১৬ এপ্রিল ২০২০:
ডা. শুভদীপ চন্দ
আজ যখন স্যার আমার হাতে একটি N95 মাস্ক তুলে দিলেন, আমি গুনে দেখলাম মোট মাস্ক এসেছে সাতটি। আমি নিলাম না। সামনে ইমার্জেন্সি লাগতে পারে।
রেনকোটে বানানো পিপিই- সেও ছিড়ে গেছে, চশমা দুইদিন পরেই ভেঙ্গে গেল, মাস্ক কাপড়ের- প্রতিদিন ধুয়ে ধুয়ে পরি। গ্লাভস এখন নেই। বিনা গ্লাভসেই রোগী দেখতে হয়। বাইরে এক জোড়া গ্লাভস ত্রিশ চল্লিশ টাকা। ধুয়ে পরেরদিন পরতে গেলে ছিড়ে যায়। আগে এক বক্স ৫০ জোড়া পাওয়া যেত ১৮০-২০০ টাকায়। পকেট হ্যান্ড স্যানিটাইজার একটি পেয়েছিলাম সত্য, কিন্তু ওটাই কেয়ামত পর্যন্ত চালাতে হবে ভাবি নি। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খায়- এগুলো আদৌ প্রোটেক্টিভ কিনা! আমরা বেশিরভাগ তা মনে করি না, তবু্ও পরি কারন যতটুকু প্রোটেকশন হয়। হাসপাতালের বাকি স্টাফরা সার্জিক্যাল বা কাপড়ের মাস্ক দিয়ে থুতনি ঢেকে এ কাপড় বেশ আগ্রহ নিয়েই পরে- নতুন সার্জনদের মতো।
ডাঃ মঈনউদ্দীন স্যারের মৃত্যু সংবাদটি যখন পেলাম তখন আমরা হাসপাতালে। পুরো রুম নীরব হয়ে গেল। আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের একই পরিণতিতে যেতে হবে। এক কলিগ আচমকা প্রশ্ন করলো- ‘ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারে কী গর্ভের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে?’ আমি পড়েছিলাম ভারতের ICMR এর একটি রিপোর্ট- “করোনা ভার্টিকাল ট্রান্সমিশন হয়, কিন্তু টেরাটোজেনিক এমন কোনো ডকুমেন্ট নেই”। এ কঠিন পরিস্থিতিতে ডাক্তাররা নিজেদের চেয়ে পরিবার নিয়েই বেশি চিন্তিত। সব দুর্যোগেই মনে হয় এমন হয়। প্রায় সবাই বাসাবাড়িতেই আলাদা থাকছেন। আলাদা খাচ্ছেন।
মগবাজারে ইনসাফ বারাকাহ হাসপাতাল সিলগালা হয়ে গেল। দুইজন ডাক্তার সহ তেরোজন আক্রান্ত। আমাদের বাসা থেকে ঢেল ছোঁড়া দূরত্ব। সম্ভাবনা আছে পুরো মগবাজারে ডিজিজটি ছড়িয়ে পড়ার। মাঝেমাঝে ভাবি আমাদের অনেকের সাথেই হয়তো অনেকের দেখা হবে না।
দূর থেকে টেম্পারেচার দেখে যে থার্মোমিটারে সেটি শুধু টিভিতেই দেখেছি, চর্মচক্ষে দেখি নি। রোগীরা মিথ্যে বলছেন। এটি হয়তো কিছুটা সাহায্য করতে পারতো। অন্তত জ্বরের রোগীগুলো দূর থেকে বুঝতে পারতাম। এখন সামরিক বায়োনকুলার ছাড়া যুদ্ধ হচ্ছে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি মাইনে পা পড়ে গেছে। যাই হোক, এগুলো নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত- আমরা কি কি পাব, কতটুকু কী লাগবে।
এখন কোন কিছুকেই তেমন কিছু মনে করি না। আমরা গরিব দেশ, যতটুকু পাচ্ছি সে-ই অনেক। খারাপ লাগে মানুষের আচরণে। এক পুলিশ আজ আমাদের একজনকে বলেছে- ‘ডাক্তার হইছেন তো কী হইছে! হাসপাতালে থাকবেন বাইরে বের হইছেন কেন?’ এক রোগী ধমকের সুরে বললো- ‘আমার জ্বর-টর কিছু হয় নাই, দশটা প্যারাসিটামল লিখে দেন, আর মেট্রো।’
এরমাঝেই হঠাৎ পুরো আকাশ কালো হয়ে গেল। শুরু হলো বাতাস। কারেন্ট চলে গেল। আমরা হাসপাতাল কম্পাউন্ডে দাঁড়ালাম। বাতাস যেন সব উড়িয়ে নিবে। ধুলায় চোখমুখ বন্ধ। তাণ্ডবলীলা চললো বেশ কিছুক্ষণ, তারপর বৃষ্টি। অনেকক্ষণ বৃষ্টি হলো। বৃষ্টিশেষে আকাশ মনখারাপ নিয়ে বসে রইলো। ধানক্ষেতের সবুজ যেন আরো গাঢ় সবুজ। সবুজের মাঝেমাঝে ছোট বাঁশে পলিথিন বাঁধা। দূর থেকে দেখে পতাকার মতো লাগে। এগুলো কেন লাগায় কে জানে! মাঠঘাট সতেজ। কলাগাছ চার পাঁচটি একসাথে ঘেষাঘেষি করে থাকে। বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি সবুজ হয় কলাগাছ গুলো। বাঁশঝাড় থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির পানি পড়ে। মাটির এক গন্ধ আছে। শুধু এক পশলা বৃষ্টির পরই পাওয়া যায়। হাঁসগুলো পিছনে হাতদিয়ে সাঁতার কেঁটে বেড়ায়।
এর মাঝে আমরা ইয়ার্কি করছিলাম বাসায় গিয়ে কে কিভাবে খিচুড়ি খাব! শত ক্রাইসিসেও বেঁচে থাকাটা সুন্দর। তাই না?
এ লকডাউনের মাঝে কেউ কেউ ঘর ছেড়ে বের হয়। রাস্তা একদম জনমানবশূন্য এমন বলা যাবে না। মানুষের কাজ থাকে- সমাধান তো হেঁটে হেঁটে ঘরে ঢুকে না।
আচ্ছা, ডাঃ মঈনউদ্দিন যে মারা গেলেন, উনার পিচ্চি দুটোকে আমরা কি জবাব দিব? তাদের বাবা যে এম্বুলেন্স পায় নি, প্রোটেকশন ছাড়া ডিউটি করছিলেন, উনার অবস্থা এত খারাপ নয় কেউ কেউ বলছিলো- এগুলো যদি তারা জেনে যায়!
উনার কথা আজ যতবার মনে হচ্ছে মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সেম প্রফেশন বলেই হয়তো! ফেসবুকেও ঢুকছি কম। ম্যাসেঞ্জারের স্ক্রিনশট গুলো আর দেখতে চাই না। আমি মারা গেলে যেন এমন স্ক্রিনশট না বের হয়! লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাবে!
এখন এটিই প্রত্যাশা- উনি যে পরকালে বিশ্বাস করতেন, সেখানে ভাল থাকবেন।