জিপি’র খুঁটিনাটিঃ
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট গ্রাজুয়েশন মেডিকেল ইনস্টিটিউট আইপিজিএমআর এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক জাতীয় অধ্যাপক ডা.নুরুল ইসলাম স্যার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “The family physicians provide care in the community for people and their families of all ages regardless of their sex & income.” ইউএসএ এবং কানাডাতে যে চিকিৎসক সম্প্রদায়কে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বলা হয় তাদেরকে ইউকে, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে বলা হয় জেনারেল প্র্যাকটিশনার বা জিপি।
কারা জিপি করবেন?
বাংলাদেশ বিএমডিসি রেজিস্টার্ড ৯৫,০০০এর অধিক চিকিৎসকের মধ্যে প্রায় ৩,০০০ চিকিৎসক মারা গিয়েছেন, প্রায় ২,০০০ চিকিৎসক কর্মসূত্রে প্রবাসী, প্রায় ১০,০০০ চিকিৎসক বিভিন্ন কোর্সে অধ্যায়নরত আছেন এবং প্রায় ১২,০০০ চিকিৎসক পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আমরা সেকেন্ডারি/টারশিয়ারি কেয়ার ফিজিশিয়ান বলতে পারি। বাকি যে ৬৮,০০০ চিকিৎসক আছেন তাদেরকে আমরা বলতে পারি প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান বা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা জেনারেল প্রাকটিশনার সংক্ষেপে জিপি। ছোট বোন ডা.Tania Hafiz এর মতে, “এই ৬৮০০০ ডাক্তারের উচিৎ পড়াশোনা+জব এর পাশাপাশি জিপি করা। একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান অবশ্যই পারেন একজন ফ্যামিলি মেম্বার হতে। আমাদের দেশের রোগীরা শুধু যে মেডিসিন /ইএনটি/চোখের সমস্যার জন্য মাসের পর মাস সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকছেন প্রফেসর স্যারদের দেখাবেন শুধু তাইইই নয়, তারা আবার কোয়াকদের কাছেও যাচ্ছেন। এই কোয়াকরা যে কিসব উদ্ভট চিকিৎসা করে, কি যে ল্যাবটেস্ট দিচ্ছে যার সাথে রোগের কোনো মিলই নাই। রোগীও তাদেরকে হাতের কাছে পাচ্ছেন আর একটুতেই দৌড় দিচ্ছেন তাদের কাছে। কারন আমাদের মতো জেনারেল ফিজিশিয়ান পাচ্ছেন না তাই। আমরা সবাই প্রতিযোগীতায় নেমেছি যে ডিগ্রি করবো। তাই এম.বি.বি.এস পাশের পরই কোচিং শুরু করছি। আমি সবাইকে বলবো অবশ্যই আমরা ডিগ্রি করবো কিন্তুু পড়াশোনা /চাকুরির পাশাপাশি অন্তত একটা নির্দিস্ট সময় আমরা জিপি করতেই পারি। তাহলে অন্তত আমাদের দেশের রোগীরা কোয়াকদের থেকে ভুল চিকিৎসা পাবেন না”
১.যারা সদ্য ইন্টার্নশিপ শেষ করে বিএমডিসি পার্মানেন্ট রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন ২.যারা এফসিপিএস পার্ট 1 বার রেসিডেন্সি জন্য পড়াশোনা করছেন ৩.যারা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আরএমও হিসেবে কাজ করছেন ৪.যারা সপ্তাহান্তে পেরিফেরীতে খ্যাপে যান
৫.যারা বিসিএস পোস্টেড কিন্তু এখনো পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেননি
৬.যারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ও প্যারা ক্লিনিক্যাল বিষয়ে শিক্ষকতা করছেন
৭.যেসব চিকিৎসকবৃন্দ সরকারি ও বেসরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন
কোথায় জিপি করবেন?
১.বেসরকারী হাসপাতাল
২.ক্লিনিক
৩.ডায়াগনস্টিক সেন্টার
৪.বড় ফার্মেসি
৫.বাজারে বা নিজের বাসার নিচে চেম্বার তৈরি করে
কিভাবে জিপি জমাবেন?৷
১.ধারাবাহিকতা জিপি দের পসার জমানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক কিংবা আপনার শরীর খারাপ থাকুক আপনি নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্যই চেম্বারে থাকবেন। কারণ, বেশিরভাগ রোগী চায় চেম্বারে এসে চিকিৎসককে উপস্থিত পাবে। স্বভাবতই অনুপস্থিত থাকলে রোগী বিকল্প চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
২.জিপি শুরু প্রথম এক বছর অবশ্যই এবং সম্ভব হলে তার পরেও রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদান করুন। *Treating with empathy* অর্থাৎ সহানুভুতির সাথে চিকিৎসা। আমাদের চিকিৎসকদের সাথে পার্শ্ববর্তী দেশের চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবার একটি মূল পার্থক্য হল রোগীকে সহানুভূতি দেখানোতে। আমরা ভুলে যাই কোন রোগীকে সহানুভুতির সাথে চিকিৎসা করলে সেই রোগী নতুন আরও অনেক রোগী নিয়ে আসতে পারে।
৩.প্রত্যেক রোগীকে প্রয়োজন অনুসারে ১/৩/৫/৭ দিন পর ফলোআপে আসতে বলা।
৪.আমরা যেই রোগীগুলো স্পেশালিস্ট ডাক্তারদের কাছে পাঠালে আমাদের থেকে ভালো চিকিৎসা পাবে, অবশ্যই তাদের রেফার করা উচিত। সঠিক রেফারে আপনার রোগী কমবে না বরং রোগী বাড়বে।আমি আন্তরিকভাবে চাই আমাদের দেশে জেনারেল প্রাক্টিশনারদের মেডিকেল নলেজ আপগ্রেড হোক যেন প্রত্যেকের রোগী উন্নত সেবা পায় এবং আমরা যেন রেফারেল সিস্টেম চালু করি। কে আমাকে রোগী রেফার করলো তা দেখার কোনো প্রয়োজন নাই, কিন্তু প্রপার রেফারেল এর অভাবে যেন কোনো রোগীর ভোগান্তি না হয় তা দেখা আমাদের দায়িত্ব। সঠিকভাবে জিপি করতে চাইলে প্রপার রেফারেল এর বিকল্প নেই।
৫.যেহেতু জিপির শুরুতেই আপনার চেম্বারে রোগীর ভিড় থাকবে না তাই এই সময় আপনি পড়াশোনা করতে পারেন, যা আপনার চেম্বার প্র্যাকটিসে সহায়তা করবে।
জিপিতে প্রতি রোগীকে কতক্ষণ সময় দিবেন?
নতুন রোগীর ক্ষেত্রে ২০ মিনিট:
ক.কুশল বিনিময় ১ মিনিট
খ.রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধকরণ ৩ মিনিট:
-নাম
-বয়স
-বর্তমান ঠিকানা
-স্থায়ী জেলা
-পেশা
-বৈবাহিক অবস্থা
গ. রোগীর শারীরিক সমস্যার কথা শোনা ৫ মিনিট:
আমাদের দেশের রোগীরা অভিযোগ করেন যে আমরা চিকিৎসকরা মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনি না। আপনি রোগীকে বলতে দিন রোগী আপনাকে দেখানোর কথা অন্য রোগীকে এই বলে বলবে যে এই চিকিৎসকের কাছে সব সমস্যার কথা বলতে পেরেছি তুমিও যাও।
ঘ. ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন ৪ মিনিট:
প্রাপ্তবয়স্ক রোগী হলে অবশ্যই বিপি মাপবেন এবং সকল রোগীকে অস্কাল্টেট করবেন। জেনারেল এক্সামিনেশন এরমধ্যে রক্তশূন্যতা দেখা, নাকের ছিদ্র, জিহ্বা ইত্যাদি পরীক্ষা করতে ভুলবেন না।
ঙ. প্রেস্ক্রিপশন রাইটিং ৪ মিনিট:
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ফলো করলে দেখবেন তারা প্রথম সাক্ষাতে ইনভেস্টিগেশনস দেন এবং পরবর্তী সাক্ষাতের ঔষধ লেখেন। যেহেতু আপনি জিপি করছেন তাই প্রথম সাক্ষাতেই ওষুধ লিখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ইনভেস্টিগেশন দিবেন।
প্রেসক্রিপশন সফটওয়্যার ব্যবহার না করলে ওষুধের নাম অবশ্যই ক্যাপিটাল লেটার লিখবেন। এর ফলে আপনার হাতের লেখা যতই খারাপ হোক না কেন কারো বুঝতে সমস্যা হবে না।
চ. প্রেসক্রিপশন বোঝানো ৩ মিনিট:
কোন ঔষধ এবং পরীক্ষা রোগীকে কেন দিয়েছেন সংক্ষেপে বুঝিয়ে বলবেন।
একইভাবে প্রতি পুরাতন রোগীর ক্ষেত্রে ১৫ মিনিট পর্যন্ত সময় দিতে পারবেন।
উপসংহার :
জিপিরা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার মেরুদন্ড। যদি মেরুদন্ড ঠিক না থাকে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব না, চলতে পারব না। ঠিক একইভাবে এই জিপিরা যদি ক্লিনিক্যালি সাউন্ড না থাকেন তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সঠিক ভাবে চলতে পারবে না।
Written by:
Dr. M Razibul Islam Razon
General practitioner and Medical educator
Session : 1997-98 (BM-12)
Bangladesh Medical College
স্টাফ রিপোর্টার / নাফিসা ইসলাম