২৮ এপ্রিল, ২০২০, মঙ্গলবার
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস টেস্ট কী করতে পারে, কী পারে না? এটার কী কোন উপযোগিতা আছে কি নেই? এই উদ্ভাবনের নৈতিক বা এথিকাল দিকটি সঠিক ছিল? রাজনৈতিক দিক? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
কোভিড-১৯ এর যে কয়টি টেস্ট আছে, সেগুলোকে মোটাদাগে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা চলে:
১) মলিকিউলার টেস্ট: এগুলো নাক অথবা গলার কাছ থেকে স্পেসিমেন নিয়ে আরটি-পিসিআর মেশিনে পরীক্ষা করা হয়। এগুলোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ধরা হলেও, এগুলো যে ১০০% সঠিক ফলাফল দিতে পারবে, তার নিশ্চয়তা নেই (ভুল ফলাফল কেন আসতে পারে তা টেকনিকাল আলোচনা, এখানে সেটা করছিনা)।
Roche Cobas, Thermo Fisher Scientific এসব কোম্পানির মেশিনগুলো বহুল ব্যবহৃত, তবে বাংলাদেশে কি ব্যবহার হচ্ছে তা জানিনা।
২) র্যাপিড পয়েন্ট অফ কেয়ার টেস্টিং: এগুলোও এক ধরণের মলিকিউলার টেস্টিং। যা অতি অল্প সময়ে (১৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা) সম্পন্ন করা যায়। বাংলাদেশে যক্ষ্মা নির্ণয়ে যে জনপ্রিয় GeneXpert মেশিনগুলো ব্যবহার করা হয়, তা এই টেকনোলজি ব্যবহার করে। বাংলাদেশে কয়েকটি এনজিওর (ব্র্যাক অন্যতম) কাছে এ মেশিনগুলো আছে এবং তা কোভিড-১৯ নির্ণয়ে কাজে লাগানো যেতে পারে।
এছাড়া Abbott নামের আরেকটি সিমিলার টেকনোলজির মেশিন আছে যেগুলো আরো কম সময়ে ফলাফল দিতে পারে। তবে দাম বেশি, আর এক সাথে অনেক টেস্ট এগুলো সাপোর্ট করেনা।
৩) এ্যান্টিবডি টেস্ট: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এই ধরণেরই একটা উন্নত ও র্যাপিড টেস্ট উদ্ভাবন করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের টেস্টের ছবি দেখে বুঝলাম এটা ডট ব্লট পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব অল্প সময়ে সামান্য রক্ত নিয়ে বর্তমান সংক্রমণ (Ig-M) ও অতীত সংক্রমণ (Ig-G) সনাক্ত করতে পারে। বলে রাখা ভালো, এটা কোন নতুন আবিষ্কার নয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ছাড়াও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এমন টেস্ট প্রস্তুত ও ব্যবহার করছে।
সব টেস্টের মতোই এই টেস্টেরও কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা আছে। সংক্ষেপে সুবিধাগুলো হলো, দ্রুততার সাথে ফলাফল, সহজে পরীক্ষাযোগ্য (অনেকটা প্রেগনেন্সি টেস্টের যে স্বব্যবহারযোগ্য টেস্টকিট রয়েছে তার মতো), কম খরচ (২০০-৩০০ টাকা, যতদুর শুনেছি), দেশে উৎপন্ন হওয়ায় সহজলভ্য ইত্যাদি। তাছাড়া এগুলোর ডিটেকশন রেটও বেশ ভালো, তবে পরীক্ষা না করে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবেনা। এটার জন্য পিসিআর বা জিনেক্সপার্টের মতো ব্যয়বহুল কোন যন্ত্রেরও প্রয়োজন নেই। স্টোরেজের জন্য আলাদা রিফ্রিজারেশনেরও দরকার হয়না; রুম টেম্পারেচারেই প্রিজার্ভ করা যাওয়ার কথা।
অসুবিধার দিক হলো, যেহেতু টেস্টটি এ্যান্টিবডির উপর নির্ভরশীল, আর এ্যান্টিবডি কোভিড-১৯ সংক্রমণের সাথে সাথেই উৎপন্ন হয় না, তাই কেউ অতিসম্প্রতি সংক্রমিত হয়ে থাকলে, এই টেস্ট তাদেরকে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হবে। তবে কারো মধ্যে সিম্পটম দেখা দিলে, তা প্রথম ৭ দিনের মধ্যেই Ig-M সনাক্ত করতে পারার কথা (আমি যেহেতু স্পেসিফিকালি গণস্বাস্থ্যের টেস্টটি সম্পর্কে জানিনা, তাই সাধারণ ডট ব্লট পদ্ধতির টেস্টগুলো সম্পর্কে বলছি)। অতিরিক্ত বা উপরি পাওনা হলো, কেউ অতীতে সংক্রমিত হয়ে থাকলে সেরোসার্ভেইলেন্স স্টাডিতেও এগুলো ব্যবহার করা যাবে।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর উপযোগিতা আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমি মনে করি উপযোগিতা বেশ ভালোরকমই আছে। নির্ভর করছে আপনি এই টেস্টকে কিসের জন্য বা কি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করছেন তার উপর (গণস্বাস্থ্যের সাথে সরকারের আলোচনা হওয়া উচিত ছিল এটা নিয়েই)। এই মুহূর্তে কারো কোভিড-১৯ আছে কিনা তা জানার জন্য আরটি-পিসিআর অথবা মলিকিউলার র্যাপিড পয়েন্ট অফ কেয়ার টেস্টিং সবচেয়ে উপযোগী, এতে কোন সন্দেহ বা প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু গণস্বাস্থ্যের টেস্টকিট দিয়ে বোঝা যাবে:
১) একটা জনগোষ্ঠীতে কী পরিমাণ মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল (এটা জানতে অনেকের অস্বস্তি থাকতে পারে যদিও)
২) কারা ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবার দরুন এখন তাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম। এটা জানলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সময় এদের মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দিয়ে কমিউনিটিতে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়া যেতে পারে।
৩) ভ্যাক্সিন তৈরি হয়ে গেলে, এই টেস্টটি অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে দেখা দিবে। কারণ, তখন আমরা চাইব যাদের শরীরে Ig-G নেই তাদেরকে ভ্যাক্সিনেট করতে। এ কাজটি এখন পর্যন্ত গণস্বাস্থ্যের টেস্টকিটই করতে সক্ষম।
৪) বর্তমানে কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য চিকিৎসা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই প্লাজমা কার শরীরে বেশি মাত্রায় আছে তা নির্ণয় করতে এ্যান্টিবডি টেস্টের জুড়ি নেই।
৫) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বর্তমানে আমাদের দেশের গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন কলকারখানার মালিকরা শ্রমিকদের কাজ শুরু করতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে। সরকার যদি এক পর্যায়ে ধাপে ধাপে কারখানা খোলার অনুমতি দেয়, গণস্বাস্থ্যের এই টেস্ট তখন মালিকপক্ষের এমনকি সরকারের খুব কাজে লাগবে। কারখানার মালিকরা তাদের কর্মীদের উপর স্বল্পমূল্যের এই টেস্টটি করে দেখতে পারে কারো মধ্যে অলরেডি আইজি-জি তৈরি হয়েছে কিনা। তাদেরকে কারখানায় কাজ করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, যেহেতু তাদের মধ্যে এক ধরণের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে আছে (যদিও কোভিড-১৯ এর ইমিউনোলজিকাল প্রোপার্টি এখনো ওয়েল এসটাবলিশড না; তাই সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে)। বাকিদেরকে এক থেকে দুই সপ্তাহ (এ্যাকচুয়ালি দুই সপ্তাহ, তবে মিডিয়ান ইনকিউবেশন পিরিয়ডের ভিত্তিতে অন্তত এক সপ্তাহ) কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করে এরপর আস্তে আস্তে কাজে নিয়োগ করা যেতে পারে। কাজেই বাংলাদেশের কারখানা মালিকদের জন্য গণস্বাস্থ্যের এই টেস্ট আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
এই টেস্ট ডেভেলপ করার জন্য গণস্বাস্থ্য প্রপার এথিকাল স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেছিল কিনা, এমন প্রশ্ন কেউ কেউ তুলেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন প্রশ্ন বাস্তববিবর্জিত ও বালখিল্যতার পরিচয়জ্ঞাপক। যেখানে গোটা বিশ্ব কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য ওষুধ ও ভ্যাক্সিনের এনিমেল টেস্ট ওয়েভার করে, বিভিন্ন ফেইজের ট্রায়ালের সময় সংক্ষিপ্ত করে, ন্যাশনাল ড্রাগ অথোরিটির ফাস্টট্র্যাক রিভিউ অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের অথোরিটি এথিকাল রিভিউ কতদিনে কিভাবে করবে তা বলাই বাহুল্য। যেখানে কয়েকটা কোয়ালিটেটিভ ইন্টারভিউয়ের এ্যাপ্রুভাল পেতে ৬ মাস পার হয়ে যায়, সেখানে একটা বায়োমেডিকেল টেস্টের এথিকাল এ্যাপ্রুভাল পেতে তো কয়েক বছর পার হয়ে যাবার কথা। তার মধ্যে সরকারের রাজনীতির দিকটা যারা ইগনোর করে যেতে চাচ্ছেন, তারা হয় বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন, নয়তো জেগে জেগে ঘুমাচ্ছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাই তাদের টেস্টকিট উদ্ভাবন করে এর হিউম্যান টেস্টিংয়ের দায়ভার সরকারের উপর দিয়ে যথার্থই করেছেন; এতে হিউম্যান সাবজেক্ট রিসার্চ এথিক্স ভায়োলেশনের দায়ভার থেকে তারা বেঁচে যাচ্ছেন। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই টেস্ট কখন কিভাবে জাতির কাজে লাগানো যেতে পারে তা নিয়ে তারা আলোচনা করতে পারতেন। তা না করে সরকার টেস্টটি পরীক্ষার জন্য গ্রহণই করলেন না–এখানে রাজনীতিটা কে করলো, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, নাকি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল? আর ক্ষতিটা কার হলো? বাংলাদেশের জনগণেরই তো?
Dr. Kawser Uddin
Assistant Registrar(Medicine)
Courtesy: Dr. Taufique Joarder
Associate Prof, Dept of Public Health, NSU
Associate faculty, John Hopkins Bloomberg School of Public Health