিলেন তখনি ওনার সঙ্গে আলাপ, তাও দৈবক্রমে। যাহোক উনিতো থাকবেন বাহাওয়ালপুরে। অতদুর পৌঁছার আগে পর্যন্ত তো আমাকেই একা যেতে হবে। করাচী থেকে ট্রেনে ১২-১৪ ঘণ্টার পথ, কিভাবে একা একা যাব ভেবেই ভয়ে আমি অস্থির। বিমানে আমার পাশের আসনে বসা ভদ্রলোক আমাকে উদ্ধার করলেন এই ভয় থেকে। ওনার সঙ্গে আলাপে জানতে পারলাম উনি আধা বাঙ্গালি-আধা পাকিস্তানি। অর্থাৎ পরিবারের অর্ধেক এদেশে আর বাকি অর্ধেক ওদেশে। তাই ওনাকে প্রায়ই যাওয়া আসা করতে হয়। নাম বল্লেন, আফ্রিকাওালা। চট্টগ্রামে তার নাকি বিরাট বিজনেস, রি-রোলিং মিল, জাহাজ ভাঙ্গার কাজ আরও বহু কিছু। করাচী পৌঁছে উনিই আমাকে রেল ষ্টেশনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলেন। ওনার যে কর্মচারী আমাকে তুলে দিতে এলেন তিনি বহু দৌড়া দৌড়ী করে ৩০ রুপী বেশী দিয়ে কুলির কাছ থেকে ব্ল্যাকে টিকেট কেটে দিলেন। চড়ে বসলাম ‘চেনাব এক্সপ্রেসের ইকনমি ক্লাস এর একটা কামরাতে। যেহেতু ভাষা জানিনা তাই ভাবলাম চুপচাপ বসে থাকা বা ঘুম দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। রাতের জার্নি, তাই দেখারও বিশেষ কিছু নাই। তারউপর আছে প্রচণ্ড গরম। ট্রেন কখনও থামে কখনও চলে, আমি ঘুমিয়েই চলি। মাঝে হঠাৎ যদি চোখ খুলে যায় দেখে নেই বাক্স প্যাটরা গুলো বহাল তবিয়তে আছে কি না। এভাবে কতক্ষণ ছলেছিল জানিনা। এক সময় ট্রেন অনেক বেশিক্ষণ থেমে থাকাতে ঘুম ছুটে গেল। চোখ খুলে দেখি ভোরের আকাশে রঙ লাগা শুরু হয়েছে। আমি নেমে প্ল্যাটফর্মের কলে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। আবার এসে আমার জানালার পাশের আসনে বসে পরলাম- কি জানি কখন ছেড়ে যায় গাড়ি সেই ভয়ে। কিছুক্ষণ পর দেখি দু’তিন জন পুলিশ বার বার শুধু আমার জানালার পাশ দিয়ে যায় আর আসে আর ঘুরে ঘুরেই আমাকে দেখে। ব্যাপার টা কি? হঠাৎই ওদের একজন সোজা আমার কাছে এসে জানতে চাইলো – “কাহাঁ জায়েগা”? ভিসিআর এ হিন্দি ছবি দেখে অতটুকু তো বুঝতে শিখেছি। আমিও জবাব দিলাম বাহাওালপুর। এর পরেই সে আরও কিছু কথা জিজ্ঞেস করল যার বিন্দু বিসর্গও বোঝা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। তাই হাবার মতন চেয়ে থাকলাম। ব্যাটা বূঝলো কোন একটা গড়বড় আছে। জিজ্ঞেস করল – “কাহাঁ সে আয়া”? এবার বূঝলাম কোথা থেকে এসেছি জানতে ছাচ্ছে। বললাম বাংলাদেশ। আর যায় কোথায়! ব্যাটা সোজা উঠে এলো ট্রেনের কামরাতে। বলল- “পাসপোর্ট দেখাও”। দিলাম পাসপোর্ট বের করে। উল্টে পাল্টে, কখনও সোজা কখনও উল্টা করে ধরে, সে কি বুঝল সেই জানে! পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে খুব গম্ভীর ভাব করে বলল- “তাল্লাসি লেনা হ্যাঁয়”। এমন কমন হিন্দি ছবির ডাএলগ কোন গাধা না বুঝে? আমি উঠে দাঁড়ালাম। প্রথমে আমার সমস্ত শরীর হাত বুলিয়ে দেখল সে। তারপর বলল সুটকেস খুলে দেখাও। তখন বুঝিনি কি বিপত্তিতে পরতে যাচ্ছি। সব জিনিষপত্র উল্টে পাল্টে শুরু হল খোঁজ। হঠাৎ করেই কতগুলো ১০০ ডলার এর নোট বেরিয়ে পরল কয়েক জায়গা থেকে। আমি ভেবেছিলাম একসাথে না রেখে দু’চার জায়গাতে রাখাই বুঝি নিরাপদ- চোর চুরি করতে চাইলেও সব একসাথে পাবে না। এদিকে এদেখি চোরেরও বাবা। সব গুনে দেখে ৬০০ ডলার মোট। এর পর যা ঘটলো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ভুল-ভাল ইংরেজিতে বলে কিনা ‘এগুলি অবৈধ টাকা, তোমাকে থানাএ যেতে হবে। এতগুলো অবৈধ টাকা নিয়ে তুমি আমাদের দেশে ঢুকেছ’। আমিতো তখন যেন আকাশ থেকে পড়েছি। বহু ভাবে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম – কিছু ভাঙ্গা উর্দুতে, কিছু ইংরেজিতে বল্লাম যে, আমি ছাত্র, ডাক্তারি পড়তে এই দেশে এসেছি সরকারি ভাবে এবং যে টাকা এনেছি তার অনুমতি পাসপোর্টে আছে। চালু ব্যাটা বলে এখানে তো শুধু ৪০০ ডলারের কোথা লিখা আছে (তখন সার্ক দেশের জন্য ৪০০ ডলারই ছিল সর্বোচ্চ অনুমোদন)। বুঝলাম ব্যাটা পুরাপুরি গবেট না। বুঝলাম এপথে কাজ হবেনা, অন্য পথ ধরতে হবে। কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললাম, ভাই আমি অনেক দূর থেকে এসেছি, এখানে আমার সারা বছরের খরচ। দয়া করে দিয়ে দাও। আমি থানা এ যেতে পারবনা। আমাকে অতিসত্বর বাহাওালপুরে রিপোর্ট করতে হবে। এর পরেও বুঝি আমার জন্য ছিল আরও চমক। এবার বলল, তোমার ঐ অতিরিক্ত ২০০ ডলার আমাদের দিয়ে দাও। আমি বললাম, হতেই পারেনা তাহলে আমি সারা বছর চলব কি দিয়ে? খাবো কি? এবার বোলে কিনা, ‘তাইলে অর্ধেক দাও’। আমি বুঝে গেলাম দামা দামি করার চান্স পাওয়া যাচ্ছে, দেখি ওরা কত পর্যন্ত নামে! বল্লাম না ভাই এটাও আমার জন্য সম্ভব না! ‘কত করে ভাঙ্গিয়েছ করাচীতে’? কমিয়েই বল্লাম ১০০ ডলারে ১৭৫০/= রুপি। বলে, ‘বেশ তাহলে এক হাজার রুপিই দাও’। তার পরও আমার কাকুতি মিনতি চলতে থাকল। হয়তো ওদের মন নরম হল বা গাড়ী ছাড়ার সময় হয়ে এলো। বলল- ‘বেশ তাহলে আমাদের ৫০০ রুপিই দাও। ৫০০ রুপি নিয়ে একটা ছোট নোট বইএ কিজানি কি সব লিখল। তারপর বলল দাও এখানে একটা সই দাও। ভাবলাম একটা সই এর বদলে যদি এদের হাত থেকে মুক্তি পাই তাহলে ক্ষতি কি? টাকাটা নিয়ে ব্যাটা হাবিলদার নেমে চলে গেল। আমি হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ওরে বাবা! কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি সে আবার এসে হাজির। এক পাশে ডেকে নিয়ে বলে, ‘আমার সঙ্গিরা রাজি হচ্ছেনা। তুমি আর কিছু দাও’। বুঝলাম ভাগাভাগির সমস্যা। তার হাতে আর একশ রুপি গুঁজে দিলাম। সে গুটি গুটি পায়ে চলে গেল। ট্রেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্টেশন ছেড়ে চলল উত্তর-পূর্ব দিকে বাহাওালপুরের পথে। পরে জেনেছিলাম ওই স্টেশনের নাম ছিল ‘রোহড়ি’। সকাল নয়টা নাগাদ পৌঁছলাম গন্তব্যে।
আমার এই প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ বড় একটা ধাক্কা দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে আমি এমন একটা দেশে এসেছি যেখানে দুর্নীতি আমার দেশের চাইতে কম নয়। পরে অবশ্য পদে পদে এর প্রচুর প্রমান পেয়েছি। আর বুঝেছি ইসলামের লেবাস পড়া ওই ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ আসলে ইসলামের নাম বিক্রি করে খাচ্ছে। এর পাশা পাশি আরেকটি উপলব্ধি হয়েছিল যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হ’ল বিদেশি হিসাবে নিরাপত্তার অভাব। নিজ দেশে অমন বিপদে পড়লে কোন দিনই অতটা অসহায় বোধ করতাম না স্বাভাবিকভাবেই। যে দেশে কেউ আমাকে চিনেনা, ক্ষমতাধর কাউকেই জানিনা, সেদেশে বিপদে পড়লে কে এগিয়ে আসবে বাঁচাতে?
সংশোধনীঃ ডাঃ বদর উদ্দিন উমর, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ এর ফার্মাকলোজি বিভাগ এর সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। বর্তমানে মালয়েশিয়া এ এ আই এম এস টি ইউনিভার্সিটি তে সিনিয়ার লেকচারার হিসাবে কর্মরত আছেন।
—– ভুলে সহকারী অধ্যাপক, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ছাপা হয়েছে।