নৌকা বাংলাদেশের বহুল জনপ্রিয় একটি জলযান। নৌকা চালানোর বিষয়টা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, নৌকায় প্রায়শঃই দু’জন মাঝি থাকেন। কে কী কাজ করেন সে আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে মাঝি এবং সহকারী মাঝির মিলিত প্রচেষ্টাতেই কিন্তু নৌকা সামনে এগিয়ে যায়।
ইংরেজীতে ‘সিনক্রোনাইজ’ বলে একটা শব্দ আছে। এই শব্দটা এখানে মানাবে।
এবার ভাবুন নৌকায় একজন দক্ষ মাঝি আছে। কিন্তু সহকারী মাঝি যিনি আছেন তিনি সিনক্রোনাইজ করতে পারছেন না। অর্থাৎ এমন ভাবে নৌকা তিনি বাইছেন তাতে প্রথম মাঝির উপকার তো হচ্ছেই না। বরং প্রথম মাঝির পরিশ্রমটুকুই সার হচ্ছে। ফলে নৌকা সামনে না এগিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে পাক খেতে শুরু করেছে।
অপ্রাসঙ্গিক গল্প বললাম কী?
আমাদের হেলথ সিস্টেমে মেডিকেল টেকনোলজি একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ এর দিকে আমাদের দৃষ্টি ‘সীমাহীন উদাসীনতা’ লেভেলের। তাই আজো এই বিষয়ে অন্যান্য খাতের থেকে দক্ষ জনশক্তি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
ডাক্তার এর অভাব নাই এই দেশে। ঢাকা মেডিকেল গেলেও ডাক্তার পাবেন আপনি। প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারে কয়েক ধরনের ঔষধ নিয়ে দোকান দিয়ে বসা ডাক্তারও পাবেন আপনি।
ডাক্তারদের মধ্যে আবার ছোট বড় আছে। দোকানদার শ্রেণীর ডাক্তাররা পল্লীচিকিৎসকদের ডাক্তারই মনে করেন না। আবার কবিরাজরা এমবিবিএসদের ডাক্তার মনে করেন না। অন্যদিকে জনগণ আবার এফসিপিএস এমএস ছাড়া ডাক্তারদের আদর করে সিম্পল এমবিবিএস বলে ডাকেন।
যাই হোক এই উপাখ্যান আজ থাকুক। অবলা এমবিবিএসধারীরা বাদে যে যার ব্যবসার প্রতিযোগিতায় নামুক, সবার জন্য শুভকামনা।
মেডিকেল টেকনোলজি বিষয়টি প্রথম থেকেই অবহেলিত কেন ছিলো আমার জানা নাই। মেডিকেল টেকনোলজিতে চালু আছে বিএসসি গ্রাজুয়েশন ও ৪ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স। সাধারণতঃ এই ডিপ্লোমা করা মানুষগুলোই সরকারী হাসপাতালগুলোতে নিয়োগ পান।
সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য নির্ভুল পরীক্ষা নিরীক্ষার গুরু দায়িত্বটি থাকে এই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দের উপর। পৃথিবী আজ স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে বহুদূর। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে ক্রমশঃ সমৃদ্ধ ও উন্নত করা হচ্ছে। কারন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া আজ জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার।
কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজি আজো “যেই তিমিরে, সেই তিমিরে”।
সেই পুরোনো কারিকুলাম ও গদবাঁধা ভর্তি নীতিমালার (বা নীতিহীনতার) জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার প্রথম ধাপেই আমরা হোচট খাচ্ছি। জেনে রাখুন যে, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও ফার্মাসিস্ট হবার জন্য প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশী শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে ।
আরো একটা বিষয় ‘শুভঙ্কর’ বাবুর ‘ফাঁকি’র খাতায় লেখা ছিলো, অথচ আমাদের জানা ছিলো না। সেটি হলো দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তার, নার্স ও সুইপার ছাড়া অন্য কোনো স্বাস্থ্য জনবল নিয়োগ দানের বাধ্যবাধকতা নেই। ফলাফল, প্রায় ২২ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এখনো আনএমপ্লয়েড।
এখন তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা বললে হেসেই মরে যেতে হবে। তারা বলছেন, একটি সুষম ও কার্যকরী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে মাত্র ৫ জন।
তাকান এবার আপনার আশে পাশের হাসপাতালগুলোতে। ডায়াগনস্টিক সার্ভিস কেবল একটি প্রহসন হয়ে যেন থেকে না যায়। সরকারী হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা হিম শিম খাচ্ছেন রোগীর চাপে। আর বেসরকারীতে কাদের কোন যোগ্যতায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে সেসব নিয়ে ভাবার সময় এখনো হয়তো আসে নি, নাকি?
সরকারীতে একদিকে যেমন পদস্বল্পতা, অন্যদিকে পদে পদে জনবল স্বল্পতা। বলতে গেলে ‘কানা মামা’কে দিয়েই চলছে উপজেলা থেকে মেডিকেল কলেজ।
বেসরকারীতে ব্যবসাটা হয়তো হচ্ছে। কিন্তু কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স বা ইভালুয়েশন মনিটরিং গুলো এখনো কৌতুক পর্যায়েই রয়ে গেছে।
প্রতিনিয়ত নানা রোগ নিয়ে, সংক্রমণ নিয়ে, প্রাদুর্ভাব নিয়ে, রোগের বৈশ্বিক ইভোলিউশন নিয়ে আমরা সভা-সেমিনার করছি। কতোটুকু অংশগ্রহণ আছে এখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের? তাদের জন্য সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা না করলে চিকিৎসককে যতোই গ্রামে পাঠানো হোক না কেন স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন স্থবির হয়ে যাবে এক সময়।
ঐ যে, মাঝি নৌকা ঠিকই চালাবেন। কিন্তু বুঝতে পারবেন না নৌকা সামনে না গিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়েই পাক খাচ্ছে কেন। নৌকাকে এগিয়ে নিতে হলে নৌকার সকলকে নৌকার মেকানিজমকে ধারণ করতে হবে।
নৌকায় যারা থাকবেন, নৌকার দায়িত্ব তাদের সবার হাতেই।
এক মাঝিকে দোষ দিয়ে পার পাওয়া যাবে না আর।
লিখেছেন:
ডা. রাজীব দে সরকার
বড় কোন দেশে না গিয়ে ভিয়েতনাম গিয়ে শিখে আসা যায়।