এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল এক্সামের রেজাল্টের ঠিক আগে আগে এবং রেজাল্টের পর কিছুদিন মনটা খুব নরম থাকে। পবিত্র পবিত্র সাদা একটা মন। ঠিক এই অবস্হায় যারা আছেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই।
এখনই কিছু জিনিস ভেবে রাখুন। সারাজীবন নিজের মনের কাছে পরিষ্কার থাকবেন। রেজাল্ট হলে যারা ইন্টার্নশীপে ঢুকবেন দেখবেন ওয়ার্ডগুলোতে আপনাদের বেশ ভালো ভাবেই স্বাগত জানাচ্ছে। খেয়াল করলে দেখবেন সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত শুভেচ্ছা জানাচ্ছে কিছু ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। আবার বিভিন্ন কোম্পানি সবাইকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে আপনাদের অভ্যর্থনার আয়োজন করবে। এটা সেটা গিফট দিবে। লটারি হবে। ব্যাপক খানাপিনাতো থাকেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনি খুশি মনেই সেগুলোতে যোগ দেন, অভ্যর্থনা গ্রহণ করেন।
এই যে রিসিপশন হল, সেটা কিন্তু ফাও ফাও আপনাকে খাওয়ায় নি। সেই টাকা পই পই করে আপনার কাছ থেকে তুলে নেয়ার ধান্দায় থাকবে কিছু এম আর(মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ- ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি) । সকাল বেলা সবার সামনে যে ভিজিট হবে সেটা আপনিও নিতে পারেন কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন কিছু এম আর আলাদাভাবে আপনাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। প্রথমে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাবে সুযোগ পেলে সরাসরি বলবে। সেই সাথে থাকবে গিফট। আপনার রুম নাম্বার, ফোন নাম্বার জানতে চাইবে। সকাল বেলা রুমে হাজির হবে ওষুধ আর গিফ্ট নিয়ে। যাওয়া আসার পথে এটা ওটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দেবে। এত ভাল লাগবে বিষয়টা! আপনি না চাইলেও মনটা খুশিতে ভরে যাবে। নিজেকে কন্ট্রোল করা কঠিন। অবচেতন মন তখন এম আরের জন্যে অপেক্ষা করবে। সে যে কেন আসে না, কিছু ভাল লাগে না। না চাইলেও রোগীর ফাইলে অটোমেটিক সেই সব কোম্পানির ওষুধ আপনার কলমের মাথা দিয়ে বের হয়ে যাবে। লাগুক না লাগুক সেইসব প্রোডাক্ট লিখতে ইচ্ছে করবে। এমআর ডক্টর্স রুমে ঢুকলে রোগীর লোক ডেকে হয়রান হলেও চেয়ার থেকে উঠতে ইচ্ছে করবে না। ওটি (অপারেশন থিয়েটার) তে যেতে ভাল লাগবে না কারণ ওটিতে তো ভিজিট হয় না। ধীরে ধীরে আরো মাথায় উঠবে এম আর রা, আপনাকেও মাথায় তুলে রাখবে। প্রশ্রয় পেয়ে বলবে প্রোডাক্ট লিখে ছবি তুলে রাখবেন। এমনকি চূড়ান্ত পর্যায়ে মাসে মাসে টাকার খাম দেবারও অফার করবে।
আপনার সাদা মনটাতে কালো কালি ছিটানোর জন্যে হা হয়ে বসে আছে শত শত এম আর। বিশ্বাস করুন তাদের পাতা ফাঁদে পা দিলে একসময় নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হবে, ক্ষুদ্র মনে হবে। আমার নিজেরও এখন অপরাধবোধ হয়। কেউ গিফ্ট দিলেই খুশি মনে নিতাম। আমার রুমেও সকালে গিয়ে ঠকঠক করে ঘুম ভাঙিয়েছে তারা কয়েকদিন। গিফট দিয়েছে, ভায়াল দিয়েছে, মনটা আনন্দে ভেসে গেছে। যদিও অল্পকিছুদিন, কিন্তু সেই অপরাধবোধ আমাকে এখনো বিদ্ধ করে।
ডাক্তারদের কলম কিনে নেয়া বোধহয় খুব সহজ। খুব সস্তায় বিক্রি হয়ে যাই আমরা। মাত্র কয়েক হাজার টাকায়।
টাকাটা কি খুব বেশি দরকার?
১৫০০০ টাকা একজন ইন্টার্ন ডাক্তারের একা চলার জন্যে যথেষ্ট টাকা। তাতেও না হলে টিউশনি করান দুদিন। তাও না পেলে কোন স্যারের চেম্বারে বসুন। অনেকে আবার গাছের খায় তলারও কুড়ায়। ভালভাবে না শিখেই ‘খ্যাপে’ (ক্লিনিক ডিউটি) চলে যায় দূর দূরান্তে। ভাইরে, ইন্টার্নশীপের সময় শুধু ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করে, টাকা কামাতে ইচ্ছে করে। হাত পা নিশপিশ করতে থাকে। এতদিনের সাধনা, অপেক্ষার পালা বোধহয় ফুরালো।
কিন্তু বিশ্বাস করেন ইন্টার্ন শেষ করার পর যখন আসল জীবনে ঢুকবেন তখন মনে হবে ইশ আবার কয়েকটা দিন যদি অমুক ওয়ার্ডে কাজ করতে পারতাম, আহারে ঐ প্রসিডিউরটা যদি আরেকটু আয়ত্ত করতাম। যেই অনুভূতি এখন আমাদের হচ্ছে। তাই ইন্টার্নশীপের সময় ফাঁকি দেয়া মানে নিজের জীবনকেই ফাঁকি দেয়া, নিজের পায়ে কুড়াল মেরে পঙ্গু ডাক্তার হওয়া।
তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে ইন্টার্ন লাইফে একটু নিয়ন্ত্রিত থাকুন। ওয়ার্ডকে ভালবাসুন। বিন্দাস মজা করুন সবার সাথে। ঘুরতে যান ঘনঘন, তবে নিজেদের টাকায়। জীবনের সবচেয়ে রঙিন একটা সময় কাটান শ্বেতশুভ্র মন নিয়ে। সব রকমের কালি থেকে দূরে থাকুন। এই সময়ের কালির ছিটাগুলো আঁকড়ে ধরে থাকে মনকে। ধুলেও যেতে চায় না।
আপনার আশেপাশেই অনেক কে দেখবেন এম আরদের রেগুলার ভিজিট পর্যন্ত নেয় না। এটুকু লোভ যারা সংবরণ করতে পারবে তাদের স্যালিউট। তারা পারবে সব কিছু থেকে মুক্ত থাকতে। আবার অনেককে দেখবেন ভিজিট নিয়ে সেটা অসহায় রোগীদের দিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বাস করুন কাজটা অসম্ভব ভাল লাগায় মনকে আচ্ছন্ন করে। সত্যি বলতে, এই ‘ভিজিট’ বিক্রয়যোগ্য নয়।
সিদ্ধান্ত আপনার। ১৫০০০ টাকায় পরিশুদ্ধ আনন্দ নিয়ে ইন্টার্ন লাইফটা পার করবেন নাকি স্যাম্পল ওষুধ বেচা অল্প কিছু অন্যায় বাড়তি টাকা আর গিফটের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেবেন আর পরে আফসোস করবেন। এখন নরম মন নিয়ে একটু ভেবে রাখুন, কাজে দেবে।
উপদেশ হিসেবে নেবেন না। সে ধৃষ্টতা আমার নেই। মাত্র বছর দুয়েক আগে পাশ করা আপনাদের বন্ধুবর বড়ভাই হিসেবে এলেবেলে কিছু বললাম যদি একজনও আগে থেকে ফাঁদগুলো সম্পর্কে সতর্ক হতে পারেন। অনেক অনেক শুভকামনা আপনাদের জন্যে।
ডা: আসিফ উদ্দিন খান
osadharon laglo.
প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররা কেমন ক্যারিয়ার গড়ে থাকেন?