১৪ এপ্রিল ২০২০
ডা. শুভদীপ চন্দ
ছেলেটির বয়স চৌদ্দ, চুলে রাহুল কাট দেয়া, কানে হেডফোন। পেশায় বেসরকারি এম্বুলেন্স চালক। সারাদিন সরকারি হাসপাতালে থাকে। টুকটাক কাজ করে, খদ্দের খুঁজে। আমি বলেছিলাম- ‘তোকে পুলিশ ধরে না?’ বলে- ‘ধরে। আমাকে আটকাতে পারবে? বলি- খারাপ রোগী আছে। ছেড়ে দেয়।’ যেকোনো কথায় ফটফট উত্তর দেয়। শুধু ‘পড়াশোনা…?’ এ প্রশ্নে উদাস হয়ে থাকে। কিছু বলে না।
উপজেলা থেকে ড্রাইভার ঠিক করা হয়েছিল- করোনা সাসপেক্টেড রোগীর স্যাম্পল আনার জন্য। রোটেশন করে ডিউটি। কেউ রাজি হয় না। উল্টো ফোন করলে মোবাইল সুইচড অফ করে রেখে দেয়। এ ছেলেকে বলা হলো, এক কথায় রাজি। আমরাই বললাম- কাজটিতে রিস্ক আছে। বললো- ‘এটা কোনো ব্যাপার না!’ পিপিই পাওয়ার কথা শুনে চোখ চকমক করে উঠল। মনে হলো সমাবর্তনের গাউন পাচ্ছে! আমাদের স্যাম্পল কালেকশনে আর কোনো ঝামেলা নেই।
লকডাউনের আজ এক সপ্তাহ হতে চললো। এখন এটিই স্বাভাবিক। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। অবাক হই না। মুদির দোকান গুলোয় মাল আনতে পারছে না। অল্প অল্প করে আনে। এখন দুপুরে শুকনো চানাচুর খাই। পুরি সিংগাড়ার চেহারাই ভুলে যাচ্ছি। ওই লোকগুলোর কিভাবে চলছে কে জানে! আজ এক নাপিত এসেছিলেন জ্বর নিয়ে। বললাম- ‘আয় কত হতো প্রতিদিন?’ বললেন ‘পাঁচ ছয়শো তো থাকতই।’ ‘এখন?’ বললেন অনেক কথা, কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই। ‘যদি এভাবেই বাঁচা যায় তো আগে বাঁচি।’
রাজশাহী মেডিকেলের এক ছবি দেখেছিলাম- “হিরোস ওয়ার্ক হিয়ার”। আসলে কোথায় হিরো নেই? এ ছোট ছেলে এম্বুলেন্স ড্রাইভার, এ নাপিত ভদ্রলোক- প্রত্যেকেই হিরো। হিরোস আর এভ্রিহোয়্যার এন্ড ওয়ার্ক এভ্রিডে।
ছয় ডাক্তারের বহিস্কারাদেশ নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। ক্ল্যাশ অফ প্রফেশন- কিভাবে জানি তৈরি হয়ে যায়! ইউএইচএফপিও স্যারেরা আজ গাড়ি পেলেন। সরকারি চাকরিতে অফিসিয়াল গাড়ির গর্ব ও আনন্দ কোনকিছুর সাথে তুলনীয় না। স্যার যেচে আমাদের তার গাড়ির ছবি দেখালেন। বললেন- ‘কালো হওয়াতে ভাল হয়েছে। কালোটাই সুন্দর।’
এদিকে করোনাভাইরাস নিয়ে কোন সুসংবাদ নেই। টেস্ট বাড়ছে, রোগী বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে। মুম্বাইয়ে ধারাভি বস্তিতে আরো আক্রান্ত ধরা পড়লো। পৃথিবীর বৃহত্তম বস্তি। পাঁচ বর্গকিলোমিটারে প্রায় দশ লাখ লোকের বাস। কমন টয়লেট, গাদাগাদি করে জীবন যাপন। কর্তৃপক্ষ ফ্রি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বিতরণ শুরু করেছে। ছড়িয়ে পড়লে সম্ভবত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে যাবে।
আমাদের এম্বুলেন্সের জানালা গুলো ঝাপসা। একটুখানি উপরের দিকে স্বচ্ছ। ঝাপসা অংশ দিয়ে ভিতর বাহির কিছু দেখা যায় না। আমরা ওই এক চিলতে স্বচ্ছ অংশ কাঁচ দিয়ে আকাশ দেখি। রাস্তায় চলতে চলতে রাস্তা না দেখে, দিগন্ত না দেখে- আকাশ দেখার এ অভিজ্ঞতাটুকু নতুন।
আজ বাঙলা নববর্ষ। শুভ হোক নতুন বছর।