প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৭ এপ্রিল ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
আমাদের ডিউটি রুমটি মা শা আল্লাহ। একটি বড় ভাঙ্গা টেবিল, একটি কাঠের চেয়ার, ছোট তিন চার প্লাস্টিক চেয়ার, একটি সেল্ফ, আর দুইটি ক্যাবিনেট। ক্যাবিনেটে চারটি করে ড্রয়ার। লকিং সিস্টেম নষ্ট বলেই আমরা পেয়েছি। রুমের একপাশে ছাদ চুয়ে চুয়ে পানি পড়ে। দোতালায় ফিমেল ওয়ার্ডের টয়লেট প্লাস ওয়াশরুমের পানি এটি। হালকা ঘিয়ে রঙের এ পানি দেখি আর মনেমনে ধন্যবাদ দেই। অন্তত কোনো ‘বদবু’ নেই! একটি এসি নতুন লেগেছে। ঘুলঘুলি গুলো আমরা ঔষধ কোম্পানির কাগজ দিয়ে লাগিয়ে নিয়েছি, জানালাগুলো দড়ি দিয়ে। একপাশের একটি নষ্ট টিভি দেয়ালের সাথে ঝুলে আছে। আমরা সরাই না, কারন টিভি না চালালে বোঝা যায় না সেটি নষ্ট। পাশে এটাচড বাথ। তার তিনটি কল। তিনটি কলই কম-বেশি নষ্ট। শুনেছি বর্ষা কালে পানি যাওয়ার রাস্তা দিয়ে সাপ উঠে। একটি সেমি ডাবল বেড আছে। ওখানে শোয়ার জন্য আপনাকে দুই প্রস্থ বেডশিট ব্যাগে রাখতে হবে। পরিচ্ছন্নতার কোনো স্কেলেই আপনি একে ফেলতে পারবেন না। ডিউটি ডক্টর ছাড়াও ও রুমের বাসিন্দা আরো দুই-তিন পরিবার টিকটিকি, কিছু তেলাপোকা, আর অসংখ্য ছাড়পোকা ও মশা। মাঝে মাঝে অতিথি হিসেবে সারিবদ্ধ পিঁপড়া, চিকা ইঁদুর, লাল ট্রেনের মতো ছোট ক্যারারা আসে। আমরা সবাই মিলেমিশে থাকি। কখনো শুয়ে সিলিংয়ে ঝোলা নোংরা ফ্যানটার ঘোরা দেখি।
আমাদের কমিউনিটি সেন্স ঠনঠনে, সিভিক সেন্স মারাত্মক। হাসপাতালের কোল ঘেঁষে মসজিদ, গা ঘেঁষে মন্দির। মাঝরাতে কুম্ভকর্ণেরও যেন সেহরি মিস না হয় সে দায়িত্ব তাদের। আপনি রোজাদার নন কিনা, বা হাসপাতালে খারাপ রোগী আছে কিনা- এগুলো কোনো বিবেচ্য নয়। এসব কাজে কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। গেল অষ্টপ্রহরে অষ্টটা প্রহরই মাইক বেজেছে। হাসপাতাল বা কুম্ভকর্ণ কাউকে কেউ ছাড় দেয় নি। সত্যি বলতে আমরা আসলেই স্বাধীন। আপনার কফ ফেলানোর স্বাধীনতা, প্রাকৃতিক কার্যের স্বাধীনতা, মাইকের স্বাধীনতা- এরকমভাবে আর কোনো দেশ দিবে না।
এ ধরুন লকডাউন চলছে। আমার আশেপাশে বাড়ি বানানোর কাজ কিন্তু থেমে নেই। ইট ভাঙ্গার শব্দ, টাইলস কাটার শব্দ, ড্রিল মেশিনের শব্দ, মানুষের কথাবার্তা- একদম পুরোদমে চলেছে। তারা বাসার মালিক- সবাই শিক্ষক। সিভিক সেন্স তাদের কাছ থেকে শেখার কথা। অথচ লুকিয়ে চুপিয়ে এক দুই ব্যাচ প্রাইভেট পড়াতেও দেখেছি। স্বাধীনতা কোথায় নেই বলুন!
উপজেলায় চাকরি নিয়ে গ্রামে আসার আগ পর্যন্ত বীরের জাতি বলতে হুন জাতি, গ্রীক জাতি বা তুর্কী জাতির নাম জানতাম। এখানে এসে দেখলাম বাঙালি কম বীরের জাতি নয়। মারামারিকে তারা বিনোদন হিসেবে নিয়েছে। প্রথম রোযা সাথে লকডাউন, প্রশাসনের কঠোর নজরদারি- কিন্তু সকাল সকাল আটজন এসে হাজির মাথা টাথা ফাটিয়ে। এ লকডাউনে হার্টের রোগী, স্ট্রোকের রোগী, কিডনি রোগী কমে গেলেও মারামারির রোগী একবেলার জন্য কমে নি। আর মিথ্যে কথা বলা। গ্রামের লোকেরা ভাত খাওয়ার মতো করে মিথ্যে কথা বলতে জানে।
কোথা থেকে কোথায় চলে আসছি। লিখতে বসেছিলাম লকডাউন ডায়েরি। এজন্যই প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের স্থান দেন নি! আসলে লকডাউন নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। কিছু অফিস আজ থেকে খুলে যাবে শুনেছি। মানুষ লকডাউন একদমই মানছে না। অনেক লোক রাস্তাঘাটে দেখা যায়। তবে সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। শহর আক্ষরিক অর্থেই ভূতূড়ে শহর হয়ে যায়। নিজের ছায়া দেখলেও ভয় লাগে। অনেক বাসাবাড়ির ভেতর থেকে আলো বের হয় না। কিছু ফার্মেসি খোলা থাকে, তাও অর্ধেক শাটার নামানো। ভয় করোনা নিয়ে নয়, ভয় ওঁৎ পেতে থাকা ঠেকের ভয়। মানুষের চুলায় ভাত নেই, মাস্কের শহরে অপরাধ করে গা ঢাকা দিলে কাউকে দোষ দেয়ার নেই। দুই এক বিড়িখোর ইফতারের পর বের হয়- তাদের দেখে জানে পানি আসে। কোনো হোটেল রেস্টুরেন্ট খোলা দেখি নি। সে রমযানের প্রভাবেও হতে পারে।
এখন প্রায় প্রতিদিনই ঝড় সহ বৃষ্টি হচ্ছে। ধানগাছ গুলোয় চুলে পাক স্পষ্ট হওয়া শুরু করেছে। রাস্তার পাশে দু’চারটি কৃষ্ণচূড়া গাছে লাল লাল ফুল এসেছে। হালকা সবুজ পাতায় টকটকে লাল ফুল। মাটি ভিজে থাকে লাল ফুলে। সাথে ঠান্ডা বাতাস। সময়টি অপূর্ব।
আজ পড়লাম- মৃণাল সেন স্ক্রিপ্ট লেখার সময় কলকাতার বাইরে চলে যেতেন, ঋত্বিক ঘটক ঘরেই থাকতেন কিন্তু কারো সাথে দেখা করতেন না, তপন সিনহা যেকোনো পজিশনেই লিখতে জানতেন- ভীড়বাট্টা কোনো ইস্যু নয়, সত্যজিৎ রায়েরও তাই। সব সামাজিকতা রক্ষা করেই তিনি লিখতেন। ফোনে কথা বলতেন।
চার বিখ্যাত বাঙালি পরিচালক, চার রকম মেজাজ। লকডাউনে সবাই একরকম আচরণ করবে- ভাবা অন্যায়।