গতকাল ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান স্যারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বপালনের দু’বছর পূর্তিতে ব্যক্তিগত মূল্যায়ন, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, তৎকালীন আইপিজিএমআর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা আইন, বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার ইতিবাচক প্রচারে গণমাধ্যমের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। সে আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে উঠে আসে ৭১ এর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হাসান খানের স্মৃতিচারণ এবং পরবর্তীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক হিসেবে দেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টার কথা। অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান স্যারের ধারাবাহিক স্বাক্ষাতকারের প্রথম অংশ প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।
অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খানঃ দেশের জন্য জীবন দানের যে মহোৎসব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোথাও পাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বহেরাতৈল পাহাড়ের ক্যাম্পে একদিন একা বসে আছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হেডকোয়ার্টার থেকে ৪ জন আসছে যারা টাঙ্গাইল যাবে। আমি তো অবাক। আমাদের স্কুলের সেরা ছাত্র সালাউদ্দীন ভাই, সবুর ভাই, হিলালী ভাই আর খয়ের। লুঙ্গি পরা তাঁদের হাতে কাপড়ের ব্যাগ দেখলাম, ব্যাগ ভর্তি গ্রেনেড নিয়ে তাঁরা টাঙ্গাইল যাচ্ছে। ওখান থেকে অপারেশন শেষে ফিরে আসার পর জানা গেল সালাউদ্দীন ভাইকে রাজাকাররা ধরে জবাই করে মেরে ফেলেছে। পরে শুনেছি তাঁকে নাকি পেট থেকে দুই ভাগ করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে কোন কোন অপারেশনে দেখা যেত মাত্র ১০ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রয়োজন, কে কে যেতে চান যোদ্ধাদের কাছে জানতে চাওয়া হলে ১০০ জনের বেশি যোদ্ধা সবাই সেই সব অপারেশনে যাওয়ার জন্য মড়িয়া থাকতেন।
আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি যে আমি ৭১ এ স্কুলে পড়তাম, এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। এটি আমার জন্য গৌরবের বিষয় আমি ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা এমন ছিল বাংলাদেশের মানুষ যে যেভাবে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখা দায়িত্ব বলে মনে করেছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বিশ্বের অন্যতম স্বাধীনতার ইতিহাস যেটিতে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, ২ লাখ মা বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, যার বিনিময়ে বাংলাদেশ। আজকে তাই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আমার বক্তব্যঃ এ দেশটি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দেশ, সুখী দেশ, আমাদের এখনো পারবারিক জীবন আছে, সামাজিক জীবন আছে, সে হিসেবে এ দেশটির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, দেশটির উন্নয়নের জন্য সকলের দায়িত্ব পালন করা উচিত, দেশের উন্নয়নের জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমাদের চিকিৎসক সমাজের, চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ডাঃ মিলনের রক্তদান এটি কিন্তু জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে চিকিৎসক হিসেবে যে আত্মত্যাগ তার বিনিময়ে চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমাদের যা দায়িত্ব তা যেন যথাযথ ভাবে পালন করি। মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক, তাঁরা বাঁচতে চায়, সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা চায়। আমাদের যে সীমাবদ্ধতা আছে তা সাধারণ মানুষের ভাবার সুযোগ নেই। যারা আমরা রয়েছি দেশের সবচাইতে মেধাবী সন্তান আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা, আমাদের চিকিৎসকেরা সেখানে আমরা দেশ প্রেমের ভিত্তিতে যেন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, চিকিৎসার উন্নয়নের যথাযথ ভূমিকা রাখি, কোন মানুষ যেন আমাদের দ্বারা কোন কষ্টের শিকার না হয়।
প্ল্যাটফর্মঃ তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানানোর ক্ষেত্রে আপনার ভূমিকার কথা জানতে চাই।
অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খানঃ বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রক্ষা করার এবং বাস্তবায়ন করার। সেখানে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আমি শুরু থেকে দায়িত্বপালন করেছি। আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, উনাকে বলতে গেলে আমি প্রথম ঘর থেকে বের করে জনসম্মুখে নিয়ে আসি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তখন “একাত্তরের ইতিহাস, বাঙালীর ইতিহাস” শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম। ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের গ্যালারিতে আয়োজিত সে অনুষ্ঠানে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছাড়াও, ডঃ আনিসুজ্জামান, পান্না কায়সার, নীপা আলীম, ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশে একটি মাত্র ভাষা সৈনিক সমাবেশ হয়েছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে যার আয়োজনের সাথে সদস্য সচিব হিসেবে আমি যুক্ত ছিলাম। এখানে দেশে বিদেশে যতজন ভাষা সৈনিক ছিলেন প্রত্যেককে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এসকল কাজে নতুন প্রজন্মকে আমাদের গৌরবের ইতিহাস পৌঁছে দেয়া দায়িত্ব হিসেবে মনে করেছি। সে লক্ষ্যে যখন যেখানে যেভাবে পেরেছি কাজ করার চেষ্টা করেছি। ইতিহাসের সাথে থাকলে বা একটা বড় ধরনের ঘটনার সাথে থাকলে নিজের এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করে। যেমন যুদ্ধপরাধীদের বিচারের যে প্রস্তাবটি প্রথম আমরা যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর(তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন) কাছে ২০০৫ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে সকল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির কাছে উপস্থাপনার সুযোগ আমার হয়েছিল। এটি আমার জন্য একটি ভালো লাগার জায়গা। আমরা দাবী করেছি বলেই হয়েছে তা কিন্তু নয় বঙ্গবন্ধু কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সকল কার্যক্রম করে রেখে গিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যার মাধ্যমে আমরা যারা সামাজিক শক্তি আছি তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছি।
প্ল্যাটফর্মঃ স্যার একটি প্রস্তাব আপনার মাধ্যমে প্ল্যাটফর্ম থেকে দিতে চাচ্ছি, আমাদের যে শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক আছেন তাঁদের তালিকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নাম ফলকে খোদিত আছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ওয়ার্ড তাঁদের নামে করা যেতে পারি কি না? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যদি এটি শুরু করে তাহলে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এটি শুরু করতে পারে।
অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খানঃ এটি খুব ভালো প্রস্তাব। এখন আমি বঙ্গভবন থেকে আসলাম। বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি উদ্বোধন যেটি করলেন- ত্রিশ লক্ষ শহীদের স্মরণে বৃক্ষ রোপন করা হবে, সেখানে আমরা বিভিন্ন শহীদের নামে একেকটি বৃক্ষ রোপন করেছি, ওখানে আলোচনা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বৃক্ষ রোপন করবো। তুমি যেটি বলললে সেটি অতি ভালো প্রস্তাব যে আমাদের শহীদ চিকিৎসকদের স্মৃতি রক্ষার জন্য এটি করতে পারি, সেটি নিশ্চয়ই আমরা আলোচনা করবো। বঙ্গবন্ধুতে সাম্প্রতিক সময়ে আরো দুটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখানে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন, সে কক্ষটি আমরা চিহ্নিত করেছি এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ হিসেবে আমরা সংরক্ষণ করবো। অনুরূপভাবে আমাদের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম আমাদের এখানে ছিলেন, তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে সে কক্ষটি সংরক্ষণ করা হবে।
এছাড়াও স্বাক্ষাতকারের অন্যান্য অংশে রেসিডেন্সি ভাতা কখনো বন্ধ হবে না, রেসিডেন্টদের জন্য নতুন হোস্টেল নির্মাণাধীন আছে, নতুন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বিষয় চালু ও আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, ১০০০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু সহ অন্যান্য বিষয় আলোচিত হয়। বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে প্রকাশিত হবে।
চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। চিকিৎসকদের উপর আস্থার অভাব, নেতিবাচক প্রচারণা চিকিৎসকদের জনগণের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাসে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা শিক্ষার্থীদের অবদান অনস্বীকার্য। সেই গৌরবময় ইতিহাস এবং চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত মানুষদের নিজেদের দায়িত্ব ও অধিকারচেতনা ফিরে দেখার প্রয়াসে আজ ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বিশেষ আয়োজন হিসেবে এ স্বাক্ষাতকার প্রকাশ করা হল।
অনুলিখন ও সম্পাদনাঃ ডাঃ মোঃ মহিবুর হোসেন নীরব,
সম্পাদক, প্ল্যাটফর্ম।
চিত্র ও শব্দগ্রহণ ও সম্পাদনাঃ এস এম নিয়াজ মোর্শেদ,
এডমিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্ল্যাটফর্ম।
স্বাক্ষাতকারগ্রহণ টিমঃ
ডাঃ নাহিদ উল হক,
সহকারী অধ্যাপক, ডায়াবেটিক এ্যাসোসিয়েশন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,
ডাঃ সেলিম শাহেদ,
প্রভাষক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর,
উপদেষ্টা, প্ল্যাটফর্ম।
ডাঃ মোঃ নুরুল হুদা খান,
মেডিকেল অফিসার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর,
উপদেষ্টা, প্ল্যাটফর্ম।
ডাঃ মোঃ মুরাদ মোল্লা,
উপদেষ্টা, প্ল্যাটফর্ম।
ডাঃ মারুফুর রহমান অপু,
মেডিকেল অফিসার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর,
ফাউন্ডিং মেম্বার ও সহসম্পাদক, প্ল্যাটফর্ম।
ডাঃ আহমেদুর রহমান সবুজ,
মেডিকেল অফিসার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।