প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৫ এপ্রিল ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
চিৎকার শুনে আমি লেবার রুমে ঢুকলাম। ভয়ঙ্কর অবস্থা। ছোট রুম, অন্ধকার। রোগীর লোকেরা চায় না পুরুষ ডাক্তার আসুক। রোগীর স্বজনের চাওয়া না চাওয়ার চেয়ে বড় বাধা আমাদের অদক্ষতা। এ বিদ্যা আমরা অচ্ছুতের মতো এড়িয়ে এসেছি। সব সিদ্ধান্ত তাই সিস্টার বা ধাত্রীরাই দেয়। আমাদের কাজ সিগনেচার করা, আর ছুটির সময় একগাদা ঔষধ লিখে দেয়া। দেখলাম এক টেবিল, ছুড়ি, কাঁচি আর একটি সুঁই সুতা ছাড়া কিছু নেই। ঘোলা পানিতে ফ্লোর ভিজে আছে। সেখান থেকে উৎকট গন্ধ আসছে। আগন্তুকের কী দশা, এমনভাবে ঢেকে রেখেছে যে কাছে ঘেষার উপায় নেই। দূর থেকেই স্টেথো দিয়ে লাব-ডাব-লা–ব-ডা–ব-লাব-ডাব শোনার বৃথা চেষ্টা করলাম। ধাত্রী চিৎকার করে চাপ দিতে বলছে, মা-ও চিৎকার করছে। ব্যথানাশক কিছু দিতে হবে কিনা- ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম।
লকডাউন হোক, বা বৃষ্টি, যুদ্ধ, বা মহামারী- মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া থেমে নেই। জীব অমরত্বের বিনিময়ে জন্মদান বেছে নিয়েছিল, জড় জন্মদানের বিনিময়ে অমরত্বকে ধরে নিয়েছে। লেবার রুমে কেউ কিছুক্ষণ থাকলে তার মাতৃভক্তি আপনা আপনি আসতে বাধ্য। অনেক পেইনফুল। অনেক।
লকডাউন এখন ধৈর্য পরীক্ষার পর্যায়ে চলে গেছে। প্রায়ই অদ্ভুত খেয়াল হয়। যেমন এক বন্ধু বলছিল- তার খুব তন্দুরি রুটি খেতে ইচ্ছে করছে। চুলার ভেতর থেকে কালো লোহার আঁকশি দিয়ে গরম গরম রুটি বের করে আনবে। সাথে হালিম। ঘন ডাল, দুই তিন মাংসের টুকরা ভাসবে, উপরে মশলা বিছানো থাকবে, বাটির পাশে প্লেটে- দু’টুকরা লেবু। চরম বিপদের দিনেও আড্ডাবাজ বাঙালি আড্ডা আর খাওয়ার গল্প ভুলে না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনলাম পাশের ফ্ল্যাটে গল্প করছে- ‘ইউরোপের কোন দেশ যেন হিজাব নেকাব নিষিদ্ধ করেছিল, এখন বাধ্য হয়ে বাধ্যতামূলক করেছে’। আরেকজন বলছে ‘কোন দেশ?’ ‘কোন দেশ যেন মনে নেই। ফ্রান্স, ইতালি, নয়তো জার্মানি’। একটু চোখ কান খোলা রাখলে এ দেশে রসের অভাব নেই। ফেসবুকে ট্রল অথবা ফান পোস্টগুলি বেশি শেয়ার হয়। কারো না কারো নির্বুদ্ধিতায় রসের হাড়ি জ্বাল হচ্ছেই।
আগামীকাল আবার দিনরাত ডিউটি। সেদিন স্বামীর মার খেয়ে এক মহিলা এসেছিলেন। আমরা শুধু দেহের চোট লিখে রাখতে জানি। মনের চোটের লেখাজোকা নেই। এক বছরের এক ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে এসেছিলেন, মেয়েটাকেও মেরেছে পাষণ্ডটা। যৌতুকের দাবিতে। ছোট বাবুটা একদম চুপচাপ, মায়ের কাধে মাথা দিয়ে ছিল। আঠারো বছরের নিচে বাল্যবিবাহ গ্রামেগঞ্জে এখনো হয়। আমরা রোগী পাই।
ইমার্জেন্সিতে চেয়ারম্যান-মেম্বার-সভাপতিরা চিকিৎসা শেখায়! ফোনে বলে ‘রোগী ভর্তি রাখেন, আমার অমুক হয়’। ভর্তি রাখি। গ্রামের মানুষ সহজ সরল- এটি সম্ভবত একটি জনপ্রিয় মিথ। আমি অন্তত এরকম লক্ষন দেখি নি।
রমযান মাস শুরু। রাস্তার পাশে সুস্বাদু ইফতারের পশরা দেখব কিনা জানি না। যেভাবে মাইকিং করছে মনেহয় বসবে না। এখানে ভাঙা এক মাইক আর অস্পষ্ট কণ্ঠে মাইকিং হয়। কী বলে কিচ্ছু বোঝা যায় না। যারা নিয়োগ দেন তারা ঘরে বসে শোনার কাজটিও ঠিকমতো করেন না। ব্রিটেনে পরীক্ষামূলক ভ্যাক্সিন প্রয়োগ হয়েছে। আজ দেশে আক্রান্ত সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। ভারতেও আক্রান্ত আজ তাদের সর্বোচ্চ। আমরা কোন দশায় আছি পরিস্কার নয়।
সেদিন একটু পরেই সে মা আর সদ্যোজাত বাবুটা ছুটি নিতে এলো। ধবধবে টায়েলে জড়ানো বাচ্চাটি তার নানীর কোলে ঘুমাচ্ছে। বাইরে তখন করোনার ভয়ে নাক মুখ ঢাকা এক পৃথিবী। আশার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন। ‘এভ্রি চাইল্ড কামস উইদ দ্যা মেসেজ দ্যাট গড ইজ নট ইয়েট ডিসকারেজড অফ ম্যান’।