মিতু হত্যার সমাধান এবং ফরেনসিক স্টাডি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা

লিখেছেন ঃ অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম, বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিনইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ।

আজকাল ইন্টারনেটের বদৌলতে বিদেশে বসেও মুহূর্তের ভিতর আমরা দেশের খবর জানতে পারি। সেই খবর কখনও আনন্দের, কখনও বিস্বাদের আবার কখনও শিহরন জাগানিয়া। সম্প্রতি চট্টগ্রামে মিতু নামে পুলিশের এক কর্মকর্তার স্ত্রীকে যেভাবে নিজ সন্তানের সামনে নিসংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তা সকল হত্যাকাণ্ডকে হার মানিয়েছে। কাপুরুসিত এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই, তাছাড়া নিন্দা জানাতে আজ আমি কলম ধরি নি। আমি ভীত, সন্ত্রস্থ অবস্থায় নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি চাইতে এই কলম ধরেছি।

মিতু হত্যা নিয়ে বিভিন্ন সংবাইপত্রে প্রকাশিত একাধিক সংবাদ এবং প্রকাশিত সংবাদের সমালোচনামূলক সংবাদ আমি পড়েছি। প্রতিটি লেখায় লেখকরা সরকারের কাছে হত্যাকারীকে ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের চাক্ষুস সাত খুন প্রমাণ করতে যেখানে প্রসিকিউশন হিমসিম খাচ্ছে সেখানে অনুমানে নির্ভর করে পলাতক আসামী সনাক্ত আর আইনের আওতায় নিয়ে আসা কতটা সম্ভব তা এ পেশায় জড়িতরা ভাল করেই জানেন। ইতিমধ্যেই খবর বেড়িয়েছে, ঘটনার কুল কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। বিড়ালের গলায় ঘন্টা কিভাবে বাধা হবে জরুরী হলেও সে ব্যাপারে কোন লেখাতেই কেউ কোন আলোকপাত করেন নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই মিতু খুনে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেছেন। অতীতে তিনি সাগর রুনী এবং ইলিয়াস আলীর পরিবারকেও এমন আশ্বাস দিয়েছিলেন কিন্তু আজ অবধি তার সেই আশ্বাসকে বাস্তবতায় রূপ দেয়া যায় নি। অনেকেই এর মাঝে সদিচ্ছার অভাব খুঁজে পান। তবে সর্বচ্চ পর্যায়ের আশ্বাসের পরও কেন তা আলোর মুখ দেখল না সেটি জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ফরেনসিক সাইন্স কি এবং দেশের ফরেনসিক সাইন্সের বর্তমান দুরাবস্থার চিত্র।

ফরেনসিক বলতে মোদ্দা কথায় যা বোঝায় তা হলো,  “ application of scientific principles and practices to the adversary process where specially knowledgeable scientists play a role” যা চারটি শক্ত পিলারের উপর দাড়িয়ে একে অন্যের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে।  ফরেনসিক বিষয়ের প্রধান এই চারটি পিলার যথাক্রেমে ১। ফরেনসিক সাইন্স, ২। ফরেনসিক মেডিসিন, ৩। ফরেনসিক সাইকোলজি ৪। ফরেনসিক কেমিস্ট্রি যা আবার অনেকগুলো শাখা উপশাখায় বিভক্তে হয়ে কাজ করছে। যেমন,

১। ফরেনসিক সাইন্স ঃ

ফরেনসিক টক্সিকোলজি ঃ যা বিষ বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে

ফরেনসিক ওডন্টোলজী  ঃ যা দাঁতের মাধ্যমে সনাক্তকরণ বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে

ফরেনসিক ইঞ্জিনিয়ারিং   ঃ যা কোন সরঞ্জমাদি বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে

ফরেনসিক সাইকোলজি   ঃ যা মানুষের ক্রাইমএ দায়িত্ব বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে

ফরেনসিক এন্থ্রোপলজি ঃ অস্থি বিষয়ক সমস্যার সমাধান করে

 

২। ফরেনসিক মেডিসিন ঃ

  1. Forensic Ballistics     : আগ্নেয়াস্ত্র আর বোমা সংক্রান্ত
    2. Forensic Criminology       : অপরাধ আর অপরাধী সংক্রান্ত
    3. Forensic Dactylography   : হাতের ছাপ এর ব্যাবহারে সনাক্তকরণ সংক্রান্ত
  2. Forensic Osteology : অস্থি বিষয়ক জটিলতার সংক্রান্ত
    5. Forensic Pathology          : মৃত্যুর কারণ ও ধরণ বিষয়ক জটিলতার সংক্রান্ত
  3. Forensic Toxicology : বিষ সংক্রান্ত
    7. Forensic Thanatology      :  মৃত্যুর চিকিৎসা ও আইনগত সমস্যার সমাধান
    8. Forensic radiology           :  রঞ্জন রশ্মির মাধ্যমে জটিলতা নিরসন সংক্রান্ত
    9. Forensic Odontology       : দন্ত বিষয়ক জটিলতা সংক্রান্ত
  4. Forensic Serology             : রক্ত ও বীর্য নির্ণয়ের মাধ্যমে জটিলতা সংক্রান্ত
    11. Forensic Psychiatry         :  মানসিক সুস্থ্যতা ও আইনের প্রয়োগ সংক্রান্ত
  5. Forensic Obstetrics :  প্রসব জনিত আইনি জটিলতার সংক্রান্ত

 

৩। ফরেনসিক সাইকোলজি

ফরেনসিক বিজ্ঞানের এই শাখাটি অপরাধীর বর্তমান আর অপরাধ ঘটনকালীন মানসিক অবস্থা নিড়নয়ের পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মানসিকতাকে চাংগা করে কোর্টে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত করে থাকে। অন্যান্য কারজ্যক্রমের মধ্যে আছে

  • অপরাধীর উপযুক্ততা নির্ণয়
  • শাস্তির সুপারিশ করা
  • পুন অপরাধ সংঘটনের সম্ভাব্যতা যাচাই
  • আদালতে বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান
  • শিশু জিম্মার উপযুক্ততা নির্ণয়

৪। ফরেনসিক কেমিস্ট্রি

ক্যামিস্ট্রির পাঁচটি মুল শাখা হলো ১।  ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ২। এনালাইটিকাল কেমিস্ট্রি ৩। বাইয়ো কেমিস্ট্রি ৪। অরগানিক কেমিস্ট্রি এবং ৫। ইনরগানিক কেমিস্ট্রি। এই শাখাগুলোকে ঘিরে আছে বিভিন্ন উপশাখা যেমন Materials Chemistry, Theoretical Chemistry, Macromolecular (Polymer) Chemistry, Nuclear Chemistry, Metallurgy, Forensic Chemistry, Medicinal Chemistry and more. এই পিলার এবং তার শাখা উপশাখাগুলি বিভিন্ন অবস্থায় একাকী কাজ করলেও যে কোন প্রতিবেদনের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে এদের গুরুত্ব অপরিসীম। এরা একে অন্যের পরিপূরকও বটে। এগুলির কোন স্থানে ঘাটতি থাকলে সেই ফাঁক দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে আসে। যেমনটি আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই হচ্ছে। আইনেই তো বলা আছে, দশজন অপরাধী মুক্ত হয়ে গেলেও একজন নিরপরাধী যেন সাজা না পায়!!

অনেকেই হয়ত তর্কের স্বরে বলবেন, বাংলাদেশে কি পলাতক অপরাধী ধরা পরে নি? অথবা ঘটে যাওয়া ঘটনার সফলভাবে পুনর্গঠন হয় নি ? হ্যাঁ , মান্ধাত্মা আমলের পুলিশ সোর্স আর পুলিশের লাঠির বারিতে কিছু ঘটনার সুরাহা হয় বৈ কি তবে তার সংখ্যা খুবই সীমিত। এই সংখ্যা আধুনিক যুগে বড়ই বেমানান। আপনার গায়ে কেউ বোমা মারলো আর আপনাকেই যদি সন্দেহ করে চালান দেওয়া হয় সেটি কত অবমানকর ভাবতে পারেন? ফরেনসিক বিজ্ঞানে লোকার্ডস সূত্রে বলা আছে, অপরাধী ঘটনাস্থলে তার কৃতকর্মের কিছু আলামত রেখে যাবেই। এজন্যই কোন ঘটনা ঘটে গেলে পুলিশ সেই ঘটনাস্থলকে অবিকল রেখে দেয় যেন ফরেনসিক এক্সপার্ট সেই কর্মস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করতে পারে। ইরাক যুদ্ধের বদৌলতে আমরা সবাই আমেরিকানদের চোখে রাতের চশমা দেখেছি। সেই চশমা যারা পড়েন তারা অন্ধকারেও দেখতে পান। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের বিশেসজ্ঞতাই এমন যেখানে সাধারণ মানুষের চোখে কিছু দৃশ্যমান না হলেও তারা ঠিকই ঘটনাস্থল থেকে আলামত/ অপরাধের সুত্র খুঁজে পান যার মাধ্যমে পরবর্তীতে মুল ঘটনা বেড়িয়ে আসে। এখন প্রশ্ন হল আমাদের দেশের ফরেনসিক বিদ্যান আর বিজ্ঞান কতটুকু উন্নত?

প্রিয় পাঠক, আপনি কি বলতে পারেন উপরে বর্ণিত ফরেনসিক পিলারের সকল শাখা প্রশাখা কি বাংলাদেশে বিদ্যমান? ফরেনসিক মিডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি নিশ্চয়তার সাথে বলেতে পারি স্বয়ং  ফরেনসিক মেডিসিন পিলারটি বড্ড নড়বড়ে। শাখা প্রশাখাগুলো বিশেষজ্ঞের অভাবে নাম কা ওয়াস্তে বেঁচে আছে।  অনেক শাখা প্রশাখায় কোন বিশেষজ্ঞ পদ অদ্যাবধিও সৃষ্টি হয় নি। সুতরাং পুলিশকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা কাকে ধরবে? কিভাবে ধরবে?  অপরাধীরা তো সনাক্তের অভাবে ধরাছোঁয়ার বাহিরেই থেকে যাচ্ছে। ব্যবহারিক ফরেনসিকের প্রকট অভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হচ্ছে। শিশু জেহাদ যেদিন পাইপের ভিতর পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর তখন শুনলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা দিলেন জেহাদ পাইপে নেই! মিতু হত্যাকাণ্ডের পর ঘোষণা দিলেন, মটর সাইকেলে তিনজন চড়া নিষিদ্ধ হচ্ছে। চিলে কান নিয়েছে শুনেই কি চিলের পিছে ছুটতে হবে? যদি প্রশ্ন রাখি, কবে মোটরসাইকেলে তিনজন বৈধ ছিল? সম্ভবত তার বরাতেই সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে ইসরাইল আর আইএসএস এতে জড়িত। তাই যদি হবে তাহলে তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? সন্দেহের তালিকায় চোরাকারবারি, জামাত শিবির ও ইসলামী জংগী দলগুলোর কোনটিই তো আর অবশিষ্ট নেই। স্বয়ংসম্পূর্ণ ফরেনসিক সাইন্স যদি না থাকে তাহলে কোন চালনীতে চেলে এদের  দায়মুক্তি দেওয়া হবে? ইতিমধ্যেই চার হেফাজত কর্মীকে ধরে, শুধু কথা বলে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল যুগে এনালগ দায়মুক্তি কি ধোপে টেকে? তারা সন্দেহভাজনই বা হলো কিভাবে? এসব অসংলগ্নই কথাবার্তা বা কর্মকাণ্ড বিজ্ঞানের যুগে অচল এবং তা অচলই থেকে যাবে যদি না দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়া না হয়। আর ব্যবস্থা নিতে হলে তা হতে হবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফরেনসিক জ্ঞানের ব্যবহারে অপরাধী সনাক্ত করা। এ ছাড়া সরকারের সামনে দ্বিতীয় কোন পথ খোলা কাছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। সরকার যদি সত্যিই অপরাধীদের সনাক্ত করতে চায় তাহলে উপরে বর্ণিত ফরেনসিক বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাকে সুসংগঠিত করতে হবে। আর এটি করতে হলে স্থাপন করতে হবে স্বায়িত্বশাসিত ফরেনসিক সাইন্স ইন্সটিটিউট, যা আগে বহু লেখায় আমি প্রকাশ করেছি।

পরিশেষে জানাতে চাই, বিরোধীদলের আগুনপ্রীতিতে সম্প্রতি সরকার বার্ন ইউনিটকে বার্ন ইন্সটিটিউটে রূপান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। সেইদিন বেশী দূরে নয় যেদিন ইসরাইল আর আইএসএস এর হত্যাপ্রীতিতে সরকার দেশে ফরেনসিক সাইন্স ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠায়ও সম্মতি দিবে। দেরী হলে, ততদিনে হয়ত আমাদের আরও কিছু অকাল প্রয়াণের বোঝা বহন করতে হবে।

যোগাযোগ ঃ [email protected]

Ishrat Jahan Mouri

Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

One thought on “মিতু হত্যার সমাধান এবং ফরেনসিক স্টাডি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা

  1. নৈতিক ভিত্তি সবল থাকতে এবং থাকার পরিবেশ না করলে বিশেষঞ্জ ইনস্টিটিউট করলে ও রিপোর্ট এখনকার মতই হবে।কারণ বিবিধ রাজনৈতিক,প্রসাশনিক,বৈদেশিক চাপ ইত্যাদি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ডা বুশরা বিনতে আলম: বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

Mon Jun 13 , 2016
ডা বুশরা বিনতে আলম বিশ্বব্যাংকে জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ  হিসেবে কর্মরত। ২০০৯ সাল থেকে তিনি এই পদে কর্মরত রয়েছেন। ডা বুশরা বিনতে আলম ১৯৮৫ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। এরপর লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এবং ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে ভাইরোলজিতে এমএস করেন। এছাড়া প্রিভেনটিভ এবং সোশ্যাল মেডিসিনে তিনি […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo