বেলা শেষে
ভাবতেই আমার অবাক লাগছে ,আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি মিতাকে বিয়ে করেছিলাম
একসাথে প্রায় দুই যুগ ,চিন্তা করছি , কি করলাম আমরা এই সময়ে ?
সেই সময় আমি মাত্র ডাক্তারি পাশ করে একটা ক্লিনিকে বার হাজার টাকার চাকরি করতাম আর মিতা তখনও খুলনা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি করতো .মিতার ইন্টার্নির বেতন পাঁচ হাজার .
আমাদের সতের হাজার টাকার সংসার .
আমার মা -বাবা থাকতেন বগুড়া আর মিতাদের বাড়ি টাঙ্গাইল .
মিতার বাবা -মা আমাদের বিয়েতে কিছু ফার্নিচার দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি নিতে রাজি হইনি ,আমি মিতাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি ,মিতাকে আমি ভালোবাসি .এই ভালোবাসার সাথে টি ভি, ফ্রিজ আর ফার্নিচার কেন ?আমি স্পষ্ট করে বলেছি এসব আমাদের দিতে হবে না .
শুধু দুজনের জন্য খুলনাতে আমরা একটা ছোট বাসা ভাড়া নিলাম .মিতা কম করে হলেও বিশ-পঁচিশটা বাসা দেখেছে ,আজব ব্যাপার হলো বাসার ভেতরটার প্রতি ওর আগ্রহ কম ,সে দেখে বাসার ছাদ ,মনে হতো আমরা যেন বাসার ছাদে থাকবো ,কিন্তু ওর একটাই কথা ,যে বাসাতেই থাকবো ছাদ সুন্দর হতে হবে ,আমি চাইনা কোন একটা পূর্ণিমা চাঁদ চলে যাক আর আমরা ছাদে বসে গল্প করিনি .
সেই কথা আমি এখন মনে করে খুব হাসছি ,কারন ,
প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে আমরা দুজন একসাথে ছাদে যাওয়ার সময় পাইনি ,আর আকাশে পূর্ণিমা হয় জানি কিন্তু সেই আলো আমাদের দেখার আর কোন সময় নেই .
আমি মিতাকে বিয়ে করে যখন খুলনার সেই বাসাতে উঠলাম তখন আমাদের কোন খাট ছিলো না ,বিশ্বাস করুন সত্যিই কোন খাট ছিলোনা .
মিতা আমাকে জিজ্ঞেস করলো
-শামীম ,একটা খাট কিনলে ভালো হত না ?
আমি একটু লাজুক সুরে বললাম ,আসলে তোষোকটা এতো উঁচু আর ভারী ভাবলাম খাট ভেঙে পড়ে যায় কিনা ?
মিতা হাসলো ,আসলে আমার বউ সব জানে ,বিয়েতে বন্ধু দের কাছ থেকে অনেক টাকা লোন এই সময়ে খাট কিনে বিলাসিতা করার কোন উপায় আছে .শুরু হলো আমাদের জীবন যুদ্ধ ,সকাল বিকেল ডিউটি ,লোন শোধ করা ,বিয়ের চার মাস পর দুজন মিলে,সেকেন্ড হ্যান্ড ফার্নিচার শপ থেকে শীপে ব্যবহৃত একটা খাট কিনে এনেছিলাম ,আমাদের সে কি আনন্দ অবশেষে আমাদের খাট হলো ,একমাসে টিভি কিনি তো পরের মাসে আবার ফ্রিজের কিস্তি ,আমরা দুজন যা আয় করি তা থেকে আবার দুই সংসারেই কিছু কিছু দিতে হয় .
আমরা বিশ্বাস করতাম ,বাবা -মা এতটা কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন তাদের একটু ভালোর জন্য ,সুখের জন্য অবশ্যই সহোযোগিতা করতে হবে .
নাহ ,আমাদের এই টানপোড়ণের সংসারে কোন দুঃখ ছিলো না ,রাত জেগে উত্তম -সুচিত্রার সিনেমা দেখা ,বিছানায় শুয়ে শুয়ে একই গল্পের বই দুজন মিলে পড়া ,সময় পেলেই বিকেল বেলা পার্কে কিংবা নদীর তীরে বেড়াতে যাওয়া আরো কত কি .
বউকে আমি বলতাম ,নটরডেম কলেজের আমাদের বাংলার মোখতার স্যার বলতেন, “ভালোবাসার প্রমান হলো সন্তান”,
সুতরাং আমি চাই, আমার অনেক সন্তান হবে ,আমি সবকয়টা নিয়ে একদিন পৃথিবী ভ্রমণে বের হবো ,মিতাও দুষ্টমি করে জিজ্ঞেস করতো ,
-নো প্রবলেম ,কয়টা চাই তোমার ? বলো
-কম করে হলেও দুই হালি ,সাত মেয়ে আর এক ছেলে
-সাত মেয়ে ! এতো মেয়ের নাম কোথায় পাবেন স্যার ?
-নদীর নামে নাম ,পদ্মা ,মেঘনা ,যমুনা ,সুরমা ,কুশিয়ারা ,চিত্রা …
এমন কি বুড়িগঙ্গা নাম হলেও আমার কোন আপত্তি নেই .
মিতা খুব হাসতো ,বলতো এতো মেয়ে নদীর মাঝে আবার একটা ছেলে ,ওর নাম কি হবে ?
-সব নদীর নাম .ছেলের নাম হবে “গাবখান”, মানুষ সব সময় শুনেছে ,”সাত ভাই চম্পা” এই বার শুনবে
“সাত বোন গাবখান”
সেই আমার প্রথমেই ছেলে হলো ,বউ হেসে বলেছিলো ,এই নাও আপাততঃ তোমার গাবখান .
আমি ছেলেকে কোলে তুলে ,কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম ,
-কি রে তোর বোনদের খবর কি ?
পরবর্তীতে আমার আর কোন নদী দেখা হয়নি ,সত্যি কথা বলতে কি আমাদের আসলে আর কোন সময় হয়নি ,এই বছর না সেই বছর করে দিন চলে গিয়েছে .মিতা আর আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশন ,ট্রেনিং ,বি সি এস ,এফ সি পি এস করে কোন ফাঁকে সব সময় চলে গিয়েছে টের পাইনি .
শুভ্র ,আমাদের একমাত্র ছেলে .আমাদের একমাত্র সন্তান .আমার আর ভালোবাসার প্রমান দেয়া হয়নি কিংবা হয়ে উঠেনি .
আমরা হয়তো সফল , আমি সার্জারিতে এফ সি পি এস করেছি আর আমার বউ গাইনীতে এফ সি পি এস এবং এম এস করেছে ,এই দীর্ঘ পথে আমাদের জীবনের অনেক নদী ই শুকিয়ে গেছে .এই পথ যে পাড়ি দিয়েছেন কেবলমাত্র সেই জানেন কতটা কষ্টের .কতটা দীর্ঘ এই পথ .
ঢাকার উত্তরায় আমাদের এই তিন হাজার বর্গ ফুটের ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে আমি ভাবছিলাম সেই দিনগুলির কথা ,আহা একসময় কত গল্প করতাম ,খুব হিসেব করে চলতে হতো ,পাঙ্গাস মাছ ছিলো সবচেয়ে কম দামি মাছ ,প্রায়ই সেই একই মাছ কিনতে হতো আমাকে কিন্তু খাওয়ার টেবিলে এতো এতো মজার গল্প করতাম ,পাঙ্গাস মাছটাই বোয়ালের মত স্বাধ লাগতো .
এখন আর তেমন গল্প হয় না ,সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে আমরা যখন বিছানায় যাই ,কথা বলার জন্য মাত্র দশ মিনিট সময় থাকে ,প্রতিদিন প্রায় একই কথা, হয় রোগ না হয় রোগী.
আমি মিতাকে জিজ্ঞেস করি ,
-কি অবস্থা তোমার ?
-এইতো দুই টা সিজার ছিল -একটা ইলেক্টিভ ,তিনটা ডি এন্ড সি .একটা হিস্টেরেক্টমি কালকের জন্য বুকিং দিয়েছি ,তোমার কি খবর ?
-এই কালকের মতই ,খুব বেশি একটা ব্যস্ত ছিলাম না ,মাত্র দুইটা হার্ণিয়া আর একটা এপেন্ডিক্স করেছি .বড় কেস খুব একটা এই সপ্তায় নেই .
এতটুকু বলার পর হুমম …বলে মিতা ঘুমিয়ে যায় ,আমি আর ডিসটার্ব করিনা ,প্রায় রাতে তো ঘুমাতে পারেনা ,জরুরি কল থাকে অথবা রোগী খারাপ থাকে ,ওর ঘুম দরকার ,বিশ্রাম দরকার
এই ভাবেই আমাদের এখন রাতের পর রাত কেটে যায় .
আজ আমার মনটা খুব খারাপ .এই কারণেই হয়তো এত সব মনে পড়ছে ,মনটা কেমন বিক্ষিপ্ত ভাবে পিছনে ফিরে যেতে চাইছে .
কারন হলো ,একটা রোগী .
সন্ধ্যার পর একটা ল্যাপারোস্কোপিক গল ব্লাডার করতেছিলাম ,ক্লিন- কাট অপারেশন কিন্তু হঠাৎ করে রোগীটা খারাপ হয়ে যায় ,মনে হয় হার্ট এটাক করেছিল ,সব মিলে আমরা চারজন ডাক্তার সেখানে কিন্তু না ,বাঁচাতে পারিনি .মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সী লোকটা চোখের সামনে মরে গেলো .
রোগীর লোকজন মেনে নিতে চায়নি ,কেন তারা মেনে নিবে ?আমার ভাই হলে আমিও কি মেনে নিতাম ?
মানুষতো আর জানে না যে, সঙ্গম রত অবস্থায়ও মানুষের হার্ট এটাক হতে পারে ,আর অপেরেশন টেবিলতো আরও বড় রিস্ক .
যদিও আমার কোন অপরাধ নেই তবুও আজ ক্লিনিক থেকে আমি মাথা নীচু করে বের হয়ে এসেছি .
বিশ বছর পর এই প্রথম আমি মাথা নীচু করলাম .
আমার স্কুল বন্ধু সেলিম বলে ,তোকে আর আমরা পাইনা ,নাজমুল ,রফিক আর হিমাংশু মিলে কুয়াকাটা গেলাম তোর কোন খবর নেই ,নাজমুলের মেয়ের বার্থ ডে তে আসলি না ,আমাদের মেরেজ এনিভার্সারিতে তোর অপেক্ষা করেছি .বুঝলাম অনেক ব্যস্ত ডাক্তার কিন্তু বন্ধু এইসব আবেগ অনুভূতি ভুলে গেলে থাকবি কি করে ?
আসলে তোর জীবন বন্ধি ,মানুষের কাছে বন্ধি .
আজ বার বার সেলিমের সেদিনের কথা টাই কানে বাজছে ,
“তোর জীবন বন্ধি ,মানুষের কাছে বন্ধি ”
এই যে এখন আমি খোলা বারান্দায় বসে অন্ধকারে আকাশ দেখছি ,কি সুন্দর আকাশ ,সেখানে কত তারা ,আজ আমি জানলাম আসলে পূর্ণিমা রাতের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে নেই ,আমাদের রোজ একবার আকাশের দিকে তাকানো উচিত ,বিশাল আকাশ আমাদের দূর দৃষ্টি বাড়ায় .
মানুষের দূরদৃষ্টি বড় বেশি প্রয়োজন .
লেখক:
ডাঃ শামছুল আলম ,
সি ও মে ক /১৯৯৬-৯৭
প্ল্যাটফর্ম ফিচার রাইটার:
সুমিত সাহা
গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজ
সেশন:২০১৪-১৫