আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে শিশুরা তো এমনিতেই কথা বলা শিখে যায়।এদের আবার কথা বলা শেখাবার প্রয়োজন কিসের ? কথা তো বনের পাখিদের শেখাবার দরকার হয় । একথা ঠিক নয়। শিশুদেরকেও কথা বলা শেখাবার প্রয়োজন আছে ।”কথা” হচ্ছে মানুষের মুখ দিয়ে উচ্চারিত কিছু শব্দ বা বাক্য ,যার অর্থ থাকতে হবে ।’কথা’ মানুষের মাঝে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম বললে অত্যুক্তি হবে না ।অবশ্য সুস্পষ্ট ভাষায় কথা না বললেও আকার,ইঙ্গিতে এবং কিছু মুখের শব্দ দ্বারাও মানুষের মাঝে যোগাযোগ করা সম্ভব ,যেমনটি আদিম যুগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা করে গেছেন । সেই আদিম যুগে,যখন মানুষের বাস ছিল বনে- জঙ্গলে এবং বনের পশুদের সাথে লড়াই করে জীবিকা নির্বাহ করতে হ’ত,তখনও মানুষ মুখ দিয়ে নানাপ্রকার শব্দের দ্বারা একে অপরের সাথে এমনকি প্রয়োজনের তাগিদে পশুদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করত ।
আজ এই সুসভ্য জগতে সেসব দিনের কথা ভাবাই যায়না। এই পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বাস । বিভিন্ন ভাষায় তারা কথা বলেন । আর এই ‘ কথা বলা’ বিষয়টিও যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ,বিশেষ করে শিশুদের বেলায় ,সেকথা আজ ভাববার দিন এসেছে। কারণ একথা সত্যি যে কোন কারণে একটি শিশু যদি জঙ্গলে একাকি বড় হয় ,কোন মানুষকে কথা বলতে না শোনে তাহলে সেই শিশু বনের পশুপাখির চিৎকার ,শব্দ,ইত্যাদি যা শুনবে সেটাই শিখবে । কারণ কথার জন্ম মস্তিষ্কে। যদিও তা উচ্চারিত হয় আমাদের মুখ তথা গলা থেকে । অবশ্য শব্দের উৎপত্তি শুধু গলা থেকে বললে পুরোটা বলা হয়না । শব্দসৃষ্টির জন্য যেমন গলায় রয়েছে স্বর- যন্ত্র ( vocal cord ) ,তেমনি মুখের তালুর পশ্চাৎভাগ ,জিভ এবং ঠোট, স্বরসৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে । এই সমগ্র প্রকৃয়াটি বেশ জটিল । শব্দসৃষ্টির বিভিন্ন পর্ব বা পর্যায়ে শরীরের এই সমস্ত শব্দসৃষ্টিকারী অংশের মধ্যে,বায়ু চলাচল, জিভ ,ঠোঁটের নড়াচড়া ইত্যাদির মধ্যে একটি গভীর সামন্জস্য রয়েছে । কিন্তু এসব বিষয় না বুঝে ,না জেনেও একটি শিশু নির্ভাবনায় কথা শিখে যায় ।
সাধারণতঃ ছয় – সাত মাস বয়সের পর থেকেই একটি শিশুর মুখে আধো আধো বুলি ফুটে যায় ।এবং এক বছর বয়স থেকে কথা বলা শিখতে শুরু করে এবং দু’তিন বছরের মধ্যেই স্বচ্ছন্দে কথা বলতে শিখে যায় । তবে অনেক ক্ষেত্রে একটি শিশু দেরীতে কথা শুরু করতে পারে । এবং ভালভাবে কথা বলতে আরও কিছু সময় বেশী লাগতে পারে ।
এ নিয়ে খুব বেশী চিন্তা করার কোন কারণ নেই । কারণ কথা শেখার জন্য যেমন আমাদের শরীরের স্বর- সৃষ্টির প্রত্যঙ্গগুলোর ভুমিকা রয়েছে ,তেমনি সমান গুরুত্ব রয়েছে মস্তিষ্কের স্নায়ুপুন্জের। গুরুত্বের দিক দিয়ে সামাজিক শিক্ষাপ্রকৃয়ার অবদানও বিশাল গুরুত্বপূর্ণ । অর্থাৎ কথা শেখার পেছনে এক সুসামন্জস্য ,স্নায়ুবিক ,মানসিক ও সামাজিক কলাকৌশল কাজ করছে । কিন্তু ব্যাপারটা এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে যে কেউ এসব খেয়ালও করেননা । যেমন জলে কিছুদিন হাত পা ছুড়লে সাঁতার শিখে যাওয়া যায় ,এর পেছনের কলাকৌশল বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন না মেনেও ।
একটি শিশু যদি মস্তিষ্কের অপূর্ণতা অথবা কম পরিপূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহন করে তবে সেই শিশু দেরীতে কথা বলে । তবে এমনটি দেখলে চুপ করে বসে থাকা ঠিক নয় । অবশ্য এ ব্যাপারে ধৈর্য্য ধরতে হবে,অপেক্ষা করতে হবে । এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অবশ্য কর্তব্য । চিকিৎসক , পিতামাতাকে উপযুক্ত পরামর্শ দান করে শিশুকে কথা বলতে সাহায্য করবেন ।
স্বর- সৃষ্টির প্রত্যঙ্গগুলি হচ্ছে -স্বরযন্ত্র ,মুখের তালুর পশ্তাতভাগ , জিভ ,ঠোঁট ইত্যাদি । যদি এসবের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা থাকে ,তাহলেও কথা শিখতে বলতে অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে ।এবং এক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ।
****
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং বিভিন্ন প্রকৃয়ার মাধ্যমে শিশুকে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করা অর্থাৎ তাকে কথা বলতে শেখানো । এ বিষয়টি যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেটাই আমাদের অনেকের জানা নেই । যেমন যে বয়সটিতে শিশুর মুখে আধো আধো বোল ফুটতে শুরু করে এবং পরবর্তীতে ভাঙা ভাঙা কথায় পরিণত হতে আরম্ভ করে সেই সময় শিশুদের সাথে হাত মুখ নেড়ে শিশুর সাথে কথা বলতে হয় । শিশুদের মুখে সাধারণতঃ বাব্ বাব্ ,দাদ্ দাদ্ অথবা বাবা ,দাদা এইসব বুলিগুলো প্রথমে আসতে শুরু করে । মা’ কথাটি সাধারণতঃ একটু পরেই আসে শিশুদের মুখে । অবশ্য সকল শিশুর বেলায় সবকিছু একরকম হয়না । বাড়ীতে বুড়ো দাদা দাদী ,নানা নানী থাকলে তারাঁই সোৎসাহে শিশুকে কথা শেখাবার কাজটি করে থাকেন ।এবং বাড়ীতে ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে খেলাচ্ছলে তারাও ছোট শিশুর সাথে কথা বলতে খুব উৎসাহ পায় , এবং এমনিভাবে একসময় শিশু কথা বলতে শিখে যায়। তাইবলে মা – বাবার ভূমিকাও বাদ দিবার নয় । মা বাবাকেও সময় করে শিশুর সাথে দিনের কিছুক্ষণ সময় কথা বলা উচিত । তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে,পরিবারের সকলকেই একই ভাষায় কথা বলতে হবে । অর্থাৎ মাতৃভাষা । কথাটি অদ্ভুত শোনালেও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে । আমেরিকায় বসবাসকারী এক মহিলার শিশুর বেলায় এমনটি ঘটেছিল । তিনি তার শিশুটির মুখে কথা ফুটবার সময় একটি অফিসে চাকরী নেন ।এবং সেসময় শিশুকে Day careএ রেখে যেতেন । সেখানে শিশুটি ইংরেজী ভাষাভাষী মানুষের কাছে থাকত । এরপর শিশুটি বাড়ীত এসে তার মায়ের বাংলা ভাষা শুনতে পেত ।অর্থাৎ শিশুটি দুইটি ভাষার মাঝখানে এসে পড়ে । এতে করে তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রকৃয়া ব্যাহত হয় এবং দেখা গেল,শিশুটি মুখে কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছেনা । মা বাবা এ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিলেন । শেষ পর্যন্ত দুই বৎসর বয়সে শিশুটি কথা বলতে পেরেছিল ।
আমেরিকায় বসবাসকারী আর একজন মহিলা তার শিশুকে নিয়ে বাংলাদেশে তার মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছিল কয়েক মাসের জন্য । শিশুটি তখন সবেমাত্র কথা বলতে শিখছে । কিন্তু এই নতুন পরিবেশে এসে দেখা গেল শিশুটি একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে । মুখ দিয়ে কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছুই বলতনা । এমন ঘটনার সংখ্যা হয়ত খুবই কম । কিন্তু সমস্যাগুলি আমাদের জানা থাকা উচিত ।
এছাড়া সামাজিক পরিবেশ ভিন্নতর হওয়ার কারণেও শিশুর কথাশেখা ব্যাহত হতে পারে ।যেমন শহর এবং গ্রামের পরিবেশ এক নয় । গ্রামের পরিবেশ শহরের থেকে বেশ খোলা মেলা হয়ে থাকে, শিশুরা যেটা খুব পছন্দ করে । সেখানে একটি পরিবারের সাথে আরেকটি পরিবারের ভাবের আদানপ্রদান খুব সহজেই হয়ে যায় ।এতে করে শিশুদের সাথে শিশুদের খেলাধূলা ,কথাবলা ও শোনার ফলে একটি শিশু ,যে সবে কথা বলতে শুরু করেছে,সে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলার স্বতঃস্ফূর্ততা খুঁজে পায় । যেটা শহরে সাধারণতঃ হয়না । শহরে সকলেই বেশ আত্মকেন্দ্রিক । সেখানে পাশের বাড়ীর একটি শিশুর সাথে এ বাড়ী.যর শিশুর বিশেষ দেখাই হয়না । সুতরাং এমতাবস্থায় শিশুর কথা শিখার বয়সটিতে আরও কয়েকটি শিশু যারা কথা বলতে পারে তাদের সময় কিছু সময় একসাথে থাকবার সুযোগ করে দিতে হবে , তাহলে সহজেই শিশুটি কথা বলতে পারবে ।
এছাড়া ইদানিংকালে ,বিশেষ করে শহরে অনেক মায়েরাই চাকুরীজীবি । সুতরাং দিনের অনেকটা সময়ই তারা শিশুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন । এমন ক্ষেত্রে যেসব মায়ের শিশুসন্তান আছে ,তাকে এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে। তিনি যে বাইরের থেকে কাজ করে ফিরেই সংসারের নানাবিধ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ,এমনটি করলে চলবেনা ।
সর্বোপরি বলা যায় – ,একটি শিশু ঘরে থাকলে তাকে কথা শেখাবার ব্যাপারে পরিবারের সকলকেই সজাগ থাকতে হবে তবে সার্বিক দায়িত্ব মা’কেই নিতে হবে । তাহলে শিশুর কথা শেখার ব্যাপারে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা । আর এর পরও যদি শিশুর বয়স অনুপাতে স্বাভাবিক কথা বলার স্বতঃস্ফুর্ততা না আসে তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে । আর এভাবে সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়া হলে শিশুর কথা শেখা নিয়ে কোন সমস্যা থাকলে তা সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভবপর হয় ।
*****