#Platform_Travelling_Club
দীর্ঘ সময় নিয়ে প্ল্যান করা একটি হুটহাট ট্র্যাকের গল্প বলা যায় একে। কেওক্রাডাং! বগালেক! রিজুক ঝর্না! অসম্ভব সুন্দর কিছু জায়গা,স্বল্প কিছু শব্দে বলার চেষ্টা! অপরিমেয় সৌন্দর্যকে পরিমিত ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার প্রচেষ্টা!
দল গঠিত হয়েছিল অনেককেই নিয়ে। ডাক্তারি জীবনে আর যা কিছু থাকুক নিশ্চয়তা বলে কোন শব্দ অভিধানে নেই। দলের বেশিভাগ সদস্যর ক্ষেত্রে ব্যপারটা সত্য ছিল। হঠাৎ আসা ডিউটি, একনাগারে করা ডিউটির কারনে অসুস্থতা আর পরীক্ষার ভীরে শেষমেশ দল গঠন হল ৫ জন কে নিয়ে। গাইড বেলাল সহ সংখ্যা দাঁড়াল ৬ এ।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে সকাল ৮ টার দিকে সবাই চট্টলা পৌঁছালেন। ঢাকা এবং সিলেটের সবাই মিলিত হলেন বদ্দারহাট বাস টার্মিনালে এ। বান্দারবানের বাস ধরে রওনা দিতে দিতে বাজল ৯ টা। ইভেন্ট হোস্ট অদিতি একটু চিন্তায় পড়লেন। বিকাল ৩ টার পর রুমা থেকে আর্মি বগালেকের উদ্দেশ্যে যাত্রার অনুমতি দেয় না। বান্দারবান পৌছাতে ১২.৩০ এর উপর বাজবে।বান্দারবান থেকে রুমা সময়মত পৌঁছান সম্ভব? না হলে রুমা তে কই থাকা যায়? চিন্তায় চিন্তিত হয়ে উনি বান্দারবানগামী বাসে ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন পরের টা পরে দেখা যাবে বলে।
ঘুম ভাঙ্গলে দেখা গেল বান্দারবান বাজারে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি আর আদিবাসির এক মিলনমেলা! রঙ, বর্ণ, আদিবাসী আর বাংলা ভাষার কলরোলে এক অদ্ভুত সুন্দর রোদজ্জল দুপুর। সময় বেশি ছিল না, উপভোগ করা গেল না। রিজার্ভ গাড়ি তৈরি ছিল। প্যাকেট লাঞ্চ নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসা হল।
রওনা হলাম রুমার পথে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রাস্তা। সূর্যের আলোয় পাহাড়গুলো দিপ্তমান হয়ে আছে। সবুজে ঘেরা সবকিছু। রোদের ঝিকিমিকি গাছের পাতায়। আকাশ গাড় নীল। বিরামহীন সৌন্দর্যে হয়ত হারিয়ে যাওয়া যেত যদি পাহাড়ের ধার ঘেঁষে তীব্র বাঁক গুলো না থাকত।একটু এদিক সেদিক হলেই পাহাড়ের কোলে গাড়ি পড়ে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটবে। ভয়ংকর সৌন্দর্য হয়ত একেই বলে!
তিনটার সামান্য আগে রুমাতে পৌঁছলাম সবাই। তাড়াহুড়ো করে সব ফর্ম পুরন করে অনুমতি পাওয়া গেল বগা লেক এ যাওয়ার। বগালেক এ আগে যেতে সময় লাগত সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা,হেঁটে। গাড়ি এখন যে জায়গায় নামায় সেখান থেকে এখন হেঁটে যেতে লাগে এক ঘণ্টা। ট্র্যাকিং এর মজাটা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে সভ্যতার আগ্রাসনের ফলে। আগ্রাসনের হয়ত প্রয়োজন দুর্গম অঞ্চল গুলোতে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলটা হয়ত এটাই মনে করিয়ে দেয়। আমরা প্লাটফর্ম থেকে গিয়ে চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে আদিবাসী গোষ্ঠীর বিভিন্ন মানুষদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। পরে কোন এক সময় তা তুলে ধরব।
বগালেকের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু হল। পাহাড়ের গায়ে পড়ন্ত বিকালের রোদ। ঠাণ্ডা পরিবেশ কিন্তু আমাদের ঠাণ্ডা লাগার কোন উপায় ছিল না। পাহাড়ি পাথুরে রাস্তা, খাড়া উঠতে হচ্ছিল। প্রচণ্ড শীতে দরদর করে ঘামছি। বেকপ্যাকিং ট্যুর। ব্যাগ রাখার উপায় নেই, চিকন রাস্তা। দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য দেখার উপায় আছে। পাহাড়ের ঢাল ধরে অপরিমেয় সবুজ,ঝাক বেঁধে পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে এই পৌঁছে গেলাম বগালেকে। কথিত আছে, বগালেক একজন দেবতা, কেউ যদি এখানে এসে কোন খারাপ কাজ করে দেবতা তাকে শাস্তি দেন। চতুর্দিকে পাহাড়ের মাঝখানে বিশাল বড় একটা লেক। এই লেকটিতে নেচারাল পেডিকিউর করা যায়! ট্র্যাকারদের জন্য এটা অনেক আকর্ষণীয় বিষয়।
সবাই অনেক ক্লান্ত ছিলাম। হাত পা ধুয়ে কটেজে বসে গল্পে মেতে উঠলাম। রাত যত জাকিয়ে বসল ঠাণ্ডা তত বাড়তে লাগল। গাইড বেলাল ভাই প্রস্তাব আনলেন, ক্যাম্প ফায়ার করার। সানন্দে সায় দিলাম সবাই। রাতে সিয়াম দি খাওয়ালেন জম্পেশ। পেঁয়াজ ভর্তা, ডিম ভাজি,ডাল আর একটা নিরামিষ তরকারি। খেয়ে দেয়ে হাট ঘষতে ঘষতে ঠাণ্ডা ভাব কমানোর চেষ্টা করতে করতে বের হয়ে আসলাম। শুরু হল ফানুশ ওড়ানো। রাতের অন্ধকারের মধ্যে জলন্ত আগুন দূর দুরান্তে ভেসে যাচ্ছিল আমাদের উপ্সস্থিতির প্রমান নিয়ে। মোবাইলে মুহূর্তের নেটওয়ার্কে বাইরের জগতের খবর আসল……… শৈত্য প্রবাহ আসছে। সবার মুখ শুকিয়ে আসল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আরো ঠাণ্ডা যোগ হচ্ছে। বেলাল ভাই একটা গ্রমখবর দিলেন। ফায়ার ক্যাম্পের ব্যবস্থা হয়েছে! গিটার নিয়ে বসলেন তন্ময় সূর্য। আগুনের উষ্ণতায় সবাই গলা মেলালাম। বেলাল ভাইর গলায় চাটগার আঞ্চলিক গান, আমাদের আধুনিক গান, অন্ধকার রাতের মধ্যে একমাত্র আলোর উৎস আগুন আর দূর থেকে ভেসে আসা কোন প্রাণীর ডাক ক্রমশ মুহূর্ত গুলোকে অবিস্মরণীয় করে তুলছিল। রাত একটার দিকে ঘুমোতে গেলাম সবাই। সোয়েটার, মোজা, তিনটা ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে দিয়েও ঘুম হল না ভাল। ঠাণ্ডায় কেঁপে কেঁপে উঠতে হয়েছে কিছুক্ষণ পর পর ই।
সকালবেলায় কটেজের দরজা দিয়ে ঢোকা একফালি রোদ দেখে সবাই খুশি হয়ে উঠলাম। আশ পাশ ঘুরে, সকালের নাস্তা খেয়ে সকাল ১১ টার দিকে যাত্রা শুরু হল কেওক্রাডাঙ্গের উদ্দশ্যে।
আসলাম চিংরি ঝর্ণাতে। ঝরনার নিচে ব্যাগ রেখে সবাই ঝর্নার মুখ দেখার জন্য ঝর্নার জলের মধ্য দিয়ে হাঁটা দিলাম। ঝর্না দেখে অভিভুত হয়ে গেলাম। অনেক উচ্চতা থেকে প্ড়ছে।আর প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে তার বেগ। নিচে নেমে শুনলাম এই ঝর্নার আবিষ্কর্তা আমাদেরই বেলাল ভাইর স্ত্রীর ভাই বেলাল! আবার হাঁটা শুরু হল। বোতল ভরে নেয়া হল এরপর আর পানি নেই। তেমন একটা না থেমে সোজা হেঁটে কেওক্রাডাং পৌছালাম ৪.৩৫ এর দিকে।এবং অভিভুত হয়ে গেলাম। বাংলাদেশের অফিশিয়াল হাইএস্ট পিক এর উপর দাঁড়িয়ে আছি! কাছে আর্মি ক্যাম্প ছিল আর নাহলে চিৎকার ও দিতাম! একটু পর সবাই আসল। মেঘ গুলো সব ভেসে ভেসে যায়, ধরেও ধরতে পারি না।সূর্যর আলো আস্তে আস্তে চলে গেল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আস্থির হয়ে গেলাম সবাই। হঠাৎ দেখি পাহাড়টির মালিক লাল মামা পাহাড়ের ঢালে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। পাহাড় জ্বলছে! বাঁশ ঠাস ঠাস শব্দ করে ফাটছে! এ এক অভাবনীয় সৌন্দর্য!
সকালবেলা সূর্য ওঠা দেখতে হবে তাই সবাই খশির মাংশ,ডাল আর আলু ভর্তা খেয়ে জলদি জলদি ঘুমাতে গেলাম। কিন্তু যাওয়া টাই সার! তাপমাত্রা মারাত্মক রকম কমে গেল। ২ এর কাছাকাছি। কোনমতে ঘুমানোর প্রচেষ্টা। সকালে ঘুম ভেঙ্গে আবার রওনা চূড়ায়। সূর্য উঠতে শুরু করল ৬ টায়। একটু একটু করে লাল আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আর হঠাৎ করে চোখ ধাঁধান সৌন্দর্য নিয়ে সূর্যটা টুপ করে বের হয়ে আসল। সূর্য এত সুন্দর আগে কখন লাগেনি। আশে পাশে কুয়াশা কিন্তু টার মাঝে সূর্য মিষ্টি একটা লাল আভা নিয়ে বসে আছে।
৮ টার দিকে ফিরতি পথ ধরলাম। যেতে হবে রিজুক ঝর্নায়। কমলাবাজারে পৌছালাম ২ টায়। সাঙ্গুর তীরে পৌঁছে আবার অবাক হবার পালা। রোদ পানিতে পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। নৌকা অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। লাঞ্চ প্যাকেট হাতে নিয়ে নৌকাতে বসে চারদিকের সব কিছু দেখতে দেখতে খাওয়া শুরু হল। আধাঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম রিজুক ঝর্নায়। পানির বেগ প্রচুর। এতক্ষণ কেউ এক ফোটা পানিও লাগাই নি কিন্তু আর থাকা গেল না। লাফ দিয়ে গেলাম ঝর্নার নিচে!
বেরসিক বেলাল ভাইর জন্য জলদি রওনা দিতে হল। ঢাকার গাড়ি ধরতে হবে। বাজার এ এসে বেলাল ভাইকে বিদায় দিলাম। বান্দারবান থেকে ঢাকার গাড়িতে উঠলাম ৯.৫০ এ। সারা রাত ঠাণ্ডার মধ্যে থেকে ভোরবেলা পৌছালাম ঢাকায়। যারা সিলেটগামী তারা আবার বাস ধরলেন সিলেটের।
এভাবেই শেষ হল একটি ভ্রমণকাহিনীর যার প্রতিটি মুহূর্ত সবার মধ্যে থাকবে। আবার হয়ত আমরা একত্রিত হব, অন্য কোন অভিযানে হারিয়ে যেতে।
লেখা : Aditi Choudhury, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ, সিলেট।
ছবি- Tanmoy Surjo, Afsana Rimi