ডা. লোটে শেরিং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। বাংলাদেশ থেকেই এমবিবিএস ও এফসিপিএস করে দেশে ফিরে গিয়ে ২০১৩ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি মধ্য-বামপন্থী দল ডরুক নাইয়ামরুপ শোগপা (ডিএনটি) যোগদান করেন। মানুষকে নিয়ে ভাবনা থেকে তার রাজনীতিতে আসা বলে জানান শেরিং।
২০১৮ সালে দেশটির পার্লামেন্টের ৪৭ আসনের মধ্যে ডিএনটি জয়লাভ করে ৩০টি আসনে। আর লোটে শেরিং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট শুরু হওয়ার পর নির্বাচিত হন তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সব দলকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। হিমালয় পাদদেশে ৮০ লাখ মানুষের দেশ ভুটানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তিনি। এর আগে ভুটান সরকারের দেয়া বৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশে পড়াশোনা করতে এসেছিলেন লোটে শেরিং।
রবিবার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে গিয়ে তিনি বলেন, আমি চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছি। কিন্তু আমার পেশাকে ছাড়তে পারিনি। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমি চাকরি না করে, বিদেশে না গিয়ে ভুটানের মানুষকে নিয়ে ভেবেছি। তাদেরকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। তাদেরকে নিয়ে কাজ করেছি। তাই আজ আমি ভুটানের প্রধানমন্ত্রী।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ের স্মৃতিচারণ করে ডা. লোটে শেরিং বলেন, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আমি ও আমার সহপাঠী, অর্থাৎ আমার মন্ত্রিপরিষদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ময়মনসিংহ শহরের বাঘমারা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ২০ নম্বর কক্ষে থেকেছি। এখনো আমরা একসঙ্গে রাজনীতি করছি। দীর্ঘসময়ে আমাদের মাঝে কোনোদিন মনোমালিন্য হয়নি। আমার সেই সহপাঠী বন্ধুর কারণেই আজ আমি প্রধানমন্ত্রী। তিনিই আমাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন।
রাজনীতিতে আসার আগে লোটে শেরিং হাসপাতালে কনসালট্যান্ট সার্জন এবং ইউরোলজিস্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে ২০১৮ সালের শুরুতেই দলকে শীর্ষপর্যায়ে নিয়ে আসেন তিনি।
২০১৩ সালে শেরিং প্রথম জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু তাঁর দল তখন প্রথম রাউন্ডে হেরে যায়। এরপর পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলকে গোছাতে থাকেন। দলের ব্যর্থতা তাকে গণমানুষের আরও কাছে পৌঁছে দেয়। সবাইকে সাথে নিয়ে দেশ থেকে ঋণের বোঝা দূর করার অঙ্গীকার দিয়ে নতুন করে দলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সক্ষম হন। ফলে তিনি দলের প্রথম সারির নেতায় আবিভূত হন।
২০১৮ সালের ১৪ মে অনুষ্ঠিত হয় ডরুক নাইয়ামরুপ শোগপা (ডিএনটি) এর রাষ্ট্রপতির নির্বাচন। এতে তিনি ১ হাজার ১৫৫ ভোট পেয়ে দলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তখন তৃতীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওেয়ার মাত্র ৫ মাস বাকি। দলের প্রধান নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সব দলকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। হিমালয় পাদদেশে ৮০ লাখ মানুষের দেশ ভুটানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তিনি।
অতপর তিনি জাতীয় নির্বাচনে থিম্পুর আসনে ডিএনটি দল থেকে নির্বাচিত হন। এছাড়া এই নির্বাচনে তাঁর দল ডিএনটি বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। দেশটির পার্লামেন্টের ৪৭ আসনের মধ্যে ডিএনটি জয়লাভ করে ৩০টি আসনে। ফলে ডিএনটি দল থেকে প্রথম এবং দেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ খুলে যায় শেরিংয়ের জন্য। অবশেষে ৭ নভেম্বর ২০১৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন।রাজনীতিতে যোগদানের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় হিমালয়ের পাদদেশ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী হন ডা. লোটে শেরিং
শেরিং ১৯৬৮ সালে, এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি শেরুবসের পুনাখা উচ্চবিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করেন। ১৯৯০ সালে চোখেমুখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভুটান থেকে বাংলাদেশে আসেন লোটে শেরিং। প্রত্যাশা একজন সুচিকিৎসক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস ২৮তম ব্যাচে যাকে বলা হয় এম-টুয়েন্টি এইট। আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী ও কঠোর পরিশ্রমী লোটে শেরিং স্বল্প সময়েই নজর কাড়েন সবার।
সেসময় একসাথে ইরান, নেপাল, মালয়েশিয়া, ভুটান এবং আফ্রিকার আরও অনেকে ভর্তি হলেও লোটে শেরিং যেনো অন্য সবার থেকে একটু আলাদাই ছিলেন। প্রথম প্রথম বাংলাটা ভালো বলতে না পারলেও পরবর্তীতে নিজের প্রচেষ্টায় আয়ত্ত্ব করে ফেলেন বাংলা ভাষা।
ময়মনসিংহ মেডিকেলে লোটে শেরিং এর সহপাঠী ডা. মো. ইব্রাহিম খলিল। তাঁর ভাষায়, ‘প্রথম দিকে ওর একটু ভাষাগত সমস্যা ছিল। তখন অবসর সময়ে আমরা লেটেসহ অন্য দেশের যারা ছিল তাদের বাংলা শিখিয়ে দিতাম। এক পর্যায়ে লেটে এত ভালো বাংলা বলত এবং বুঝতো যে, ও যে বাংলাদেশি না এটাই বুঝতে পারত না কেউ।’
নিজের কাজ ও পড়াশুনায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন সদ্য নির্বাচিত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। মেডিকেলে পড়াকালে পুরোটা সময় জুড়েই তাকে মনোযোগী ছাত্র হিসেবেই জানতেন তার সহপাঠীরা। শুধু তাই নয়, পরীক্ষার ফলাফলেও অন্যদের থেকে তিনি ছিলেন এগিয়ে।
হাসিখুশি সদালাপি লোটে শেরিং কে ভালোবাসতেন সবাই। ভিনদেশ থেকে আসায় কখনোই নিজেকে অন্যদের থাকা আলাদা করে রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। বরং বেশিই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। প্রতিদিন বিকেলে খেলাধূলায় অংশ নিতেন। ফুটবল, ক্রিকেট, ইনডোর গেমস কোথায় নেই শেরিং! সব জায়গাতেই ছিল তার প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি। প্রিয় খেলা ছিলো টেবিল টেনিস।
বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের লক্ষ্যে ২০ বছর পর ময়মনসিংহে আসেন লোটে শেরিং। তিনি ক্যাম্পাসে তার স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন এবং তার ব্যাচমেটদের সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটান। তাকে কাছে পেয়ে সহপাঠী ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষার্থীরা আবেগাপ্লুত হন। সকালে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে ময়মনসিংহে পৌঁছালে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ডা. লোটে শেরিংকে স্বাগত জানান। এ সময় সহপাঠীদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন তিনি।