প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ জুন ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
মেডিকেল কলেজে এক সাবজেক্ট আছে ফরেনসিক মেডিসিন। যেকোনো আন-ন্যাচারাল মৃত্যুর অটোপসি হয়। মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মৃত্যুর কারন খোঁজা হয়। তৃতীয় চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররা অটোপসি এটেন্ড করে। আমি ভীতু মানুষ, চার পাঁচটি দেখেছি।
ডোম এসে কাটার আগে মৃতকে দেখতাম। কাটা শুরু হওয়ার পর পিছনে পালিয়ে যেতাম। আমার মনে হতো মৃতদেহ গুলো কিছু বলতে চাচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি না। প্রত্যেক হত্যাকারী যখন হত্যা করে মৃতের শরীর থেকে তার শরীরে কিছু একটা নিয়ে নেয়। সে হতে পারে একটি আর্তনাদ, গন্ধ, অস্থিরতা, বাঁচার চেষ্টা, অভিশাপ। এ লাস্ট গিফটটা কোনভাবেই এড়ানো যায় না। আস্তে করে চামড়ার নিচ দিয়ে ঢুকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। চামড়া ঘেঁষে এর অবস্থান। এমনকি যে মেয়েটার অটোপসি দেখেছিলাম আত্মহত্যা করেছিল, সেও তার প্রেমিকের শরীরে মিশে আছে। কোনো আচরণে, ভঙ্গিমায় বা অভিশাপে। এটি সারাজীবন থাকবে।
খুলনায় একজন ডাক্তারের মৃত্যু হলো। তাঁকে কী কয়েকজন হতভাগ্য স্বজন হত্যা করেছে? না। তিনি বাংলাদেশের হাতে খুন হয়েছেন। তার মৃত্যুর পিছনে বিচারহীন সংস্কৃতি, পেশাগত বৈষম্য, অসংখ্য অবিশ্বাস- সব কিছু দায়ী। এরকম ঘটনা এদেশের যেকোনো ডাক্তারের সাথেই ঘটতে পারে। অন্যদের সাথে তাঁর পার্থক্য তিনি একটু বেশি দুর্ভাগা। এখন তিনি মিশে যাবেন তার হত্যাকারী বাংলাদেশের সাথে। এবং সবচেয়ে বেশি শেয়ার করবেন অভিশাপ ও অতৃপ্তি। এজন্য এ দেশের রোগীরা কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয় না, চিকিৎসা শেষে কখনো পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। তা সে স্কয়ার হসপিটাল হোক বা ফার্মেসির চেম্বার! তৃপ্তি কোথাও নেই।
কোভিড উনিশ আমাদের অনেক ভুগাচ্ছে। বলা ভাল এতো বড় ক্রাইসিসে আমরা কখনো পড়ি নি। কেউ জানে না সামনে কি দিন আসছে। তবে এ থেকে কিছু জিনিস আমরা শিখে নিতে পারি। ভারতে ধারাবি বস্তিতে ওরা সফল করোনা মোকাবেলায়। পুরো মহারাষ্ট্র যেখানে ব্যর্থ, ধারাবির সফলতা অণুবীক্ষণ করতেই হয়। মাত্র ২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৮ লক্ষ লোকের বাস। ৪৭,৫০০ দরজা। ৮০ জনের জন্য এক টয়লেট। যেখানে ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং’ একটি অর্থহীন শব্দ। সেখানে সংক্রমণ ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। কেরালাও সফল। স্বাস্থ্যসেবা ডিসেন্ট্রালাইজ করার উপকারিতা তারা পাচ্ছে। আমাদের সমস্যা ডাক্তার, রোগী বা স্বজনদের মানসিকতা নয়; সমস্যা আমাদের সেট আপ। সব চিকিৎসা সেন্ট্রালে কেন্দ্রিভূত। পেরিফেরিতে কোয়ালিটির এক্স রে, ইকো, আল্ট্রাসনো, পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার- আমরা হতে দিচ্ছি কই? সে সেটাপ নেই, সেরকম হচ্ছে না।
কোথাও কোথাও সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে, মান নেই। মান মনিটরিং প্রয়োজন। এক্সরে র যে রিপোর্ট হচ্ছে কে করছে, ব্লাড রিপোর্ট ঠিক হচ্ছে কিনা, প্রত্যেক ইমেজিংয়ের নিচে সঠিক সাইন যাচ্ছে কিনা, ওটি ঠিক আছে কিনা, ওটির পর কোনো ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রোগী থাকছে কিনা- কঠিন মনিটরিং প্রয়োজন।
ডিসেন্ট্রালাইজ হলে রেফারাল সিস্টেম পোক্ত হবে। রোগী আরো খারাপ করে রেফার করার যে প্রবণতা সে কমবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তার পেশেন্ট রিলেশনশিপ উন্নত হবে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি- সঠিক ভাবে চিকিৎসা করতে পারি না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। চেয়ারম্যান ফোন দিয়ে বলে রোগী ভর্তি রাখেন, রোগী এসে বলে দশটা অমুক অমুক ঔষধ ফ্রি লিখে দেন, হাসপাতাল থেকে বলে অমুক সময়ে অমুক পরীক্ষা হয় না তমুক মেশিন নষ্ট- তাহলে কিভাবে কি? সবসময় মনেহয় সবাই মিলে প্ল্যান করে আমাকে চেতাচ্ছে! ডাক্তারদের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন। ক্ষমতা শুধু ক্ষমতাই দেয় না, দায়িত্বও দেয়।
সপ্তাহে মাত্র ৪৫ টি কোভিড স্যাম্পল পাঠানো যাবে। এলাকার নেতা পুরো গোষ্ঠী নিয়ে চলে আসলেন। একজন ডাক্তারের ধড়ে কয়টি মাথা যে তাকে ফেরাতে যাবে। যদি ঝামেলা হয় উনার সাথে কেউ নেই। ফেসবুকে লিখলে শেয়ার হবে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ ছাড়বে না। তো কি করা যাবে? বরং অনেক সহজ ‘মরুগ্যা, আমার কি’ বলে অনুমতি দিয়ে দেওয়া। তাই হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ।
করোনা একটি সুযোগ দিয়েছে সবকিছু নতুন ভাবে চিন্তা করার। আমরা এক বডি সেটি উপলব্ধি করার। কোনো অপমৃত্যু থেকে আমরা মুক্ত নই। এমনকি সিস্টেম যদি হত্যা করে সিস্টেমে সে মৃত শরীরটা একটু মিশে যায়। তার ফল ভোগ করতে হয় সবাইকে।
এদিকে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল চালু হয়ে গেছে। শহরের দোকানপাট সব খুলে গেছে। পাঁচটা পর্যন্ত নিয়ম থাকলেও সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। আড্ডা দেয়ার জায়গা গুলোয় অংশগ্রহণ বাড়ছে। হোটেল রেস্টুরেন্ট তেমন খুলে নি। দূরপাল্লার বাস যতটুকু দেখেছি নিয়ম মেনে চলেছে। দুঃসংবাদ আসছেই। অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। মানুষের জীবন হচ্ছে মরে যাওয়া পর্যন্ত অভ্যস্ততা..!
প্রতিদিন অভ্যস্ত হই নিজের মতো করে। মরে গেলে হত্যাকারীর সাথে মিশে বেঁচে থাকবো। ভাল লাগে ভাবতে! ‘আমাকে হত্যার পিছনে তুমিও কম দায়ী নও’।