প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
আশি শতাংশ কোভিড পজিটিভ রোগী এমনিই ভাল হয়ে যায়। আদা লেবু চা, এন্টিবায়োটিক, আইভারমেক্টিন, বা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কোনো রোল নেই। দিলেও যা না দিলেও তাই। আমরা দিচ্ছি কারণ ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসার। খড় খুটো ধরে যে ডুবন্ত মানুষ বাঁচতে চাচ্ছে সে খড়খুটোই চাচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান চাচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হবে ভবিষ্যতে। এন্টিবায়োটিক সব রেজিসটেন্স হয়ে যাচ্ছে।
অথচ এন্টিভাইরাল দুইটি সহজপ্রাপ্য করলে ভাল হতো। প্রথম তিন সাত দিনের মধ্যে এন্টিভাইরাল শুরু করতে পারলে উপকার আছে। শুধু কোভিড নয়, ইনফ্লুয়েঞ্জাও যদি হয়- এন্টিভাইরাল কার্যকরী। এগুলো সাতদিন পরে দিলে আর তেমন কাজ করে না। সবচেয়ে বেশি যে কমন ছবি আসছে- শ্বাসকষ্ট, সাত দশদিনের জ্বর। মাঝে সেরে গেছিলো এখন আবার আসছে, বুকে ব্যাথা। এন্টিবায়োটিক এজিথ্রোমাইসিন ডক্সিসাইক্লিন প্রায় মুড়ির মতো মানুষ খাচ্ছে। কোভিড টেস্ট RT-PCR একদম নিখুঁত নয়। ৬০-৭০% সঠিক ডায়াগনোসিস করতে পারে। ৩০-৪০% করোনা পজিটিভ রোগীও টেস্টে নিগেটিভ আসে। তারচেয়ে বরং এক্স রে চেঞ্জ বেশি পাওয়া যায়। সমস্যা হলো এ রোগী গুলো হিস্ট্রি গোপন করে। অথবা মিথ্যে বলে। বলছে- এরকম জ্বর গত দশ বছর ধরেই আসে। অথবা জ্বর না, জ্বর জ্বর ভাব।
মার্চ মাসের পর আর বাসায় যাই নি। গতকাল মা খুব কষ্ট নিয়ে মোবাইল ছাড়লো। একটি ক্রাইসিস প্রিয়ড চলছে বোঝে না। আমার যেসব কলিগ ও বন্ধু আক্রান্ত হয়েছে- নাম ঠিকানাসহ বললাম। তবুও বোঝে না! মুখ ভার করে থাকে।
এখানে তারাই বাঁচবে যাদের টাকা আছে। উপজেলা লেভেলে প্রতিদিন কোভিড টেস্ট হয় না। করোনা রোগী ভর্তি নেয়া হয়- লোকদেখানো। অক্সিজেন সিলিন্ডার কয়টি, সিস্টাররা কতটুকু ইচ্ছুক, ঝাপসা এক্স রে মেশিন, ব্লাড টেস্ট কিভাবে কি হবে- এসব না ভেবেই রোগী ভর্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তার উপর নতুন বিপদ হচ্ছে পানিবন্দী। যারা এর মাঝে শুরুতেই গাড়ি করে ঢাকা চলে যাচ্ছেন তারা ভাল করছেন। সে সামর্থ্য সবার নেই। বিপদ হঠাৎ আসে। এবং তার থেকে উদ্ধার পেতে সবচেয়ে বেশি কাজে আসে অর্থ। ক্যাশ রেডি তো ঈশ্বরও রেডি!
এসব বৈষম্য অনেক হতাশা তৈরি করছে। আমার ধারণা গত কয়েকমাসে সিগ্রেট বিক্রির হার অনেক বেড়ে গেছে। চায়ের দোকানগুলোতে গেলে দেখা যায় হেক্সিসল দিয়ে মোথা ভিজিয়ে বা আগুন দিয়ে মোথা জীবাণুমুক্ত করে ছেলেরা সিগ্রেট টানছে। গতকাল সঞ্জয় দত্ত ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। রাফ এন্ড টাফ লুক আনতে চুরুটে কড়া টান দিতেন! ইউনিক স্টাইল ছিল এ অভিনেতার। খবরটি পড়ে খারাপ লাগলো। উনার দিন গোনা শুরু হয়ে গেছে। সম্ভবত মারা যাবেন প্রণব মুখার্জিও। অসম্ভব স্মৃতিশক্তির অধিকারী এ রাজনৈতিকের লেখা বইগুলো লাইট হাউজের মতো। আমাদের ছোটবেলারকার পত্রিকা যেন হারাতে বসেছে। যাদের নামে লিডস্টোরি গুলো হতো- তারা প্রায় কেউই নেই। একজন একজন করে সবাই চলে যাচ্ছেন। কোভিডের সময় সবচেয়ে বেশি চোখে লাগলো এ বিষয়টি।
তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়- কোভিড আক্রান্ত হয়ে এ দেশে মৃত্যুর হার অনেক কম। এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকারে পড়লাম এর কারন আমাদের ইমিউনিটি। তারপর ভাইরাসের জেনেটিক সিক্যুয়েন্সের মিউটেশন। চীন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইটালি ও ভারতে ভাইরাসের ক্ল্যাড আলাদা আলাদা। যক্ষার উপস্থিতি আমাদের জন্য শাপে বর হয়েছে। যক্ষা ছিল বলে বিসিজি ভ্যাক্সিন ছিল। যে ক্ষতচিহ্ন আমরা সবাই বাম বাহুতে বয়ে বেড়াচ্ছি। কখন যে কী আশীর্বাদ হয়- এমনকী এ ক্ষুদ্র স্কারমার্কও যে কখনো আশীর্বাদ হবে- ভাবি নি।
ডাক্তারদের প্রণোদনার ব্যাপার ঝুলে আছে। আবাসন সমস্যাই এখন বেশি করে বাজছে। ডাক্তার ছাড়াও এক বড় অংশ আছে ব্রাদার। যারা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ডেডিকেশন দিয়ে কাজ করছে। বেশিরভাগের চাকরি পার্মানেন্ট নয়। রোগীদের গোসল করানো, ক্যাথেটার করা, খাওয়ানো- অনেক কাজ। বলছিলো- স্যার বেতনই পাই না ঠিকমতো। তাদের বেতন নিয়মিত হোক। অন্তত তাদের প্রণোদনা দেয়া হোক। এ লোকগুলো আসল ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। তাদের মূল্যায়ন হোক।
ভদ্রলোক ব্যাংকার। সারাদিন অফিস করে বাসায় এসে ল্যাপটপ খুলে বসেছেন। একটু অনলাইনে সময় কাটাবেন। দেখলেন তার স্ত্রী চা নিয়ে আসছেন। মানে সোশ্যাল মিডিয়ার বারোটা। বাচ্চারা পড়াশোনা করছে না, গতকালের বাজার হিসাব, বুয়ার অবাধ্যতা, পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীর গল্প- হাজার প্যাঁচাল। তার নিজেরও যে এক জীবন আছে- সে কেউ বুঝতে চায় না। ল্যাপটপের ডালাটা নামিয়ে জেঁকে বসলেন। সিরিয়াস ভঙ্গীতে ‘অভিযোগ’ শুনবেন বলে!
তার পাশের ফ্ল্যাটেই এক বয়স্ক দম্পতি থাকেন। বুড়ার মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। ছেলেমেয়েদের কঠিন নির্দেশ বাসা থেকে বের হওয়া চলবে না৷ এদিকে ফোন দিলেও তারা কথা বলার সময় পায় না। যতটুকু কথা হয় সব উপদেশ, নির্দেশনা। এ কেন করো না, এ কেন করলে। তারও যে এক জীবন আছে, এক দুই জনের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়, দরদাম করে বাজার আনতে সাধ জাগে- কেউ বুঝে না। দুইদিন ধরে খাবারের স্বাদ পাচ্ছেন না। ভয়ে আর ছেলেদের বলেন নি। রোগ হলেও দোষ, ভাল না লাগলেও দোষ!
একই সময় একই ছাদ। কেউ চাচ্ছে একাকীত্ব, কেউ চাচ্ছে কথা বলার মানুষ। পৃথিবীর সব সমস্যার উৎপত্তি বোঝার ঘাটতি থেকে। কেউ কাউকে বোঝে না। সবাই তার তার পয়েন্ট থেকে স্ট্রিক্ট।
মোল্লা নাসিরউদ্দিনের এক গল্প পড়েছিলাম। হোজ্জা গাধার পিঠে চড়ে আসছেন, পথে কিছু বালকের সাথে দেখা। তারা মার্বেলের ভাগ নিয়ে বিবাদ করছে। বড় মানুষ দেখে তারা তার কাছে গেল। হোজ্জা বললেন- ‘কেমন ভাগ চাও। ঈশ্বরের না মানুষের?’ শিশুরা ঈশ্বরের কাছের আত্মীয়, বললো- ঈশ্বরের পদ্ধতিতে ভাগ করে দিন।
মোল্লা কাউকে দিলো পাঁচটি, কাউকে দশটি, কাউকে একটি। বালকরা তো অবাক। এ কেমন ভাগ? মোল্লা বললেন ’তাই কী হচ্ছে না খোদার পৃথিবীতে! কারো আছে অনেক, আবার কারো কিছু নেই’।
মোল্লা আবার পথ চলা শুরু করলেন।
আসলেই ঈশ্বরের পৃথিবীর চেয়ে মানুষের কল্পনার পৃথিবী বেশি সুন্দর। তাই আমরা চাই আমাদের কথাগুলো কেউ লিখুক। নূরের ঈশ্বর তো হারিয়ে দিলেন, মাটির মানুষ যদি জিতিয়ে দেয়! কিন্তু তাও তো হয় না!