প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
গল্পের শেষ আছে, জীবনের কী শেষ আছে? জীবন তো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। অনবরত তার স্ট্যাটাস আপডেট করে যাচ্ছে।
আজ এক বহু পুরনো বন্ধু ফোন দিয়েছিল। জীবনের গল্প নিয়ে। উপচে পড়া খুশিতে সে কথা বলতে পারছে না। বলছিলো “তুমি কী বিয়ে করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছো?” প্রতিজ্ঞা পাহাড়ের মতো অবিচল। খেয়াল মাটির মতো চির পরিবর্তনশীল। কখন কোন ‘খেয়াল’ প্রতিজ্ঞা, আর কোন ‘প্রতিজ্ঞা’ খেয়াল হয়ে দাঁড়ায় মানুষ কী তা বলতে পারে? সময় সবচেয়ে বড় বক্তা। আমি আর কী বলি? চুপচাপ থাকলাম। আজকাল এ বিষয়টি খুব ভোগাচ্ছে। মানুষের কৌতুহল বয়স, পদ, সম্পর্ক কিছুর বাঁধ মানছে না।
তার খুশির কারন রেসিডেন্সি। আজ ডাক্তারদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা হয়েছে। তার স্বামী সুযোগ পেয়েছে। বেচারা অনেক বছর ধরে চেষ্টা করছিলো, হচ্ছিলো না। এদিকে সে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। গাইনিতে ক্যারিয়ার। তার বাধানো পথে সে জোরে গাড়ি চালাতে পারছে না, স্বামী বেচারার জন্য। আমি তার কলকলে হাসির শব্দ শুনতে পারছিলাম। এ কী শুধু বিজয় হাসির না স্বস্তিরও?
কত যুগ পার হয়ে গেল, কতদিন! এদেশের মেয়ে মনে কোনো পরিবর্তন আসলো না। পরম নির্ভরতা- স্বামীর প্রতি। স্বামীর চেয়ে বেশি এগুনো যাবে না! তার স্বামী কি করে- এ প্রশ্নে সে এতোদিন নীরব থেকেছে। এমন কোনো যুৎসই পরিচয় পায় নি, যে দেয়া যেতে পারে। তার সরকারি চাকরি, প্রায় কমপ্লিট কোর্স, চেম্বার অর্থের ঝলকানি- সব উজ্জ্বলতা ম্নান হয়ে ছিল এ এক প্রশ্নে। আজ তার থেকে তার মুক্তি। একটি গুমোট আবহাওয়ার পর যখন হঠাৎ বৃষ্টি হয়- তখন কী তা শুধুই আনন্দের ধারপাত না স্বস্তির ঠান্ডা হাওয়াও? কোনটি বেশি টানে?
আজ যদি উল্টোটি হতো- বরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন প্রায় কমপ্লিট, বউ আটকে আছে পড়ার টেবিলে, তবে কী বর এমন পাগল পাগল আনন্দ পেতো? এক ম্যাডামের কথা শুনেছিলাম তিনি সাধারণত ঘরোয়া অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন এ বিপত্তিগুলো থেকে বাঁচার জন্য। প্রেমের সমাপ্তি বিয়েতে না হলে কাব্য-কবিতা; বিয়ে হলে পরীক্ষা-অপেক্ষা। এদেশে মণিকাঞ্চন যোগ তখনি বলা হবে যখন ‘কাঞ্চন’ শব্দের অর্থ ‘একটি বিশেষ ফুল’ নয় ‘স্বর্ণ’ হয়। আজ তাই তার খুশির দিনই বটে।
আমি জানি আমার এ অতি বিশ্লেষণ দেখে আপনারা ভাবছেন- আমি কী খুশি নই? কোথায় যেন কষ্টের বীন বাজছে অথবা রাগের!! না গো না! আমি খুশি। শুধু নারী মননের অদ্ভুত আচরণ নিয়ে বলতে চাচ্ছি। এখানে ভালোবাসাটা আছে অবশ্যই। ভালোবাসা ছাড়া এমন উচ্ছ্বাসভরা পাগলামি থাকবে না।
আজ শুক্রবার। সপ্তাহের ব্যস্ততম দিন। আমার ধারণা খুব বড়মাপের ‘ছোটলোক’ না হলে সপ্তাহের একমাত্র ছুটির দিনটিকে কেউ পয়সা উপার্জনের কাজে লাগায় না। আমি এ গোত্রের। এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা সপ্তাহে সাতদিন, মাসে ত্রিশদিন।
আজ দেখলাম ক্ষেতে ধান লাগানো হচ্ছে। পানি দিয়ে জমি ডোবানো হচ্ছে আর কৃষক কুঁজো হয়ে দ্রুতগতিতে ধান লাগাচ্ছেন। এক দুই জমি। আস্তে আস্তে সব ভরে যাবে সবুজ ধানে। দূরের সরিষাক্ষেত গুলো সব হলুদ হয়ে আছে। কী সুন্দর! ঈশ্বর কুয়াশা কেটে আকাশ পরিস্কার করে নিয়েছেন সম্ভবত এরজন্য। উপর থেকে সরিষাক্ষেত দেখবেন বলে।
ওইদিকে মসজিদের পাশে এক বকুল ফুলের গাছ আছে। ঘাসের উপর অনাদরে ছোট অসংখ্য বকুলফুল পড়ে থাকে। কিছু পকেটে করে নিয়ে আসি। প্রাণ নেই কিন্তু গন্ধ ছাড়ে না। ফুল কুড়াচ্ছিলাম তখন জানলাম ডা. দীপঙ্কর পোদ্দার মারা গেছেন। উনাকে চিনি না। শুনলাম ভদ্রলোক গতরাতে ফেসবুকে ছবি আপলোড দিয়েছিলেন। এখন শুধুই ছবি! নাইট ডিউটি করে বাসায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ঊনচল্লিশ বিসিএস-এ জয়েন করেছিলেন। এক বছরের ছোট এক মেয়ে আছে। মন এতো খারাপ হলো কী বলবো!
মেয়েটি বড় হবে বাবা ছাড়া। এমন শক্ত করে তাকে আর কে ধরবে? আরেকটু বড় হলে কেউ কী তাকে বলবেন- কিছু মানুষ যে বকুল ফুল হয়। খুব ছোট, তারার মতো দেখতে, নীরবে ঝরে পড়ে। মৃত্যুর পরও সুবাস ছাড়ে না। তাদের রাখতে হয় বুকপকেটে, বইয়ের ভাঁজে, প্রিয় কোনো আবরণে।
বড় হোস মামনি। বড় হয়ে বাপের মতো ডাক্তার হবি।